উত্তম কুমার নামে জগতে একজন অভিনয়শিল্পী ছিলেন; ছিলেন নয়, আছেন! থাকবেন অনেক অনেক কাল। যতদিন বাঙালি থাকবে আর থাকবে সিনেমা নিয়ে মানুষের আগ্রহ, ততদিন উত্তম কুমার জ্বলজ্বলে এক তারার নাম!
তো কথা হচ্ছে—উত্তম কুমারকে নিয়ে আবার কথা কেন? কথা এজন্য যে, যদি কোনো বঙ্গসন্তান উত্তম কুমারকে না দেখে, তার কথা না শুনে বড় হয়ে যায়, তাহলে তার মধ্যে অনেক খামতি থেকে যাবে, এটা বিলক্ষণ সত্যি। একজন মানুষ, বিশেষ করে বাঙালি কেমন কেতাদুরস্ত হতে পারেন, কেমন ভদ্র-মার্জিত হতে পারেন, তার একটা বড় উদাহরণ পর্দার উত্তম কুমার। ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা থাকতেই পারে, অভিনেতার ব্যক্তি জীবনের চেয়ে তার পর্দাজীবন বেশি বিবেচ্য। তাই পর্দার উত্তম কুমার বাঙালির জন্য এক অবশ্যপাঠ্য বিষয়।
প্রথম দেখা
আমাদের তখন স্কুলবেলা। ১৯৮৫ সালের শীতকাল। ঢাকায় হচ্ছে saarc সম্মেলন। সেই সম্মেলনকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে, এক দুপুরে দেখিয়ে দেওয়া হলো ‘দীপ জ্বেলে যাই’। এই সিনেমায় উত্তম কুমার নেই। তবে তার নামের সঙ্গে মাখোমাখো হয়ে জড়িয়ে থাকা নাম—সুচিত্রা সেন আছেন। আর আছেন বসন্ত চৌধুরী। যতদূর মনে পড়ছে সে যাত্রায় বিটিভিতে ‘পথে হল দেরী’ দেখানো হয়েছিল। তখনই প্রথম পর্দায় দেখতে পেলাম পর্দামানব উত্তম কুমারকে। সে বছরই আমরা ঢাকায় বসে বড় পর্দায় দেখতে পেলাম, একসঙ্গে উত্তম আর সুচিত্রাকে। গুলশান ১ নম্বরে তখন একটা সিনেমা হল ছিল, নাম জ্যোতি। আর সিনেমার নাম ছিলে ‘শাপ মোচন’। সুচিত্রা-উত্তম জুটির বড় হিট ছবি। ১৯৫৫ সালের নির্মিত এই সিনেমার পরিচালক সুবীর মুখার্জী। মাধুরী আর মহিমের মানে সুচিত্রা উত্তমের এই সিনেমা বাঙালি মনে দাগ হয়ে আছে। মিষ্টি অভিনয়ের জন্য চিরস্থায়ী জায়গা হয়ে আছে আরেক অভিনেতা পাহাড়ী স্যানালের। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা ও তার কণ্ঠে ক’টি গান তো রীতিমতো কিংবদন্তী হয়ে আছে। ‘শোনো বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে, ফাগুনের গান গেয়ে’, ‘সুরের আকাশে তুমি ওগো শুকতারা’ অথবা ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস আজকে হলো সাথী’—গানের কথা আর সুর বাঙালির হৃদয়ে এখনো ঝঙ্কার তোলে। এই সিনেমায় শ্যামল মিত্রের গলায় একটা গান ছিল, ‘হারাই হারাই করিস নেরে/ হারাবি তোর কী বা আছে?’—বাংলা গানের তরঙ্গে ইতিহাস হয়ে আছে। শাপ মোচনে ৬০ বছর আগের কলকাতা শহরকে, শহরের নিষ্ঠুরতাকে তোলে ধরা হয়েছিলো। সেই থেকে উত্তম আর সুচিত্রার সঙ্গে দেখা, পরিচয়, আত্মীয়তা।
তারপর তো ভিসিপি-ভিসিআরের যুগ এলো। ক্যাসেটের ফিতায় ভরে ঘরে ঘরে চলে এলেন উত্তম-সুচিত্রাসহ আরও কত কী? বিগত শতাব্দীর আটের দশকে এই শহরে, বাংলাদেশের বাড়ির ছাদে, গাছের ডালে, ঘরের চালে বাঁশের মাথায় করে উঠে গেলো ঢাকনা। সেই ঢাকনাই এখন হয়েছে ডিশ, ক্যাবলে দুনিয়ারসব চ্যানেল দেখার ইতিহাস আরও পরে। তবে নয়ের দশকের শুরুতে আমরা ভিসিআর আর ভিসিপিতে অনেক অনেক সিনেমা দেখার সঙ্গে উত্তম-সুচিত্রার একটা সিনেমা রেখেছি অনিবার্যভাবে। সাগরিকা, হারানো সুর আর সপ্তপদী যে কতবার, কতরকম করে দেখা হয়েছে, তার হিসাব রাখাই মুশকিল। এরপর আকাশ-সংস্কৃতির বিস্তারে, টেলিভিশনের প্রসারে ঘুরে-ফিরে উত্তম-সুচিত্রা হয়ে গেলেন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। উত্তম কুমারকে নিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অনন্য এক প্রতিভা, রায় পরিবারের ছেলে সত্যজিৎ রায় বানালেন ‘নায়ক’। এ সিনেমা অনেকবার দেখা হয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। তুলনা নয়, ধরা যাক হলিউডে ছিলেন গ্রেগরি পেগ। তার রোমান হলিডে যতবার দেখি ততবারই নতুন মনে হয়। অড্রে হেপবানের সঙ্গে গ্রেগরির সেই সিনেমা, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে। সেই ছবিতে গ্রেগরি পেগের অভিনয় স্টাইল এখনো জগত মাতায়। তেমনি বাঙালি স্টাইলিশ মানুষটির নাম উত্তম কুমার।
কথা সুচিত্রা আর উত্তম
পর্দায় তো উত্তম-সুচিত্রার ক্যামিস্ট্রি তুলনাহীন। ব্যক্তিত্বময় নায়ক উত্তম আর ঘাড় বাঁকানো নায়িকার সুচিত্রার বোঝাপড়ার দৃশ্যগুলো বাঙালি দর্শকের মনের পর্দায় চিরস্থায়ী একটা সুখের চিত্র হয়ে আছে! সেই থেকে বাঙালি জানতে চায়, পর্দার বাইরে কেমন ছিল এ দুজনের বোঝাপড়াটা? সে নিয়ে কত লেখা, কত গবেষণা! উত্তম কুমারের মতো বহুমুখী চরিত্রে অভিনয় করেননি সুচিত্রা সেন। মূলত রোমান্টিক চরিত্রেই তাঁকে পাওয়া গেছে বেশি। ২৯টি ছবিতে সুচিত্রা সেন হয়েছেন উত্তম কুমারের নায়িকা। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে অভিনয় করেই বাংলা সিনেমার সর্বকালের সেরা জুটির সমীহ অর্জন করে নিয়েছেন এ দুজন! এতটাই সফল জুটি যে আজও ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানের দৃশ্যায়ন বাংলা সিনেমার সেরা রোমান্টিক দৃশ্য হিসেবে স্বীকৃত।
পশ্চিম বাংলার কলকতার বসুশ্রী সিনেমা হলের মালিক মন্টু বসুর কথায়, এই জুটির হাত ধরেই অগ্রিম টিকিট কাটার চল শুরু হয়। আমরা তিনদিনের অগ্রিম টিকিট দিতাম। তাতেও দর্শকদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতাম। আর আজও এই জুটি নিয়ে উন্মাদনা এতটুকুও কমেনি।
এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া জুটি সম্পর্কে উত্তম কুমার নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘সুচিত্রা সেন না থাকলে উত্তম কুমারের জন্মই হতো না।’ ‘সপ্তপদী’ ছবিতে রিনা ব্রাউন চরিত্রে সুচিত্রা ছাড়া আর কারও কথাই মাথায় আসছিল না পরিচালক অজয় কর ও সহ-প্রযোজক উত্তম কুমারের। উত্তম নিজেই ফোন করেন সুচিত্রা সেনকে। সুচিত্রাও যেন উত্তমের এই ফোনটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। তাই ফোন পেয়ে রিনা ব্রাউন চরিত্রে এক কথাতেই রাজী হয়ে যান সুচিত্রা সেন। চিত্রনাট্যও পড়ে দেখতে চাননি। এমনি ছিল তাদের বোঝাপড়ার ক্যামিস্ট্রি। তাইতো উত্তম-সুচিত্রার পর্দার বাইরের জীবন নিয়ে আজও বাঙালির আগ্রহের শেষ নেই। এখনো কৌতূহলভরা প্রশ্ন, সুচিত্রা সেন কি উত্তম কুমারকে ভালোবাসতেন? দুজনের মনের মধ্যে কখনোই কি ভালোবাসার মেঘ ঘর তৈরি করেনি? ভালোবাসার শ্রাবণধারা ঝরেনি? সুচিত্রার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে একবার উত্তম কুমার বলেছিলেন, ‘রমার সঙ্গে একটা ইমোশনাল এটাচমেন্ট তো আমার চিরকালই আছে।’আর সুচিত্রা সেন বলেছিলেন, ‘উত্তমের ওপর নানা ব্যাপারে আমি নির্ভর করি।’সে নির্ভরতা অবশ্য সুচিত্রার ওপরও উত্তমের নেহাৎ কম ছিল না।
তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে সুচিত্রার অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সাংবাদিক গোপাল কৃষ্ণ রায় তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘২৯টি ছবি করার পর একে অন্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি হওয়াটা তো খুবই স্বাভাবিক। উত্তমকে সুচিত্র উতু বলে ডাকতো। ওদের মধ্যে প্রায়শই গভীর রাত অব্দি ফোনালাপ চলতো। একদিন তো দেখলাম উত্তমকে সুচিত্রা ফোনেই কিস করে বসলো। তবে এটাও ঠিক উত্তম যখন বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন, তখন কিন্তু সুচিত্রার বাড়ি যাননি। গিয়েছিলেন সুপ্রিয়ার বাড়ি। তবে একটা কথা রমা প্রায়ই বলতো, আমি সারাজীবন অনেকের সঙ্গেই কাজ করেছি কিন্তু উত্তমের মতো নায়ক আর একটিও পেলাম না।’
অনিবার্য এক মানুষ, এক নায়ক
আমি বলি এবং এটা মানি যে, কোনো বাঙালি ছেলে যদি উত্তম কুমারের হাত ধরে বড় হয়, তখন তার নষ্ট এবং ভ্রষ্ট হওয়ার কোনো ভয় থাকে না। উত্তম অভিনয় জানতেন, গান জানতেন। সময়ের সেরা সন্তান ছিলেন তিনি। নারীকে কিভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়, উত্তম কুমারের অভিনয় না দেখলে নতুন বাঙালি বুঝবে কী করে! শিখবে কী করে! আর বেদনাকে কিভাবে হজম করতে হয়, ব্যক্তিগত বেদনা, ট্রাজেডি কিভাবে আড়াল করতে হয়, লুকোতে হয়, তা শিখতে হলে তার কাছেই যেতে হয় আমাদের। সত্যজিতের নায়ক সিনেমার শেষ দৃশ্যটায় নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর চলে যাচ্ছেন। একটু আগেও ট্রেনের ভেতর কত কথা হয়েছে দুজনের। আর একটু পরেই দুজনের চিরতরের ছাড়াছাড়ি, আর কোনোদিন দেখা হবে না। নায়কের বুকের তলে গভীর বেদনা, হাহাকার শূন্যতার জন্ম হয়। কিন্তু নায়িকাকে বুঝতে দেন না তার একবিন্দুও। উত্তম কুমার কতবড় পর্দামানব, কতবড় অভিনেতা, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন নায়কের শেষ দৃশ্যে।
আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই বার বার ছুটে যেতে হবে তার কাছে। তার জন্য আমাদের চিরকালের শ্রদ্ধা।