ভলতেয়ার বলেছেন, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি।’ কথাটি অনেক সরল হলেও আধুনিক সভ্যতার ভিত এই বাক্যটির ওপরই মজবুতভাবে দাঁড়াতে পারে। যুগে যুগে, দেশে দেশে মানুষ ভিন্নমত প্রকাশের জন্য জীবন দিয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে। আবার অনেককে মত প্রকাশের অধিকারের জন্য পথে নেমে প্রাণ দিতে হয়েছে। লেখক কী করেন? তিনি মূলত তার মত প্রকাশ করেন। তাই বলে যখন যে কথা যেভাবে মনে আসে, সেভাবেই লিখা উচিত? এছাড়া লেখক তার লেখা কোনো সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশ করবেন কি না, এটিও বড় প্রশ্ন।
লেখকের কাছে একটি ভাবনা, একটি চিন্তা, একটি মত অনেকটা অস্ফুট কলির মতো। সেটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি যতটা সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে, ফুল ততটাই বেশি সৌরভ ছড়াবে। তাই একটি ভাবনা লেখকের মনের মাঝে লেখার উদ্দীপক হয়ে জন্ম নিলে সেটিকে সেভাবেই প্রকাশ করা বা লখো উচিত নয়। সেটিকে লালন করতে হয়, শিল্পের রসে জারিত করতে হয়।
তাই একজন লেখকের শিল্পবোধ যতটা উন্নত, ভাব প্রকাশের কৌশল যতটা মৌলিক, সে লখেকও তত বড়। প্রতিটি মহৎ সাহিত্য একাধিক সম্পাদনার মধ্য দিয়ে গেছে। ল্যেভ টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসটি লিখতে দশ বছর সময় লেগেছিল। তার ছেলেদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, উপন্যাসটি তিনি অনেকবার সম্পাদনা করেছনে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি চার বার সম্পাদনা করা হয়েছে। আর টিএস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর বর্তমান রূপের পেছনে এজরা পাউন্ডের সম্পাদনা ও পরিশ্রমের কথা তো বহুলশ্রুত।
তারপরও বলব, একজন সাহিত্যিক যখন লেখালেখিকে জীবনের অংশ করে নেয় তখন তাকে এই ঝুঁকি নিতেই হবে। এটাই তার নিয়তি। তবে সমাজ যত উদার হয় ঝুঁকিটা লেখকের জন্য ততটা কম হয়।
উন্নত বিশ্বে প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থার একটি শক্তিশালী সম্পাদনা পরিষদ থাকে। সব খ্যাতিমান লেখকের পাণ্ডুলিপিকে সেই সম্পাদনা পরিষদের তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও কাটা-ছেঁড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের দেশের প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা খুবই নাজুক। অধিকাংশ প্রকাশনার সম্পাদনা পরিষদ নেই। বইগুলো সম্পাদনা ছাড়াই বের হয় বলে বইজুড়ে থাকে ভুল বাক্য আর ভুল বানানের ছড়াছড়ি। এর দায় শুধু লেখকের ওপর বর্তাবে না, প্রকাশককেও নিতে হবে। এটি জাতির মনন ও বুদ্ধিচর্চার বেহাল দশাকেই তুলে ধরে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতাটা সত্যি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লেখককে তার মত প্রকাশের জন্য যুগে যুগে অত্যাচারিত হতে হয়েছে। বরিস পাস্তারনাক ‘ডাক্টর জিভাগো’ উপন্যাস লেখার অপরাধে স্বজাতির কাছে কম লাঞ্ছিত হননি। ১৯৫৮ সালে বরিস পাস্তারনাক নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। কিন্তু সোভিয়েত সরকারের চাপে তিনি পুরস্কারটি বর্জন করতে বাধ্য হন।
নজরুল তার ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬)-এ প্রকাশিত ধূমকেতুর পথ রচনায় ব্রিটিশ সরকারবিরোধী মত প্রকাশ করলে তাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, তাকে জেলেও যেতে হয়েছে। সরাসরি মত প্রকাশ করতে না পারায় অনেক সাহিত্যিক যুগে যুগে রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। জোনাথন সুইফটের ‘গ্যালিভার’স ট্রাভেলস’ তেমনই একটি রচনা। আমাদের দেশে লেখকের মত প্রকাশের সুযোগ খুবই সীমিত। এ দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা একেবারে থমকে গেছে। বিগত কয়েক বছরে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে অনেকে হত্যা ও হুমকির শিকার হয়েছেন। কিছু দিন আগে ‘বিষফোঁড়া’ নামে একটি উপন্যাস নিষিদ্ধ হয়েছে। ফলে মত প্রকাশ এখনো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও বলব, একজন সাহিত্যিক যখন লেখালেখিকে জীবনের অংশ করে নেয় তখন তাকে এই ঝুঁকি নিতেই হবে। এটাই তার নিয়তি। তবে সমাজ যত উদার হয় ঝুঁকিটা লেখকের জন্য ততটা কম হয়।