জীবনানন্দ দাশকে ‘নির্জনতম কবি’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশ নির্জনতম কবি কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু কালের গণ্ডি পেরিয়ে উত্তরকালের পাঠকের কাছেও জীবনানন্দ নির্জনতম কবি হিসেবেই পরিচিত। পাশাপাশি তার অমিশুক, শান্ত-শিষ্ট স্বভাব, লোকজনদের এড়িয়ে চলার কাহিনী নির্জনতম কবির অভিধাটি আরও গভীরভাবে গ্রোথিত করেছে পাঠকের কাছে। জীবনানন্দ নামটি মনে হলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে দীর্ঘ, নিস্তব্ধ, কালো দীঘির মতো একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি।
জীবনানন্দ—যিনি সকল তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে মেতে থাকতে পারেন জীবনের আনন্দে, সেই জীবনানন্দ দাশও অধ্যাপক কাম সমালোচকদের বাক্যবাণে (সমালোচনায়) অতিষ্ঠ হয়ে লিখেছিলেন, ‘সমারূঢ়’-এর মতো কবিতা। তবে মজার কথা হলো—অজর, অক্ষর চোখে অক্ষম পিঁচুটিওয়ালা অধ্যাপকদের নিয়ে কবিতা লিখলেও জীবনানন্দের পেশা ছিল সেই অধ্যাপনা-ই।
ষাটের দশকে প্রকাশিত বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজিন ‘কণ্ঠস্বর’ সম্পাদক আবদুল্লা আবু সায়ীদ লিটল ম্যাগটি যাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছিলেন, নবীন অধ্যাপকদের নামও ছিল সেই তালিকায়। অথচ আবদুল্লা আবু সায়ীদও তখন চাকরি করতেন একটি কলেজে। অর্থাৎ তিনিও সেই অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ সারা জীবন অধ্যাপনা করলেও অধ্যাপকদের তিনি ঠাট্টা করে অর্ধপোকা বলতেন। মান্নান সৈয়দের ডায়েরিতে আমার কথার সত্যতা পাবেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অধ্যাপকদের সমালোচনা করা অনেক কবি-সাহিত্যিকদের বৃত্তি ছিল অধ্যাপনা। যার সৃজনশীল রচনা কর্মের পাশাপাশি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন অসামান্য সব মননশীল সাহিত্য-কীর্তি।
খালেদ হোসাইন—কবি, প্রাবন্ধিক, পেশা অধ্যাপনা।তাহলে তিনি কোন গোত্রভুক্ত—‘সমারূঢ়’ যাদের কেন্দ্র করে রচনা করা হয়েছে, তাদের? নাকি ‘সমারূঢ়’ যিনি রচনা করেছেন, তাদের? অবশ্যই তিনি দ্বিতীয়দের দলভুক্ত। তার কবিতা পাঠের সময় বারবার তাই মনে হয়—সাহিত্যে অবশ্য কোনো নিক্তি নেই, যা দিয়ে পরিমাপ করে প্রমাণ পেশ করা যায়, কোনটি ঠিক, কোনটি ঠিক নয়। সাহিত্য হৃদয়েরই কারবার। হৃদয়ই এখানের হর্তাকর্তা। একমাত্র বিচারক।
খালেদ হোসাইনের প্রথম কাব্য ‘ইলা মিত্র ও অন্যান্য কবিতা’র উৎসর্গপত্রে লিপিবদ্ধ কবিতায় যখন চোখ পড়ে, ‘তুমি বিহীন এক বিকেলের/ দৈর্ঘ্য কত, প্রস্থ কত/ আমার মতো আর কে জানে/
আমার মতো আর কে জানে/ আমার মতো আর কে পাগল এই শতকে/ বলো তো আমায় কে অন্তঃপুরে দহন জ্বালা বহন করে?’ তখন কবিতার সঙ্গে হৃদয় সায় না দিয়ে পারে না, খালেদ হোসাইনের কবিত্ব শক্তিকে স্বীকার না করে উপায় থাকে না।
দুই.
একটি চিরায়ত প্রশ্ন—কবিতা কী? কিন্তু এই প্রশ্ন করলেই ঝাঁকে ঝাঁকে যে উত্তর আসতে থাকে, তার মধ্যে এত বেশি পরিমাণে মিশেল ফুকো, জাঁক দেরিদা, লাকা, চমস্কি, তত্ত্ব, তথ্য, ইজম, মতবাদ মেশানো থাকে যে, আমি আর প্রশ্নের উত্তর আলাদা করতে পারি না। সব আমার মাথা ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারি না। কারণ মূর্খ ততক্ষণই জ্ঞানী, যতক্ষণ না সে মুখ খোলে। অথবা বলা যায়, মূর্খ ততক্ষণ মূর্খ বলে প্রমাণিত হয় না, যতক্ষণ তার মুখ বন্ধ থাকে। তাই জ্ঞানী সাজার লোভে নয়, মূর্খ প্রমাণিত হওয়ার ভয়েই মুখ বন্ধ রাখি। জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না—আমাদের প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগের কবি-কবিয়ালরা এসব বস্তাভর্তি তথ্য কোথায় পেয়েছিলেন? চুপ থাকি। তবু মন প্রশ্ন না করতে নারাজ। সে আরও এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়, মানুষ কবিতা কেন লেখে? এ ক্ষেত্রে একটি গল্প মনে পড়ে গেলো।
‘এক উঁচু বৃক্ষের মগডালে লাল ঘুড়ি এসে পড়েছে। একটি ছেলে ঘুড়িটি নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টাতদ্বির করতে লাগলো। কিন্তু ঘুড়িটি এত উঁচুতে ছিল যে, কারও পক্ষে নাগাল পাওয়া ছিল বেশ কষ্টকর। বিপজ্জনকও বটে। কিন্তু ছেলেটির ওই লাল ঘুড়িটিই চাই। অথচ সে চাইলে পাশের দোকান থেকে তার পছন্দমতো ঘুড়ি কিনে নিতে পারে। তবু সে কিনবে না।’ এ হচ্ছে কবি মন। ‘কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায়।’—এ জন্যই কেউ কেউ অনেকের মধ্যে থেকেও নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হয়ে পড়েন। কেউ কেউ মনে করেন, সে অতটুকু চায়নি।
খালেদ হোসাইনের কবিতায় আমরা দেখি—
নদীর পারে রাঙা টালির ঘর
বাগানবিলাস লেপ্টে রবে গায়
আঙিনাতে ফুটবে নানা ফুল
আমি কিন্তু চাইনি এত সুখ।ঘরের ভেতর তিলোত্তমা নারী
দুধের মতো কোমল শয্যা পাতা
আদিগন্ত সুরের শিহরণ
আমি কিন্তু চাইনি এত সুখ।আমার চাওয়া পায়নি অবয়ব
আমি কিন্তু সব পেয়েছি সব
তবু আমার খাঁখাঁ করে বুক
আমি কিন্তু চাইনি এত সুখ।
(সুখ: ইলা মিত্র ও অন্যান্য কবিতা)
এই যে সব পেয়েও, না পাওয়ার অতৃপ্তি। হাহাকার। অস্থিরতা। এটা খালেদ হোসাইনের কবি মানসের একটি বড় অভিজ্ঞান চিহ্ন। এটা একজন মহৎ কবির বৈশিষ্ট্য। এই অস্থিরমতির কারণেই তারা কবিতার এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে ছুটে চলেন। আর তাই আমরা পাই নতুন নতুন কাব্য স্বাদ। কিন্তু এটা বলা আমার এখতিয়ার নেই। কারণ ছোট, বড়, মহৎ কবি নির্ণয় করার একচ্ছত্র অধিকার নামিদামি অধ্যাপকদের। তাই তাদের জন্যই বিষয়টি তোলা থাক। আমি শুধু আমার মুগ্ধতার কথা ব্যক্ত করি।
খালেদ হোসাইন তাই এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়, এক রূপকল্প থেকে অন্য রূপকল্পে ছুটে চলেন। তার ‘ইলা মিত্র ও অন্যান্য কবিতা’ও ‘শিকার-যাত্রার আয়োজন’ কাব্যের কবিতাগুলোর অবয়ব নাতিদীর্ঘ হলেও তৃতীয় কাব্য ‘জলছবির ক্যানভাস’ চারটি দীর্ঘ কবিতার সংকলন। আশ্চর্যের বিষয় তার চতুর্থ কাব্য ‘পাতাদের সংসার’৪৭টি চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন। শুধু তাই নয়, তার পঞ্চম কাব্য ‘পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পথ’টানা গদ্যে লেখা! অর্থাৎ খালেদ হোসাইন কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেননি। তিনি নটরাজের মতো নৃত্য করতে করতে শিখর হতে শিখরে ছুটে গেছেন। কেন ছুটে গেছেন? কবিতা ছুঁতে। স্বপ্নকে ধরতে। যদিও কবি জানেন—
কিন্তু তুমি দক্ষিণের দিগন্তকে ছোঁবে বলে পা বাড়িয়েছ।
তুমি জানতে না যে স্বপ্ন হল পুঞ্জীভূত মেঘ, বারবার
বদলে যেতে থাকে। অন্তহীন শেকলের মতো
(অস্ফুট বেদনার কোনো ডাকনাম নেই: শিকার-যাত্রার আয়োজন)
এই বদলে যাওয়া স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে নির্মাণ করেন তার নিজস্ব কাব্যভূমণ্ডল। এক কাব্যভূমণ্ডলকে বিশ্লেষণ করলে কী পাওয়া যাবে? কবি বিষ্ণু দে-র ভাষা ধার করে বলি, ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ।’ স্মৃতি হলো তার ফেলে আসা দিন, অতীত। সত্তা হলো তার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তার আগামী। কবি তার সত্তা দিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে ধারণ করে। তার ও তার সমকালের ধ্বনি বিশ্বস্ত লিপিকারের মতো লিখে রাখে।
হও অবহিত, হও অবহিত!
এখানে একদা বাতাস বহিত
সে-বাতাসে ছিল সুদূরের ঘ্রাণ—
বিম্বিত হতো খোলা আসমান—
কী করে সেসম হলো অপহৃত—
হও অবহিত, হও অবহিত!এখানে একদা জলে ছিল প্রাণ
শ্যাওলাতে ছিল খোলা আহ্বান
ঘোল জলে ছিল কিছু হুল্লোড়
ভাটার বিনয় জোয়ারের তোড়—
মাছ ও শামুক কী কথা কহিত
হও অবহিত, হও অবহিত!
(হও অবহিত, হও অবহিত: কাকে বলি অন্ধকার কাকে বলি আলো)তিন.
প্রকৃত কবিতা সম্পর্কে কিছু বলতে হয় না। কারণ কবিতা নিজেই নিজের সম্পর্কে বলে। তাই কবি খালেদ হোসাইনের কবিতায় কে বেশি জায়গায় নিয়ে আছে প্রেম, না রাজনীতি? এই রকম অধ্যাপকীয় বিশ্লেষণ ছেড়ে চলুন কিছু কবিতার পঙ্ক্তি পাঠ করি,ক.
তবু বর্ষা আসে আকাশ কালো করে,
সুগোল কদমের শিহরিত হবার সেই সুদূর স্মৃতি
আমাকে উন্মনা করে দেয় কোনো এক
অনন্ত দুপুরে।
(তবু বর্ষা আসবে আকাশ কালো করে: শিকার-যাত্রার আয়োজন)খ.
ঝরনার জল যেমন ভুলে যায়
অতিক্রান্ত পথের স্বাক্ষর
পাখি যেমন ভুলে যায়
ডানা থেকে খসে পড়া
রাতের শিশির
বাতাস যেমন দূরবর্তী প্রান্তরের
ঘ্রাণ, তেমনভাবে
তুমি কি ভুলে গেলে আমাকে?
(নিজস্ব ছায়ার নির্জনে: জলছবির ক্যানভাস)গ.
তবুও আমি জানি, আমাকে পায়নি কেউ—না মুঠোভর্তি জলের শিহরণ, না দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা রূপকথার আলো। আমিও পাইনি একচ্ছত্র কৃষ্ণচূড়ার পাশে অফুরন্ত জারুলের উত্থান আর তন্দ্রাতুর প্রান্তরের ঘনিষ্ঠ নিঃশ্বাস।
(মনে হয় ভেসে যাচ্ছি: পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পথ)ঘ.
দুধ পোড়া-ঘ্রাণে ছলকে-ওঠা নিঝুম দুপুর, তোমাকে মনে পড়ে।
অনুজ্জ্বল জলসাঘরে ঘুঁটে-কুড়ানো রাজকুমারী, তোমাকে মনে পড়ে।
শব্দহীন মোহনায় কম্পমান অড়হর—ঝোপ, তোমাকে মনে পড়ে।
জলতলের প্রেক্ষাগৃত, তোমাকে মনে পড়ে।
(কুষ্টিয়া: চিরকাল আমি এখানে ছিলাম)ঙ.
আমাদের অর্থমন্ত্রীরা বেহায়ার মতো হাসে
অনেক মানিক-রতন তাঁদের দাঁত পরিষ্কার করে
দিয়ে আসে। এমনকি শোনায় রবীন্দ্রসংগীত।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রূপচর্চা কেন্দ্রে যান
নিয়মিত। আর যোগাযোগমন্ত্রীর যোগাযোগ তো
বেশ ভালোই হবার কথা—হয়েছেও তাই।
তুমি আমার মাসতুতো ভাই—তুমি তবে বাণিজ্যমন্ত্রী
আর তুমি সত্য কথা বলো, তুমি ষড়যন্ত্রী।
ছিঁড়েই ফেলবো তোর স্বরতন্ত্রী।
(ভাবছি মুখোশ পরবো: কবির আছে ব্রত, তাকে বিব্রত করো না)চ.
কাকে বলি অন্ধকার
কাকে বলি আলো
অন্তত মরার আগে
জেনে নেয়া ভালো।কোন গাছে ফুল ফোটে
কোন ফুলে বিষ
কোন পাখি দূর থেকে
দিয়ে যায় শিসকোন পথ কই গিয়ে মেশে
কোন পথ যায় নিরুদ্দেশেকার বুকে ঘৃণা, কার
বুকে ভালোবাসা
ঘৃণাতেও জমে থাকে
কতটুকু আশা
প্রণয়েও জমে থাকে
কতটা তামস
জেনে নেয়া ভালো, কার
কতটা সাহস।
(কাকে বলি অন্ধাকার কাকে বলি আলো: কাকে বলি অন্ধকার কাকে বলি আলো)
মূল কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে উদ্ধৃত করায়, অনেক কবিতারই মূল সুর ভিন্ন হয়ে গেছে। তাতেও কী? কবিতা, হাজারটা অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায় বলেই তো সে কবিতা।
পাঠকের অভিজ্ঞতা যখন কোন কবিতার কোন পঙ্ক্তির সমর্থন পায়, তখন তা পাঠকের কাছে মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে। পথে ঘাটে চলতে ফিরতে, আড্ডায়, একাকিত্বে সেই উজ্জ্বল পঙ্ক্তি বেজে ওঠে পাঠকের মনে। কবি বুদ্ধদেব বসু একেই প্রকৃত কবিতা বলেছেন। খালেদ হোসাইনের কাব্যভূমণ্ডলে এমন অনেক কবিতা, পঙ্ক্তি আছে, যেখানে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, কারণে, অকারণে আশ্রয় নেওয়া যায়।