‘দায়’ শব্দটি নিয়ে প্রায়ই ক’জন কবির সঙ্গে আমার তর্ক হয়। শব্দটি নিয়ে কারও কারও এলার্জি আছে। গতকাল তো একজন বলেই বসলেন, ‘এই বয়সে দায় শব্দটি আমি নিতে পারবো না। যায় না আমার সাথে।’ মারাত্বক প্রতিক্রিয়া দেখান তিনি। বিষয়টি ছিল প্রেম প্রশ্নে খানিকটা আবেগগত নার্সিং বিষয়ে। যেভাবে তিনি রিঅ্যাক্ট করলেন, তাতে মনে হলো, যেন শব্দটি বুঝি দোষবাচক। অথচ এটি এমন এক পজেটিভ শব্দ, যার প্রাধন অর্থই হলো ‘দান’ বা ‘অর্পণ’।
আমি অনেক সম্পর্ক বিষয়ে জানি, যেখানে দায় নেই, দায়বোধ নেই। যারা দায় ছাড়া সম্পর্ক তৈরি করতে চান, তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তারা সুবিধাটুকু নিয়ে নিশ্চিন্তে পথ চলতে চান। হাতধোয়া টাইপ এসব মানুষে সন্তান জন্ম দিয়ে পিতৃত্বের দায় স্বীকার করতে চায় না। অর্থাৎ দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। তখন সন্তানের দায়িত্ব নেন মা, সে দায় হয় দোষবাচক। নিগ্রহ তার নিত্যসঙ্গী। অথচ সম্পর্কটি ছিল পারস্পরিক!
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার ঘটনায় আজ একদল ফেসবুকার সরকারকে দায়ী করছে। তার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, কতটুকুই বা দায়িত্ব আমরা পালন করেছি অর্থাৎ দায় নিয়েছি?
একলাখ টাকা লাশের দাম দিয়ে হয়তো সরকার দায় এড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তার আগে বলুন, একজন সচেতন নাগরিকের কোন দায়িত্বটা আপনি-আমি পালন করেছি? নিজের জীবনকে আমরাই তো মূল্য দেই না, সরকার কী করবে? একদিনও কি কোনো মিডিয়া কিংবা কোনো সংবাদকর্মী কিংবা কোনো সমাজসেবক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন? বলেননি। জীবন না গেলে আমরা কোনো একটি ঘটনাকে ঘটনাই মনে করি না। এটি নিছক যদি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতো, তা হলে আমরা দায় সারতাম এই বলে যে, ‘আল্লাহ, বাঁচাইছে’।
আরও পড়ুন: প্রতিশোধ ও পরাজয় ॥ মুস্তাইন সুজাত
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, জীবন দিয়ে অর্জন করতে হয় সবকিছু। এই যে পত্রিকায় বের হলো মাছ-মাংসে ক্রোমিয়াম মিলছে। তবু কি আমরা প্রত্যাখ্যান করছি এই সব খাদ্য। চাপ সৃষ্টি করে তো আমরাই পারতাম অনেক কিছু করতে? আমার পরিবার বাদ দিয়েছে মুরগি খাওয়া। সবাই এটা করলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঝুঁকির মধ্যে পড়তো। কিন্তু সবাই মিলে তা করবে না। ঘরে ঘরে ক্যান্সার না ছড়ালে কারও হুঁশ হবে না।
কিন্তু কেন আমরা মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করি কোনো শুভ সিদ্ধান্তের জন্য? কারণটা কী? কিসের প্রভাবে আমাদের মস্তিষ্কের সেলগুলো এ রকম আচরণ করছে? কেউকি ব্যাখ্যা দেবেন সততার সঙ্গে? দেবেন না। দায় এড়িয়ে যাবেন। এভাবে এড়াতে এড়াতে দেখবেন একদিন আপনার জীবনের দায়, ভালোবাসার দায়, প্রতারণার দায় কেউ নেবে না।
এ সমাজে একুশে পদক পাওয়া কতিপয় তারকা জাতির কথা না ভেবে দেদার পকেট গরম করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হচ্ছে দেশবিদ্বেষী লোকজনকে। তার মানে হলো, তার দায় নেই এদেশের প্রতি। আর আমরা এই মানুষগুলোকে মুকুট পরাচ্ছি। আমাদের আদর্শ বলে তাদেরই মেনে নিচ্ছি।
আবার প্রশ্ন, কেন আমদের মস্তিষ্ক বিমাতাসুলভ আচরণ করছে, আত্মঘাতী আচরণ করছে? এর উত্তর বের করতে পারলেই নিরাময়ের পথে হাঁটতে পারবো আমরা। নচেৎ কোনো লাভ নেই। দায় নিতে শিখলেই দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন তৈরি হয়। আর দায়িত্বশীল মানুষ দাতার আসন লাভ করেন হয়ে ওঠেন দানবীর।