মনের গতির নাগাল নেই। এরসঙ্গে তাল মেলানোও কঠিন। মন যত দ্রুত ভ্রমণ করে, কোনো যানবাহনই তা পারে না। ধরতে পারেনি সেই গতি। এটা আরও স্পষ্ট হয়, বাড়ি ফেরার পথে। পথ শেষ হওয়ার অনেক আগেই মন পৌঁছে যায় বাড়ি। মনের ওপর তাই অস্থিরতা জাঁকিয়ে বসে। দেশে, দেশের বাইরে—যেখানেই হোক বাড়ি ফিরতে মন একই গতিতে ছোটে। রাশ টানতে তার লাগাম খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে এক্ষেত্রে গতি ও গতিহীনতার দুই উদাহরণই রয়েছে। প্রথমে গতিহীনতার কথাই বলি। আমাদের গতি কমিয়ে দিয়েছে, জট। পথের মাঝে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকার কষ্ট, মোটামুটি জানা। সময় বলে যে মূল্যবান অদৃশ্য বস্তুটি রয়েছে, তার এমন অপচয় চোখ ভিজিয়ে দেয়। সঙ্গে বাড়িয়ে দেয় অস্থিরতাও। স্বল্প দূরত্বের পথ দুইটি পা যত দ্রুত পৌঁছে দিতে পারে, অনেক গতির বাহনও তা পারে না। সে অসহায় আটকে থাকে। নড়তে-চড়তে পারে না। নিজের অসহায়তার সঙ্গে ভেতরের মানুষগুলোর অসহায়তাও তখন বাড়িয়ে দেয়। প্রধান তিনটি নদী। তার একটি পদ্মা। এ নদী পার হতে এখনো জলযানের ওপরই নির্ভর করতে হয়। দূর থেকে ফেরার পথে, জলযানের অপেক্ষায় যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতীরে অপেক্ষা করতে হয়, তখন পদ্মার মোহনীয় রূপ কাছে টানে না। রূপবতী পদ্মাকেই তখন দুচোখের বিষ মনে হয়। পাখির ডানায় মেলে মন পাড়ি দেয় পদ্মা। কিন্তু দেহ পরে থাকে অন্যপাড়ে। গতির এই জড়ত্ব মানিয়ে নিতে পারে না মন।
পুত্র আমার সবে পাঁচে পড়েছে। রাজ্যের স্বপ্ন ও গল্প তার চোখে মুখে। রাজ্যের বিস্ময় তার ভুবনে। অসীম কৌতূহল আর ভালোবাসা তার দখলে। পদ্মা পাড়ি দেবার জন্য তীরে বসে—সেলফোনে তার আহ্বান—‘বাবা, আমার শরীরটা খুব খারাপ। তুমি কখন আসবে?’ পৃথিবীর সকল ঐশ্বর্য মাড়িয়ে, সকল সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে মন তখন পৌঁছে গেছে শয়নকক্ষে। পুত্রকে বুকের উষ্ণতার ভেতরে জড়িয়ে, তার ভয় তার শঙ্কাকে দূর করে—আস্তে আস্তে পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে দিতে উন্মুখ। মনের এই গতি, আহা—কী যে অসহ্য বেদনা হয়ে ডানা ভেঙে পড়ে। জলযানের ফেলে রাখা জলের রেখার ওপরে বসে গাঙচিল, খুঁজে ফিরছে খাবার। যেন ডুবে যাচ্ছে, যেন হারিয়ে যেতে চাইছে জলের অতলে। জলের সীমানা পেরিয়ে স্থলেও একইভাবে স্থবির হয়ে আছে যান। মন ছুটছে, কিন্তু যান তো নড়ছে না। সময় নামের অদৃশ্য বস্তুটাকে উপেক্ষা করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। যে দূরত্ব ষাট মিনিটের কম সময়ে চলে আসা যায়, তাই পেরুতে লেগে যায় ষাটের চার গুণিতক সময়। গতিহীনতায় মন বড় অস্থির হয়ে পড়ে। ছটফট করতে থাকে।
শুধু কি গতিহীনতা? গতিতেও তো একই অস্থিরতা ভর করে। মহাসড়ক ধরে ছুটে চলেছি। যমুনা পেরিয়ে গেছি। জন ও যানশূন্য পথ। বিপরীতমুখী যানও নেই তেমন। এই মোক্ষম সুযোগ। চালক বাড়িয়ে দিয়েছে গতি। যমুনা সেতুর পর থেকে চলনবিলের মাঝের পথ শুরুর পুরো অংশটাই ঝুঁকিপূর্ণ, দুর্ঘটনাপ্রবণ বলে পরিচিত। স্বাভাবিক গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ আশি কিলোমিটার। কিন্তু আমাদর গতি বাড়ছে। গতি নির্দেশক কাঁটা আশি পেরিয়ে নব্বই, নব্বই পেরিয়ে একশ ছুঁয়েও বেরিয়ে যাচ্ছে। চারদিক থেকে হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে সব। একটানা বেজে চলেছে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকের জনপ্রিয় হিন্দি গান— ‘এই মেরি হাম…ইতে যারা ইন্তেজার’। গতির সঙ্গে হাওয়া, হাওয়ার সঙ্গে গানের কথা হারিয়ে যাচ্ছে। মনের ভেতরে অস্থিরতা। গতি বাড়ছে, পুরো যানবাহনটি দুলছে, গো গো শব্দ করছে। আরোহীরা রাত্রির নির্জনতাকে সঙ্গী করে ঘুমে।
হঠাৎই মনে হয়, গাড়ি কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে, জানালার কাঁচগুলো খুলে পড়বে। পৃথিবীর সব হাওয়া হু হু করে যেন ঢুকে পড়বে। উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এক অশরীরী অস্বাভাবিকতা ছুয়ে দেয়। ধাতস্থ হতেও সময় লাগে। নির্ধারিত আসন ছেড়ে উঠে পড়ি। চালকের সহকারীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনেই চোখ পড়ে গতি নির্দেশক কাঁটায়। তা তখন ছাড়িয়ে গেছে একশ ত্রিশের ঘর। প্রতিবাদের মুখে কমে আসতে থাকে গতি।
গতিহীনতার পাশাপাশি গতির এই লড়াইয়ে মন ভয় পেয়েছিল। এই ভয় নিজেকে হারানোর না যতো তারচেয়ে বেশি ঘরে অপেক্ষা করা সন্তানকে না দেখার বেদনা। মাঝে আর কেউ নেই, শুধু পুত্র। কি অদ্ভুত। মা—আমার প্রিয় আশ্রয়। বাবা—আমার ভরসা। বোনেরা—ভালোবাসার সীমানা। স্ত্রী—নির্ভরতা। তবুও গতি এবং গতিহীনতার মাঝে এক বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমার পাঁচ বছরের সন্তান। সৃষ্টিকর্তার অপার বিস্ময়, জীবন অর্থবোধক হয়ে ওঠার পথে শ্রেষ্ঠ উপহার। আমি মুগ্ধ, আমি বিস্মিত, আমি অবাক এই অদ্ভুত সম্পর্কে। এর তুলনা নেই।
যদিও মাঝে মাঝে কষ্ট হয়—বড় হতে হতে গতি ও গতিহীনতার লড়াইয়ে যেমন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি আমার বাবার থেকে, তেমনি আমার সন্তানও ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকবে। যেমন করে অনন্ত আকাশে ছুটে যাচ্ছে নক্ষত্ররা।