এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত সাভারের ‘রানা প্লাজায়’আজ থেকে তিন বছর আগে যে গণখুনের ঘটনা ঘটেছে, তাকে কেন্দ্র করেই। বলাই বাহুল্য, এই ঘটনার শোকে মানুষ মাত্রই বিহ্বল হবেন। আমি শোককে আপাতত ছুটি দিতে চাই। যেখানে আমরা সচেতনভাবে, নিয়ম করে, শতমুখী প্রস্তুতি নিয়ে খুনের সব আয়োজন করে রেখেছি, সেখানে এ রকম ঘটনায় নিয়মিত শোক প্রকাশও কৌতুকে পরিণত হয়েছে। আমরা আর এই ধরনের কৌতুকে কান দিতে চাই না।
আলবেয়ার কামু তাঁর ‘দ্য রেবেল’ বইয়ের ভূমিকার শুরুতেই যেমন বলেন, এখানে অপরাধের জন্য অধ্যবসায় ও অপরাধের যুক্তি তৈরি হচ্ছে। এবং যারা এই ধরনের অপরাধের রাজত্ব তৈরিতে নিরলস কাজ করে চলেছেন এরা বেবুঝ নন। এরা খুবই পাকনা মানে দক্ষ। অপরাধ এবং অপরাধী যখন নিজেকে জাস্টিফাই করে, নানান যুক্তি তৈরি করে তখন এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। বিভ্রান্তির ভেতর নীরবে ক্ষয়ে যেতে থাকে প্রতিবাদের প্রবল প্রতিজ্ঞাও। তখন খুন ও অত্যাচারের সংস্কৃতিতে মানুষ অভ্যস্ত হতে থাকে। এটাই এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি। ফলে আমাদের এখানে প্রতিদিন যে সব রাজনৈতিক সংকটের বয়ান আমরা শুনি, তার কোনো বাস্তবিক উপযোগিতা নেই। কারণ নৈতিক সংকটের সরব বিস্তার নিয়ে আমাদের টেনশন এখনো দেখা যায় না।
ছয়তলার অনুমতি নিয়ে নয়তলা করার সব ফাঁকফোঁকর রেখে দেব! তারপর গণখুনের সামনে দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ করব! নানা দল ও সংগঠন আহাজারি করবে, শোক জানাবে। নেতারা সংবাদ সম্মেলন করবেন। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হবে। মধ্যবিত্ত প্রাণ শোকে কাতর হবে, মিডিয়ায় প্রকৌশলীদের হিড়িক পড়ে যাবে। তিনারা টেনিক্যাল ব্যাখ্যা দেবেন। ব্যাবহারবাদী, পারোকোয়াল বামপন্থী দলগুলা শ্রমিকদরদি কর্মসূচি দেবেন। মালিককে যথারিতি খুৎজে পাওয়া যাবে না ঘটনার পর থেকেই। এবং মালিক হবেন,স্বাভাবিক নিয়মেই ক্ষমতাসীনদের ঘরের লোক। সংসদ সদস্য তাকে পালাতে সহযোগিতা করবেন, ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডকে নিশ্চিতভাবেই কৌতুকের অংশ হিসেবেই ধরতে হবে।
অন্যদিকে, মিডিয়া স্বাভাবিক ভাবেই দুর্ঘটনা, বিপর্যয়, ট্র্যাজেডি বা ভয়াবহতা বোঝানোর মতো কোনো শব্দ ব্যবহার করবে। এর ফলে আমরাও ঘটনার হৃদয়বিদারকতা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় নেব। বেদনা কাটিয়ে উঠতে উঠতে আবার ঘটে যাবে আর একটা ‘ট্র্যাজেডি’। ফলে মিডিয়ার এ সব ভাষ্যের আড়ালে যে ব্যবস্থার কারণে এই রকম ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার ঠিকুজিও আমরা ধরতে পারব না। দেশ নির্বাচন, ক্ষমতা, জামায়ত, হেফাজত ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় কাতর হয়ে আমরা ভোট দিতে পারব কি না, সেই আশঙ্কা বা আশায় দিন পার করতে থাকব। বাড়তে থাকবে আমাদের উন্নয়ন অকাঙ্ক্ষা। গ্রামকে বানাব শহরমুখী। স্থাপনাই হবে উন্নয়নের নিদর্শন। এই যখন অবস্থা, তখন শহর মানেই খুনের রাজত্ব হতে বাধ্য। সেটা ঢাকা, সাভার বা ময়মনসিংহ যেখানেই তা করা হোক না কেন। এখন তো ভূমিকম্পের অতঙ্কের মধ্যে নাগরিকদের ঘুমাতে যেতে হয়। ঘুম থেকে উঠে আবার জীবনের দৌড়ে শামিল হতে হয়। এত ভোগাকাঙ্ক্ষায় সারাদিন আতঙ্কিত হওয়ারও সময় পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে ঝাঁকি দিলেই কেবল নিজেকে খুব অসহায় ফিল করেন নাগরিকরা।
যা হোক, এখানে কথা বলব রানা প্লাজা নিয়ে। অবশ্য এই লেখাটা রানা প্লাজা যে দিন ধসে পড়ে, তার কয়েক ঘণ্টা পরেই লিখিত। সেই লেখাই হুবহু তুলে দিচ্ছি।
এই সব গণখুনের ঘটনা আমাদের একটা ঐতিহ্যতে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজউকের হিসাবেই ভবন ধস ও হেলে পড়ার ৫০টি ঘটনার রেকর্ড আছে। ২০১০ সালে বেগুনবাড়িতে আব্বাসউদ্দিনের ৫ তলা বাড়ি পাশের একটি বস্তিতে হেলে পড়লে ২৫ জন মারা যান। ২০০৬ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স ভবন ধসে ২১ জনের মৃত্য হয়। ২০০৫ সালে ফেব্রিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর ৮ তলা ভবন ধসে ৬২ জন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্য ঘটে। গত নভেন্বরে তাজরীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুরে মারা যান ১১০ জন । হাতের কাছে পাওয়া এ সব তথ্য খুবই অপ্রতুল। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা অগণিত। নিহতের সংখ্যাও লুকানো হয়। এত এত হত্যার নিয়মিত মহড়া দেখে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। একে উপড়ে ফেলার কোনো লক্ষণ এখনো আমাদের সমাজে হাজির করতে পারিনি।
অন্যদিকে, রানা প্লাজার ঘটনাটা হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখতে হবে। আগে থেকেই ভবনটিতে ফাটল ছিল। কারখানা ছুটিও দেওয়া হয়েছিল। মালিক সোহেল রানা, সাভার থানার যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক বলেছেন, এমন ফাটল কোনো ব্যাপার না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গে বলেছেন, আগে থেকেই সেখান থেকে নাকি সব লোককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাহলে যে হাজারের ওপর মানুষের লাশ বের করা হলো, হাজার হাজার আহত মানুষ কাতরাচ্ছেন? তারা মানুষ নন? তারা কি প্রেতাত্মা?
ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় কাজে যোগ দিতে। বাধ্য করা হয় তাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে। এটা হত্যাকাণ্ড নয়? এর বিচার তো হতেই হবে। আরও যেটা জরুরি, তা হলো খুনি শহরে উন্নয়ন উম্মত্ততা রোধ করা। ছলে-বলে -কৌশলে ঘুষ, রাজনৈতিক প্রভাব, ইত্যাদি নানা প্রক্রিয়া আমরা যেভাবে মুনাফামুখী নীতির দাসে পরিণত হয়েছি, তাতে শহর হয়ে উঠছে মৃত্যুকুপ। গ্রামগুলোও ধুঁকছে উন্নয়নের অসুখের ভয়াবহ ভাইরাসে।
আমরা নিজেদের প্রজ্ঞার দিকে যদি মনযোগী না হই, তাহলে রানা প্লাজা ধসের মতো ঘটনা থেকে আমরা রক্ষা পাব না। আমাদের গোটা শহর এক দশকের মধ্যে ল্যান্ডব্যবসায়ীর আওতায় চলে গেল। তারা এর গালভরা নাম দিল ডেভলপার কোম্পানি। তারা কিসের ডেভেলপার। কী তারা ডেভেলপ করে? বিল্ডিং বানালেই ডেভেলপ করা হয়ে যায়। আর নয়া মধ্যবিত্ত ব্যাপকহারে ফ্ল্যাটের ক্রেতা হয়ে উন্নয়নের সৈনিকে পরিণত হলো? এই লাগাম ছাড়া ডেভেলপারের নীতিটা কী? আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতিকে তারা ড্রয়িং রুমে ডুকিয়ে দিল। ফলে অপরিকল্পিতভাবে ভবন ধসের ঘটনাকে দেখে আঁৎকে ওঠার কিছু নেই। ভয়াবহতা সামনে আরও বাকি আছে।
প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে, তা এখনো আমরা টের পাচ্ছি না। গোটা দেশের মানুষকে দিনদিন কঞ্জ্যুমার বানানো হচ্ছে। শ্রমিকদের সামনে মূলা ঝোলানো হচ্ছে প্রতিদিন। বাংলাদেশকে আমরা সবার জন্য বাসযোগ্য একটা রাষ্ট্র না বানিয়ে দেব তার জন্য কোনো সংগ্রামে সামিল না হয়ে?
মধ্যবিত্ত নিজেদের শ্রেণী ও সাংস্কৃতিক ঘৃণার আগুনে দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে প্রান্তের মানুষের জীবন,বিশ্বাস, ধর্মবোধ। আমাদের হুঁশ কবে হবে? যে দেশে বিশাল বিশাল ভবন তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়, সে দেশে কোনো ভবন ধসলে আমরা দেখি কী, হেচকো ব্লেড দিয়ে দেয়াল কেটে উদ্ধার কাজ চালানো হচ্ছে। দেয়ালের নিচে চাপা পড়া মানুষ পানি পানি বলে চিৎকার করতে করতে মারা যায়। ব্লেডের ধার শেষ হয়ে যায়। উদ্ধার করতে করতে লাশের গন্ধে এলাকায় টেকা দায় হয়ে যায়।
সাভারে লাশের স্তূপ ছিল। বিল্ডিংয়ের নিচে চাপা পড়েছিল অসংখ্য থেঁতলানো মানুষ। উদ্ধারকর্মীরা সব অসহায়তা নিয়ে তৎপর। হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে এসেছে। যে যেভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে।
ওই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের এখনো ক্ষতি পূরণের দাবি নিয়ে হৈচৈ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সেই দিনের ঘটনাটা একটু মনে করে দেখুন, গোটা শহরের পথে হাজার হাজার অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে। লাশ আনতে ছুটছে সাভারে। ফিরছে লাশ নিয়ে, ফিরছে আহত শ্রমিক নিয়ে। পথে ভয়াবহ জ্যাম। জীবন তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, গাড়ির চাকার সাথে বাঁধা পড়ে আছে জিবন। চাকা চলছে না, জীবনও থমকে আছে মৃত্যুর দুয়ারে। হুঁইসেলের আওয়াজ শহর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। গোটা শহর লাশময়। হাসপাতালগুলোয় আহত মানুষের গোঙ্গানোর শব্দ বাতাস ভারী করে তুলছে। শতশত তরুণ ছুটছে রক্ত দিতে। শহরজুড়ে লাশের গন্ধ। লাশের মিছিলে আমরা খাচ্ছি-দাচ্ছি, শহরে চলছে জীবন জীবিকার সংগ্রাম। এই আমার শহর, খুনি শহরে একটি প্রাণীও আজ নিরাপদ নয়।
কেন এমনটা হচ্ছে? নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা যাদের নেই, মানুষের জানের প্রতি বিন্দুমাত্র দরদ নেই, তারা বানায় এমন দানবীয় শহর। গড়ে তোলে বিশাল ভবন। সেই ভবন ধসে পড়ে জাতির জীবনে। এই খেলা আর চলতে পারে না। আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। সচেতন হবে প্রতিটি মানুষকে।