চিন্তার স্বাধীনতার সঙ্গে এর শৃঙ্খলার বিষয়টিও সম্পৃক্ত। কিন্তু অধিকাংশ চিন্তকই বিষয়টি মনে রাখতে চান না। তাঁরা যতটা জোর দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি তোলেন, তার তিলার্ধও শৃঙ্খলার কথা স্বীকার করেন না। হয়তো বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ভাবতে চান না। হয়তো এ কারণেই তারা কোনো একটি বিশেষ বিষয় মনে উদয় হওয়ামাত্রই তা প্রকাশে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। প্রকাশ-উত্তর সমাজে এর কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে, সে বিবেচনা করেন না।
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সমাজের ব্যক্তির মর্যাদা নির্ণীত হয় প্রধানত অর্থের মানদণ্ডে, দ্বিতীয়ত ক্ষমতার জোরে। কী গ্রাম কী শহরে—কোথাও এ নিয়মের ব্যত্যয় নেই। সর্বত্রই একই রীতি। যিনি যত ধনবান, তিনি তত মর্যাদার অধিকারী। যদিও নীতিবাগীশরা প্রচার করে গেছেন—‘ধনার্জনের চেয়ে জ্ঞানার্জন শ্রেয়’। আদতে জ্ঞানার্জনের মূল্য বর্তমান সমাজ কেন, অতীতেও কোনো সমাজে ছিল না। অর্থের বিনিময়ে যেমন বিদ্যালাভ সম্ভব ছিল, তেমনি ক্ষমতার মসনদণ্ড মিলতো বাণিজ্যিকচুক্তিতে।
মানবপ্রবৃত্তি, সুখের উপকরণ ও সুখ-ভোগের কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে বাট্রান্ড রাসেল ভেবেছেন অন্য দার্শনিকদের চেয়ে বেশি। একইসঙ্গে এ সবের উপায় ও সুখ-দুঃখের কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়েও ছিল তাঁর নিজস্ব দর্শন। যদিও এ সব দর্শন-মতবাদে তিনি প্রাণিত পূর্ববর্তী দার্শনিক-লেখকদের রচনা পড়ে। দর্শনচর্চা মৌলিক সাহিত্যচর্চার মতো নিরঙ্কুশ ব্যক্তির নিজস্ব চর্চা নয়—পূর্ববর্তী বহু দার্শনিক-মনীষীর চিন্তার স্রোত এসে বর্তমান দার্শনিককে আলোড়িত করে। তাঁর চিন্তাকেও উস্কে দেয়। আর তখনই উপস্থিতকালের দার্শনিকও নতুন চিন্তার রেখা দেখা পান। শুরু করেন, নিজের চিন্তারও একটি দিকচিহ্ন।
শেষপর্যন্ত পরিমিতি বোধই মানুষকে সুখী করে তুলতে পারে। তার জন্য তাকে কিছু কাজ করতে হবে, আর কিছু কাজ ত্যাগ করতে হবে।
রাসেল সুখ-ভোগের বিষয়টিকে কেবল মানসিক প্রপঞ্চ মনে করেননি। তিনি একে ধরে নিয়েছেন, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-নৈতিক-ধর্মীয়-শারীরিক উপযোগিতার ভিত্তিতেই। আর সুখভোগের পেছনে কী কী অন্তরায় রয়েছে, কী কী সহায়ক পথ-পাথেয় রয়েছে, রাসেল তা আলোচনা করে দেখিয়েছেন মানবজাতিকে। একটি জিনিস পরিষ্কার সুখ-দুঃখ মানবজীবনের কোনো চূড়ান্ত-অনিবার্য সত্য নয়। কারণ, সুখ কিংবা দুঃখ—কোনোটাই মানবজীবনে অনন্তকালের জন্য সত্য নয়। একটি আরেকটির ওপর যেমন নির্ভরশীল, তেমনি মানুষের গ্রহণবর্জন ও মানিয়ে নেওয়ার ওপরও নির্ভরশীল। এর জন্য চাই—ব্যক্তির নিজের ভেতরে বোধ সৃষ্টি করা। অর্থাৎ সুখ হোক বা দুঃখ হোক, দুটির বোধ আগে মনে সৃষ্টি হতে হবে। না হলে সুখ-দুঃখের তারতম্য, গুরুত্ব, কোনোটাই ব্যক্তি বুঝতে পারবে না। সর্বদা তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করবে। কোথাও মনকে স্থির করতে না পারলে সুখভোগের সহস্র উপকরণ থাকলেও সে সুখী হবে না। এজন্য আরও একটি বড় শর্ত রয়েছে, তা হলো আবেগ-আকাঙ্ক্ষা-আচরণের পরিমিতি। অর্থাৎ শেষপর্যন্ত পরিমিতি বোধই মানুষকে সুখী করে তুলতে পারে। তার জন্য তাকে কিছু কাজ করতে হবে, আর কিছু কাজ ত্যাগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যক্তিকে আত্মকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করে, সামষ্টিককেন্দ্রিক চিন্তায় মগ্ন হতে হবে—আত্মমগ্নতার পরিবর্তে আত্মত্যাগের সাধনা করতে হবে। তবে এ সাধনা বৈরাগ্যের নয়, সংসারীর।
শিক্ষা মানুষ সুখী-রুচিশীল হয়ে গড়ে ওঠার পথ দেখাবে। কিন্তু শিক্ষাকে যদি অর্থ উপার্জনের সনদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে অর্থ উপার্জন হয়তো হবে, কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। মানুষও সুখী হতে পারবে না। অথচ অধিকাংশ মানুষই শিক্ষা চাকরিলাভের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে মানুষের শিক্ষাজীবন থেকেই প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়। রাসেল মনে করেন, প্রতিযোগিতার ওপর জোর দেওয়ার ফলে আধুনিককালেও জীবনমান অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। দিন দিন নর-নারীর সূক্ষ্ম মানসিক উপভোগের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আর মানুষ অর্থ উপার্জনের একেকটা যন্ত্রে পর্যবসিত হচ্ছে। তার আবেগ, অনুভূতি কমে যাচ্ছে। এর ফলে পরিবার-সমাজের লোকগুলোর প্রতি তার আন্তরিকতা দেখা মেলে না। যেটুকু সম্পর্ক থাকে, তার পুরোটায় মেকি, পোশাকি। রাসেলের মতে, কাজ করতে হবে কাজেরই আনন্দে, কাউকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। সুস্থ মানুষ তাই করে; অসুস্থ মানুসের জন্যই প্রতিযোগিতার দরকার হয়। রাসেলের মতে, কোনো কাজ নয়, বরং কাজের বোধই আমাদের সুখ দেয়, দুঃখ দেয়। অহেতুক চিন্তায় ভারাক্রান্ত করে। আমাদের সুখী হতে হলে, মনের ভেতর সুখের উপকরণ সাজিয়ে সুখের জগত সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সুখ। না হলে জীবন এক অনন্ত দুঃখের প্রপঞ্চ মনে হবে।
একারণে চিন্তাবিদকে মনে রাখতে হয়—চিন্তাবিদের টিকে থাকার ওপর নির্ভর করছে তাঁর তত্ত্ব-সত্য প্রচারের ইস্যুটি। ফলে তাঁর চিন্তা-কল্পনার মধ্যে যেমন শৃঙ্খলা থাকবে, তেমনি থাকবে সামাজিক বাস্তবতার আলোকে যুক্তিও।
রাসেল থেকে দীর্ঘ প্রসঙ্গ টানার কারণ একটিই—মানুষের সুখ উপলব্ধির সঙ্গে তার সামাজিক মর্যাদার বিষয়টিও সম্পৃক্ত। সামাজিক মর্যাদাভোগী ব্যক্তি সাধারণ সুখী। কিন্তু যিনি মর্যাদা পান না কোথাও, তার মনে সুখও থাকে না। সুখী হতে হলে, সামাজিক মর্যাদা পেতে চাইলে মানুষকে সবার আগে তার চিন্তার শৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে হবে। এর আগে গুরুত্ব দিতে হবে, এর কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর। তাকে বুঝতে হবে, তার চিন্তার শৃঙ্খলার ওপর নির্ভর করছে তার সামাজিক মর্যাদা। তবে, সেই চিন্তা নয়, যে চিন্তা মানবসমাজে এখনো অপ্রকাশিত। সেই চিন্তা, যা সমাজে প্রচারিত এবং এর প্রভাব অন্তত সমাজের একটি বিশেষ অংশের ওপর পড়েছে।
চিন্তক যদি তাঁর চিন্তারাশি প্রকাশের সময় বলেন, অর্থই সকল অনর্থের মূল, তাহলে সমাজের একশ্রেণীর মানুষের হাততালি পেতে পারেন। কিন্তু সমাজব্যবস্থাকে যে সংখ্যালঘু বিত্তশালী নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের কৃপাণদৃষ্টি তাঁর ওপর নিশ্চতরূপেই নিপতিত হবে। চিন্তককে মনে রাখতে হবে, অর্থ লাভের পথকে তিরস্কার করা যত সহজ, অস্বীকার করা তত সহজ নয়, বাস্তবসম্মত তো নয়ই। বিত্তের নিন্দা করে পরশ্রীকাতররাই।এছাড়া কারও অর্থ উপার্জনের পথটি বৈধ না অবৈধ সে বিষয়ে অনুসন্ধানসর্বস্ব প্রতিবেদন হাজির করা চিন্তকের কাজ নয়। তাঁর কাজ হলো—অর্থ উপার্জন যেন ন্যায়-ন্যায্যতার ভিত্তিতে হয়, সে সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা। বিত্তশালীরা অর্জিত অর্থ কোন পথে ব্যয় করছেন, সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে পড়া চিন্তকশ্রেণীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। বরং ওই অর্থ সামাজিক কল্যাণে কিভাবে ব্যয়িত হতে পারে, সে বিষয়ে বিত্তশালীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা। একজন প্রাজ্ঞ-বিচক্ষণ সমাজচিন্তকের উচিত হবে না—উপযাচক হয়ে কোনো বিত্তশালীকে পাপপুণ্য সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া। তাঁকে মনে রাখতে হবে—সম্পদ যার করায়ত্ত, জ্ঞান তার পদতলে লুটোপুটি খাবে। নির্বোধরা কখনো প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হতে পারে না। বিত্তশালী হওয়ার জন্য যে পরিমাণ বুদ্ধি, পরিশ্রম ও উত্তরাধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য দরকার হয়, নির্বোধদের পক্ষে তা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়।
প্রাজ্ঞ সমাজচিন্তক কখনো আকস্মিক-বৈপ্লবিক চিন্তা সমাজে সংক্রমিত করেন না। তাঁকে গভীরভাবে ভাবতে হয়, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি সম্পর্কে। সমাজ পরিবর্তনের প্রয়োজন হলেও, তিনি সে সম্পর্কে সরাসরি কিছুই বলেন না। তবে, উপস্থিতকাল, পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে অতীতের মঙ্গলজনক পরিবেশ-পরিস্থিতির তুলনা করে সমাজের বিত্তশালী ও সমাজপতিদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। বিষয়টি নিয়ে তখন পুনঃপুনঃ আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর তখনই সমাজের তরুণশ্রেণী বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হয়। তরুণদের পরিবর্তনশীল মনোভাব আঁচ করতে পেরেই ধনিক-সমাজপতিরা সামাজিক পরিবর্তনের দিকে ধীরধীর অগ্রসর হতে থাকেন। তবেই সমাজের পরিবর্তন সাধিত হয়। চিন্তাবিদদদের রাতারাতি থিওরিতে সমাজের পরিবর্তন সাধিত হয় না, বরং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিশেষত প্রচলিত রীতির সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো তত্ত্ব বা সমাজপতিদের স্বর্থহানির মতো কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হলে।
একারণে চিন্তাবিদকে মনে রাখতে হয়—চিন্তাবিদের টিকে থাকার ওপর নির্ভর করছে তাঁর তত্ত্ব-সত্য প্রচারের ইস্যুটি। ফলে তাঁর চিন্তা-কল্পনার মধ্যে যেমন শৃঙ্খলা থাকবে, তেমনি থাকবে সামাজিক বাস্তবতার আলোকে যুক্তিও। তবেই সমাজে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি যা চাইবেন, কালক্রমে ধীরেধীরে তাও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকবে।