হঠাৎ করেই দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সাল থেকে কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তান মনস্তাত্ত্বিক লড়াই দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী অশান্তির চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। কাশ্মির নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে দুই বার পূর্ণাঙ্গ ও একবার স্থানীয় পর্যায়ে যুদ্ধ হয়েছে।
তবে ১৯৮৯ সালে কাশ্মিরে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভ থেকে দুই দেশের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই স্থায়ী রূপ-লাভ করেছে। বিগত ৩১ বছরে কখনো দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে, ১৯৯৯ সালে কারগিলে স্থানীয়ভাবে মাসব্যাপী যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু দুই দেশই যুদ্ধপ্রস্তুতি হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, অথচ দেশ দুটির বিপুল-সংখ্যক মানুষ (বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে পাকিস্তানে ২৪ শতাংশ ও ভারতে ২২ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। পাকিস্তান একদিকে কাশ্মির ইস্যুতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, অন্যদিকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি তালেবান ও আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও দেশটিকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়।
ভৌগলিকভাবে চীন দক্ষিণ এশিয়ার অংশ না হলেও এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশের সঙ্গে দেশটির সীমান্ত বিদ্যমান। ব্রিটিশরাজ ভারত ত্যাগের সময় সীমানা চিহ্নিতকরণে যে চূড়ান্ত অবিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছে তার দরুণ এই অঞ্চলের দেশগুলোকে শত বছরব্যাপী কোন্দল ও যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক ভারত-চীন যুদ্ধাবস্থা এই এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। জুন মাসে ভারত ও চীনের মধ্যে এমনই এক যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল কাশ্মিরের লাদাখ ও আকসাই চীন সীমান্তে। ১৯৬২ সালে ৩০ দিনব্যাপী যুদ্ধে চীন কাশ্মিরের ‘আকসাই’ অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশের ‘মেচুকা উপত্যকা’ দখল করে নেয়। যুদ্ধশেষে চীন অরুণাচল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলেও আকসাই অঞ্চল দখলে রাখে; এখন যা ‘আকসাই চীন’ নামে অভিহিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে চীনের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে তিনবার। সর্বশেষ ১৯১৪ সালে ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে এটি নির্ধারণ করা হয় তিব্বতের সঙ্গে ব্রিটিশ-ভারত সরকারের আলোচনাক্রমে। সে-সময়ে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল না, এই অজুহাতে চীন তা মেনে নেয়নি। কম্যুনিস্ট বিপ্লবের পর চীন ১৯৫১ সালে তিব্বত দখল করে নেয়। লাদাখে ভারত ও চিনের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সম্মত ও যৌথ মাপজোক করে স্থিরীকৃত আন্তর্জাতিক সীমানা নেই। ভারত ও চীনের সীমানা নির্ধারিত হয় মূলত টহলদারির কর্তৃত্ব এবং আবাসন ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে।
চীন-ভারত সীমান্তদ্বন্দ্ব এর আগেও হয়েছে। এবারে চীনের যুদ্ধংদেহী মনোভাব বিশ্ববাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল এই জন্য যে, দুটি দেশই প্রভূত সমরশক্তির অধিকারী; যদিও ভারত আমদানিনির্ভর অস্ত্র-ব্যবস্থায় সজ্জিত। পক্ষান্তরে চীন গত ৩০ বছরে সমর প্রযুক্তিতে এতটাই উন্নতি করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ১৬ জুন বিশ্ববাসী জানতে পারে লাদাখের ‘গালওয়ান উপত্যকা’য় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ৩ জন মধ্যম-সারির কর্মকর্তাসহ ২০ ভারতীয় এবং অজ্ঞাত-সংখ্যক চীনা সেনা নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও ১০ ভারতীয় সৈন্যকে চীন বন্দি করে নিয়ে যায়, যাদের কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তি দেয়। এর পরপর-ই উভয় দেশ হিমালয়ের ওই এলাকায় নিজ নিজ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। অথচ এই দুটি দেশ ১৯৬২ সালের পরে কয়েক দশক মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিল। যদিও সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে মিটমাট হয়নি। গালওয়ান ভ্যালি ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই উপত্যকার কোলঘেঁষেই ভারত ‘দৌলতবেগ ওল্ডি’ এলাকাতে যাওয়ার নতুন সড়ক নির্মাণ করেছে। গালওয়ান উপত্যকায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলেই দৌলতবেগ ওল্ডিতে তাদের যাতায়াত সহজতর হবে। আর এই দৌলতবেগ ওল্ডি-ই হিমালয়ের ওই অঞ্চলে প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট। সেখানে ভারত বিমান অবতরণের জন্য বিশ্বের উচ্চতম এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ করেছে, সিয়াচেন হিমবাহের যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ ও সেনা পৌঁছে দেওয়ার জন্যও দৌলতবেগ ওল্ডির গুরুত্ব অপরিসীম।
পত্রিকান্তরে খবর প্রকাশিত হয়েছে, চীন ভারত দ্বন্দ্বের উত্তাল দিনগুলোতে পাকিস্তানের একাধিক বিমানঘাঁটিতে চীন বিমান মোতায়েন করেছে। ভারতও প্রকাশ্যেই চীন ও পাকিস্তান দুই ফ্রন্টেই যুদ্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। যদি কখনো এমনটি হয়-ই, সেক্ষেত্রে পাকিস্তানে অবস্থানরত কাশ্মিরি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও কোনো কোনো পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনও ভারতবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তেমনটি হলে কাশ্মিরের নিপীড়িত মানুষগুলোর ভাগ্যে অধিকতর বিপর্যয় নেমে আসবে।
শ্রীলঙ্কা অবশ্য ভারতকেই প্রথমে এই প্রকল্পে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিল। হয়তো আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় ভারত তখন সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
ইতোপূর্বে ২০১৭-এর ২৭ শে জুন ভুটান-চীন-ভারত (সিকিম) সীমান্ত-সংলগ্ন বিতর্কিত ডোকলাম অঞ্চলে চীন কর্তৃক একটি রাস্তা নির্মাণের প্রতিবাদ জানায় ভুটান। নির্মিতব্য সড়কটি ছিল ভারতের কৌশলগত শিলিগুড়ি করিডোরের দিকে সম্প্রসারিত। ভুটান স্বাধীন দেশ হলেও দেশটি ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে; যে চুক্তির বলে দেশটি ভারতের কাছ থেকে পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ব্যাপারে পথনির্দেশনা নেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ভুটান সরকার ডোকলামে ভারতকে সৈন্য মোতায়েনের জন্য অুনরোধ করে। সে-সময়ে আলোচনার মাধ্যমে ভারত ও চীন ডোকলাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে; চিন সড়ক নির্মাণও বন্ধ রাখে। সাম্প্রতিক দ্বন্দের সময়ে চীন আবার ভুটানের ‘সাকতেং অভয়ারন্য’র ওপরে নিজের সার্বভৌমত্ব দাবি করেছে। ভুটানকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে চীন, এ-ব্যাপারে অলোচনায় তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি অর্থাৎ ভারতের অংশগ্রহণ মেনে নেবে না (বিবিসি বাংলা, দিল্লি, ৬ জুলাই)। চীনের এই দাবিকে অনেক বিশ্লেষক ভুটানকে ভারত-চিন দ্বৈরথে নীরবতা অবলম্বনের লক্ষ্যে চাপ-প্রয়োগ মনে করছেন।
ওদিকে ভারত ও চীন-স্থলবেষ্টিত নেপাল, যে দেশটি কিনা ব্যবসায়, সংস্কৃতি, কানেকটিভিটিসহ সব ক্ষেত্রে ভারতের ওপরে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল; সেই দেশটি অভাবনীয় এক কাণ্ড করে বসেছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ৮ মে যখন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চীনের তিব্বত সীমান্তে লিপুলেখের সঙ্গে সংযুক্তকারী ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক উদ্বোধন করেন, তখন নেপাল প্রতিবাদ জানায়। দাবি করে, যে এলাকার মধ্য দিয়ে এই সড়ক তৈরি করেছে, তার অনেকটাই তাদের। অতি দ্রুত তারা রাষ্ট্রীয় মানচিত্র নতুন করে ছাপে এবং পালামেন্টে তা অনুমোদিতও হয়ে যায়। একইসঙ্গে ওই এলাকায় নেপাল সীমান্তরক্ষা বাহিনী নিয়োগ করে। চীনের সঙ্গে দ্বৈরথের মধ্যে এমন ঘটনা ভারতকে ভাবিয়ে তুললেও ভারত তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে এখনো কড়া কোনো বার্তা দেয়নি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, নেপালের নেওয়া এই ব্যবস্থা চীনের প্ররোচনায় সংঘটিত হয়েছে।
ভারত সাধারণত প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা মেনে নেয় না। তবে সাম্প্রতিক বিরোধে রাশিয়ার মধ্যস্থতা ভারত মেনে নিয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ পরবর্তীকালেও রাশিয়ার মধ্যস্থতাতেই উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল। রাশিয়া মধ্যস্থতায় এগিয়ে এসেছে। কারণটা যে শুধু বাণিজ্যিক তা-ই নয়, এর কৌশলগত দিকও রয়েছে। রাশিয়ার উপলব্ধি হচ্ছে, ভারত-চীন সীমান্তে অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে কিংবা যুদ্ধ বেধে গেলে ভারত অধিকতর আমেরিকামুখী হয়ে পড়বে; ইতোমধ্যে মস্কোর পুরনো বন্ধু ভারত ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিতে সই করেছে এবং ২০১৮ সালে যোগাযোগ নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘মুক্ত ও অবাধ ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের’ ধারণার সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছে। মস্কো মধ্যস্থতায় এগিয়ে এসেছে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক যেন মাত্রাছাড়া পর্যায়ে না পৌঁছায়। এরফলে প্রথমে জেনারেল পর্যায়ে; পরবর্তী সময়ে মস্কো, বেইজিং ও দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করেন। এরপর উভয় দেশ এলএসি থেকে সৈন্যবস্থান কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি প্রত্যহার করেনি; প্যাংগং, গোগরা হটস্প্রিং ও ডেপসং পয়েন্ট থেকে চীন তার সদ্য-নির্মিত অবকাঠামো ভেঙে সরে যায়নি বলে ভারতের বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করলেও সরকার এ-ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলেনি। তবে এ যাত্রায় যুদ্ধ হচ্ছে না বলেই মনে হয়, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য স্বস্তিদায়ক।
ভারত মহাসাগরে চীন সামরিক শক্তি মোতায়েন ও অর্থনৈতিক প্রকল্প গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ নামক প্রভাববলয় গড়ে তুলছে। চীন সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। সেখানে চিনের সাবমেরিনসহ যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কা অবশ্য ভারতকেই প্রথমে এই প্রকল্পে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিল। হয়তো আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় ভারত তখন সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।
ভারতের উপকূলঘেঁষা ১২০০ ক্ষুদ্র দ্বীপের সমষ্টি মালদ্বীপ, যার আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গকিলোমিটার একসময় ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সেই মিত্রতা আর নেই। মালদ্বীপের ১৭টি দ্বীপে পর্যটনসহ বাণিজ্যিক প্রকল্পে ব্যাবস্থাপনাসহ বিনিয়োগ করে প্রকারান্তরে দ্বীপগুলো ওপরে চীন এক ধরনের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদেরকে শঙ্কামুক্ত করার জন্য বড় দেশ হিসেবে ভারতকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপ্রবণ এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়।
মিয়ানমারকে বলা যায়, চীন-নির্ভর দেশ। দেশটিতে দীর্ঘ সামরিক শাসনামলে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে মনোমলিন্যের কারণে দেশটি চীননির্ভর হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে চীন বৃহদাকার সামুদ্রিক বন্দর নির্মানের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বন্দরটি চীনের মূল ভুখণ্ডের সঙ্গে সড়ক ও রেলের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে চীন বঙ্গোপসাগরে সরাসরি তার উপস্থিতি নিশ্চত করবে।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি-জিংপিং প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রতি দেন। আগামী ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে (এশিয়া টাইমস, ১৭ জুলাই ২০১৯)। বাংলাদেশে বর্তমানে ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, এর মধ্যে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াই ৯টি মেগা প্রকল্পেই চীনের বিনিয়োগ রয়েছে অথবা তারা নির্মাণকাজ করছে। এছাড়া আরও ৬টি মেগা প্রকল্পের জন্য চীনা বিনিয়োগ চাওয়া হবে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। যার মধ্যে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ বরিশাল-ভোলা সড়ক সেতু রয়েছে। বাংলাদেশে ভারতীয় ও চীনা বিনিয়োগ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, চীনা বিনিয়োগ লাভজনক বেশ কয়েকটি কারণে। এগুলো হলো,
১. চীনা ঋণের সুদ ভারতীয় ঋণের সুদের চেয়ে কম,
২. প্রস্তাবিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে চীনা ঋণের জন্য বাংলাদেশ চীনের কাছে প্রস্তাব পেশ করে, পক্ষান্তরে ভারত নিজেই বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব পেশ করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ভারতের ঝোঁক সেই-সব প্রকল্পের প্রতি, যেগুলো বাংলাদেশ-ভারত কানেকটিভিটি সহায়ক,
৩. কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের মতো জটিল প্রযুক্তিতে ভারতীয় অভিজ্ঞতা কম,
৪. ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ উপকরণ ভারত থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
এ সব বিবেচনায় চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য অনুকূল। বাংলাদেশ রুশ ঋণে সেদেশের অস্ত্র কিনেছে, যদিও বাংলাদেশ প্রধানত চীন থেকেই অস্ত্র ক্রয় করে। ভারত ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রস্তাব করেছে ভারতীয় সমরাস্ত্র কেনাকাটার জন্য, কিন্তু নানাবিধ কারণে ভারতীয় পক্ষের ব্যাপক দৌড়ঝাঁপের পরেও বাংলাদেশ ২০১৯-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। তবে, এটি সত্য যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা-দানকারী প্রধান দেশ ভারত। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অচিহ্নিত সীমান্ত-সমস্যা, ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে, যদিও আন্তঃনদী পানি ব্যাবস্থাপনা সম্ভব হয়নি, বিশেষত তিস্তার ক্ষেত্রে। চট্টগ্রামের মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারত ও চীন উভয়ের প্রস্তাব পাশ কাটিয়ে এর দায়িত্ব দিয়েছে জাপানকে, যে দেশটি এখনো বর্হিবিশ্বে সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন করেনি। এরপরও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সর্বোত্তম রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় বিদ্যমান।
ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশগুলো বিনিয়োগ ও সামরিকীকরণের ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে চীনকে নিরাপদ ও সহায়ক মনে করছে। এছাড়া বড় প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের কাছে ভুটানের আত্মসমর্পণ, সিকিম দেশটিকে নিজ দেশের অন্তর্ভূক্তিকরণ, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ, কাশ্মির ইতিবৃত্ত ইত্যাদি কারণও এক্ষেত্রে দেশগুলোর জন্য ভিন্ন কিছু ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদেরকে শঙ্কামুক্ত করার জন্য বড় দেশ হিসেবে ভারতকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপ্রবণ এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যা খুবই প্রয়োজনীয়।