গদ্য আগে, না পদ্য?
‘পুনশ্চ’ নামে রবীন্দ্রনাথের অনন্য এক কবিতার বই আছে, আপনারা জানেন। অন্ত্যমিল এড়িয়ে, ছন্দ ঠিক রেখে, ইংরেজি কবিতার করণকৌশলের অনুসরণে কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল। ওখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, আমার কাছে তা পুরোপুরি ঠিক বলে মনে হয়নি। তাঁর মত অনুসরণ করে আরও অনেকেই বলে থাকেন কথাটা, যতবার শুনি আমার মন বিদ্রোহ করে ততবারই। কথাটা আমার কাছে অসম্পূর্ণ, একপেশে, অসমাপ্ত মনে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ওখানে বলেছেন, পদ্যের জন্ম আগে। গদ্য এসেছে আরও অনেক পর। এ কথাটার বিরোধিতাই আমি করছি।
শব্দ হলেন আদি। গদ্য ও পদ্য দুটোই শব্দের দালান। যে দালানে ভাব অবয়ব নিয়ে বাস করেন। মানুষ কখন এমন দালান গড়তে শিখেছে? নিঃসন্দেহে শব্দকে বর্ণের মালায় গাঁথারও আগে। শব্দকে কথার মালায় গাঁথা হচ্ছে যখন, তখন। আর এ পথেই, অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানে রূপান্তরিত করে, পরে জ্ঞানকে প্রজ্ঞায় রূপ দেওয়ার ধারাবাহিকতায়, কাজটা মানুষ বংশ পরম্পরায় এগিয়ে নিয়ে গেছে।
গুহার মুখ আটকে আগুনকে ঘিরে বসে থেকে দেয়ালে বিচিত্র চিত্র এঁকে এঁকে শিশুদের বিস্মিত মুখের সামনে প্রাজ্ঞরা কী উচ্চারণ করেছেন, কী বলছেন? আমি দিব্য কানে শুনতে পাই, ওরা গল্প বলছেন। বর্ণমালার ভিত যখন চিত্রে চিত্রে তৈরি হচ্ছে, তখনকার কথা এটা।
বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সুরের যোগ আদিম। জীবের তৈরি করা বা গাওয়া সঙ্গীত মানুষের হাতে এসে সবচেয়ে বিকশিত হলো, বলা যায়। এই বলাটা কি মানুষের অহঙ্কার হলো? না, এটা বাস্তবতার বিবরণ।
অবশ্য এ বিবরণ এক ধরনের সাপেক্ষ। মানুষ সব জীবের তোলা সুর সৃষ্টি করতে পারে। ওগুলোর সম্মিলনে সৃষ্টি করতে পারে নতুন নতুন সুর। এই হলো অহঙ্কার না করা অহঙ্কারের মাপকাঠি।
আদিম গুহামানবী তার আদরের সন্তানকে কোলে তুলে দিচ্ছে দোল। গুহার মুখে পাথরের অবরোধ। ওপাশে নেকড়ের দল পায়চারী করছে। এর মধ্যে শিশুকে অভয় দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন মা। একটু আগের শব্দকথা কি সুর হয়ে বেরোলো ওই মুহূর্তে? সুর হয়ে বেরোলো কি আদিম কবিতা তখন?
গদ্য আর পদ্যের জন্ম এক প্রহর আগে পরে। এবং আমার স্বজ্ঞা বলছে, গদ্যের প্রহরটি পদ্যের প্রহরের চেয়ে এগিয়ে।
গদ্য যে এগোলো, ওটা বর্ণমালা বিকশিত হওয়ার আগের কথা। পৃথিবীর সমতাবিধানের ইতিহাস বলছে, পরের ধাপে পিছিয়ে থেকে, গদ্য এই এগিয়ে থাকাটা সমীকৃত করে দেবে। হলোও তাই। বর্ণমালা পাওয়ার পর ভাবের সুরললিত প্রকাশটুকু মানুষ তাই পদ্যে করল।
শিল্প তার অগণিত পথে নিজেকে প্রকাশ করে। শিল্পটা হয়ে ওঠার ব্যাপার। এই হয়ে ওঠার বিচারে যদি এগোনো যায়, তাহলে কার জন্ম আগে ওই হিসেবের নিকেশ করা আরও জটিল হয়ে পড়বে। হয়ে যে উঠেছে এই বিচার কে করেছে, এ রায় কে দিয়েছে, এটিও হয়ে দাঁড়াবে প্রশ্ন।
২.
সবার ওপরে শব্দ সত্য।
এসব ভাবতে ভাবতে পাঠক সমাবেশের পাঠকক্ষ থেকে বেরিয়ে পূর্ব দিকে, শাহবাগ মোড়ের দিকে হাঁটছি।
এই স্থানে, এই কালে, বই দেখার আর পড়ার এই জায়গাটা বড় দরকার ছিল। বিকালে এখানে এসে সবার আগে যে বইটা হাতে নিয়েছি, ওটা পার্ল এস বাকের গুড আর্থ। অতিবিখ্যাত এই বই আমার হাতে আসেনি এর আগে। পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে জানি, চীনের কৃষকজীবনের ওপর লেখা এই অনবদ্য আখ্যান।
গুন্টার গ্রাস যখন ঢাকায়, সৈয়দ হকদের সঙ্গে এক আড্ডায় বলেছিলেন, কোনো ভূখণ্ড নিয়ে উপন্যাস লিখতে হলে ওখানে জন্ম নিতে হয়। পার্ল মার্কিন দেশে জন্ম নিয়েছেন। যখন পাঁচ মাসের ছোট শিশুটি, তখন আসেন চীনে। যখন আঠারো-উনিশের কিশোরী, তখন একাডেমিক পড়াশোনার মূল পাঠসূত্রে আবার ফিরে যান স্বদেশে। বছর চারেক পর পড়াশোনা শেষ করে চীনে দ্বিতীয়বার পদার্পণ। এরপর কাটে একটানা দুটি দশক।
‘গুড আর্থ’ লেখা হয়েছে পার্লের চল্লিশ বছর বয়সে। দেখা যাচ্ছে, জীবনের প্রায় পাঁচটি বছর বাদে বাকি পঁয়ত্রিশ বছরে চীনের সঙ্গে সংশ্রব তার প্রায় অবিচ্ছিন্ন। বেড়ে ওঠার মূল যে অংশ এবং ওই অংশ থেকে নেওয়া জীবনের যেটুকু পাঠ, ওটুকু তার চীনে, অস্বীকারের উপায় নেই। এর অর্থ, গুন্টার গ্রাসের কথা একটুখানি নড়ে গিয়েও টিকে যায়। এরপরও কথা থাকে। বুদ্ধিমত্তার ফুলফল নিয়ে অব্যর্থ কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। শব্দ, শিল্পসহ যা কিছু বুদ্ধিমত্তার ফুল, এর সবকটির ক্ষেত্রে এ কথা খাটে।
অনেকক্ষণ হলো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছিল। পূর্ব দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, শাহবাগ যখন এসেছি, এই রহস্যময় আলোর নিচে, মানুষের সমাবেশে দাঁড়িয়ে সিগারেট একটা ফুঁকে যাবই।
শাহবাড়ের মোড়ে পৌঁছে সিগারেট ধরালাম। খুব সুন্দর লাগছিল চারপাশ। সুবেশি নরনারী। রিকশার টুংটাং। আড্ডার আবহ চারপাশে। সড়কদ্বীপের ওপর বসার জায়গা করা হয়েছে। ওখানে গিয়ে বসলাম। পাশে এসে বসলেন খালেদ ভাই, কবি খালেদ রাহী। কথায় কথায় জানলাম, ফেনীর এক আদর্শ স্কুলের দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষককে চড় দিয়ে চাকরি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে এসেছেন ঢাকায়। শুনে বললাম, ‘জয় হোক!’
‘কারও অধীনে কাজ করা সম্ভব নয় আমার’, বললেন তিনি। ‘তাই বহুদিন হলো এভাবেই আছি, কিছু করছি না। বাড়ি থেকে টাকা পাঠায়, তাই দিয়ে চলছি। দেখি, একটা কোনো ব্যবসা করবো। টুকটাক কিছু কাজ জানি আমি।’
বললাম, ‘কবিকে সব কাজ মানায় না। কবি আর কবি থাকে না, এমন কোনো কাজ যেন করবেন না। বুকের ভেতর ওই আগুন জ্বালান খালেদ ভাই।’
‘কী করব। বাঁচতে তো হবে।’
‘বাঁচলে লিখে বাঁচুন। মরলে লিখেই মরুননা! এই তো সুযোগ।’
খালেদ রাহী হাসলেন। আমি ভেতরে নিজেকে বললাম, খোকা, নিজে নাহয় এমন ভেবেছ, এটাকেই নির্দিষ্ট করেছ নিজের জন্য। মানুষকে কেন প্ররোচিত করছ? আমারই আরেক সত্তা উত্তর দিলো, প্ররোচিত তো আমিও হয়েছিলাম। অন্য সময়ে অন্য মহাদেশের এক উন্মনা তরুণ যেদিন নিজের ভেতর এক গোপন আগুন টের পেয়ে, সব দায় উপেক্ষা করে আইন পড়া বাদ দিয়ে শহরে চলে গেলো, সাংবাদিকতায় নেমে পড়লো, সেদিনই আরেক সময়ের আরেক মহাদেশের একটি ছেলের ভাগ্যও নির্দেশিত হয়ে গেল। কেউ জানলো না। উন্মনা সেই তরুণের নাম গাবো। তো দেখো, এই আমি তো প্ররোচিত হয়েছি। এই প্ররোচনা আমি নিজেই নিয়েছি।
ওই মন তখন বলে, ‘যারা প্রাণ খামচে ধরে নিজেই পারে নিতে, তারাই আসে আসুক না।’
এ মন বলে, ‘শোনো, যদি বলো কুন, তবেই হবে ফায়াকুন। আগে ‘হও’ শুনিয়ে দাও, দেখবে হয়ে যাবে।
শব্দ করতে থাকো। সারাক্ষণ শব্দ হানতে থাকো। তোমার নিজস্ব শব্দ। ধার করা নয়। হানতে থাকো। দলে যাদের ভেড়াতে চাও, তোমার যারা আদর্শিক বন্ধু, তাদের ওপর। এবং যাদের হঠাতে চাও, যারা তোমার আদর্শিক শত্রু, তাদের ওপরও। কী বুঝলে?