স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের আলোচ্য কবি খালেদ মাহবুব মোর্শেদ। তার কাব্যজীবনের ব্যাপ্তি ও পরিধি অনেক। আমি খালেদকে চিনি তার ছাত্রজীবন থেকেই। যদিও অ্যাকাডেমিক ও পেশাগত ভিন্নতাহেতু অন্য অনেকের মতোই খালেদের সঙ্গেও এক ধরনের ছাড়া-ছাড়া আড্ডার অভিজ্ঞতা আমার। যতদূর মনে পড়ে, খালেদকে প্রায় সময়ই কবি হাফিজ রশিদ খানের সঙ্গে নিবিড় আলাপরত দেখতাম। সবুজ হোটেলের আড্ডায় আমি তাকে একটা সময়ে বেশ নিয়মিত দেখেছি, বরং আমিই নানা কারণে অনিয়মিত থাকতাম।
সাগরপাড়ের ছেলে, টেরিকাটা চুলেও সাগর ঊর্মির চিত্রকল্প বিদ্যমান, চোখ দুটো দীপ্তিমান, কপালের কুঞ্চনরেখা বলে দেয় বেশ পড়ুয়া গোছের মানুষ। সম্ভবত আমার কবিতা প্রসঙ্গে প্রথম গদ্যটি খালেদই লিখেছিলেন। আমাকে বিস্মিত করেছিল ধর্মপালনের একটা বিশেষ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা ১৯৯৪ সালে রচিত কবিতা ‘দ্যুলোক’ নিয়ে এত চমৎকার বিশ্লেষণমূলক গদ্য খালেদের মতো তরুণ, যে কিনা ধর্মপালনে অতি-উদগ্রীব অঞ্চল থেকে আসা ছেলে, পছন্দ করছেন। তার মানসিক ঔদার্যের জমি অনেক প্রশস্ত, সেদিন টের পেয়েছিলাম।
সাগর পাড়ে নিত্য লেগে থাকা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে এই অঞ্চলের মানুষ এমনিতেই নিয়তিবাদী হয়ে পড়ে। কিন্তু খালেদের এই আলোচনা লেখা থেকে আমি সম্যক উপলব্ধি করি যে, উদার-চিত্তে পাঠ-গ্রহণ করলে মনের আঙিনা অনেক-অনেক বড় হয়ে গড়ে ওঠে। এসব বিগত শতকের নব্বই দশকের কোনো এক সময়ের গল্প। এর মধ্যে পেরিয়ে গিয়েছে কমপক্ষে দুই যুগ। আমি তো পঞ্চাশোত্তীর্ণ বটেই, খালেদও গুটি-গুটি পায়ে পঞ্চাশের কাছে প্রায় পৌঁছে গিয়েছেন। যতটুকু জানি, খালেদের চারটি কাব্যগ্রন্থ এর মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার সুবাদে, সাহিত্যের অ্যাকাডেমিক ব্যুৎপত্তি যে তার অনেক গভীর তার স্বাক্ষর বহন করে তার এই বই। কবিতায়ও অকপটে তৈরি হয়েছে চমৎকার নির্মাণ শৈলী ও ছন্দোবদ্ধ পারদর্শিতা।
সেদিক থেকে আমার কবিতার বই মাত্র তিনটি। এর থেকেই এটা সুস্পষ্ট যে খালেদ অন্তত আমার চেয়ে অনেক বেশি নিবিষ্ট একজন কবি। আর যে মানুষ আজীবন বঙ্গোপসাগরের উদ্ভিন্ন জলের কল্লোল আর আদিনাথ পাহাড়ের সৌকর্যের সুষমা পান করে দিনযাপন করেন, নিমগ্ন হয়ে থাকেন রাত্রিকালীন নিস্তব্ধতা ভাঙ্গা ঊর্মির ছন্দের দোলায়, তার কবিতা লেখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। তাই কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মানুষ স্বভাবের বশেই কবিতা লিখতে বসে। কিন্তু খালেদের কবিতা নিতান্তই স্বভাব-কবিতা নয়; নিরন্তর অধ্যবসায় ও অনুশীলনের প্রগাঢ় স্বাক্ষর তিনি রেখে যান তার প্রতিটি কবিতার বুননে।
খালেদের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দেশজুড়ে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে এবং নানারকম জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের পাতায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বাণে বিনীত কাঁটা’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে তার ২৭ বছর বয়সে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার সুবাদে, সাহিত্যের অ্যাকাডেমিক ব্যুৎপত্তি যে তার অনেক গভীর তার স্বাক্ষর বহন করে তার এই বই। কবিতায়ও অকপটে তৈরি হয়েছে চমৎকার নির্মাণ শৈলী ও ছন্দোবদ্ধ পারদর্শিতা। তার দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের শিরোনাম ‘আয়নাজোড়া অন্ধকার’ (২০০৩)। এই নামটি আমার ভীষণ প্রিয়। এই নামের মধ্যে রয়েছে বৈপরিত্যভিত্তিক এক ভিন্নতর দৃশ্যকল্প।
এই গ্রন্থে কবির দ্রোহ ও প্রেমের চরিত্র পাশাপাশিভাবে বেশ ফুটে উঠতে দেখি। তারপরও প্রকৃতির আদিম জঠরে বেড়ে ওঠা কবি কিছুতেই নিসর্গকে অতিক্রম করেন না, বা করতে চান না।
ও পাহাড়, ও বৃক্ষের হরিৎ সেপাই
স্বচ্ছতোয়া জলস্রোত ঠেলে
যাবে কতো দূর? তোমার শিথানে
সুনীল সাগর কাঁদে নোনা মহিমায়
জলসীমা বারবার ভেঙে গেছে
দস্যুর নিউশানা
পইথানে রেখে যাচ্ছো হিব্রু কূটচাল
চিম্বুকের শিরায় চূড়ায়ও পাহাড়, ও বৃক্ষের সাহসী সেপাই
দোহাই তোমার শোনো…সান্ধ্য ধূপগন্ধে বশীভূত হে মৌনতা
বাহারি বিজ্ঞাপনের লোলুপতা ছেড়ে
আমিও শিখতে চাই
মেঘ ছোঁয়া শূন্যতার শূন্য নান্দীপাঠ।
(অ-মূল্য আকুতি / আয়নাজোড়া অন্ধকার / পৃ ২৭ / ঋতবর্ণ প্রকাশন / ২০০৩)
এই চিত্র আমাদের সকলের চিরচেনা। আমরা যারা সাগর ও পাহাড়ের বাৎসল্যে বেড়ে উঠেছি, আমরা জানি এই সুনীল সাগরের কান্না কতোট প্লাবন ডেকে আনে। এই বিশালতার ভেতরেও থাকে এক মহাশূন্যতার হাহাকার। কবি সেই শূন্যতার নান্দীপাঠ নিতে চান। এই সমুদ্রমেখলা ভূমির সাথে মানুষের নান্দনিক সৌন্দর্যও সমান বিকশিত। কক্সবাজারে গেলেই আমরা সকলে জানতে পারি, সেখানে রয়েছে অনেক প্রিয়ংবদা রাখাইন সুন্দরী। কবির গভীর অন্তর্ভেদী চোখ সেই রাখাইন নারী মুরিম্যাকে ভুলতে পারেনি। ওদের রূপ-লাবণ্য অপেক্ষা কবি অনেক বেশি সচেতন তাদের জীবন-মান ও জীবন-যন্ত্রণা বিষয়ে।
রাখাইন তরুণী সে, বসে তাঁতকলে
মঙ্গল-প্রদীপ জ্বালাতে জানে না বলে
জীবনের দীপ জ্বালে এক;
শ্যামল দেহের ভাঁজে শ্রমকণা নোনা জলস্রোত
বিরহ প্রবাহে দোলে বিপ্রতীপ স্বপ্নসুধা ছায়া
(মুরিম্যার দূরাগত স্বর / আয়নাজোড়া অন্ধকার / পৃ ২৬ / ঋতবর্ণ প্রকাশন / ২০০৩)
খালেদের বৃক্ষপ্রেমও নিঃসন্দেহে উদাহরণ দেওয়ার মতো। মানুষ বৃক্ষ নিধন করে, মানুষ বৃক্ষে পেরেক ঠোকে, নিজেদের নাম খোদাই করে বৃক্ষের গায়ে। বৃক্ষদের কোনো ভাষা নেই; তাই তারা জানাতে পারে না তাদের বেদনার কথা।
দ্বিধার কারণ কবি প্রগতির যাত্রী, অথচ এখানে তার মন গুহাজীবনের দিকে আকৃষ্ট। পূঁজিবাদী সমাজের নানা বৈপরীত্য কবিকে গুহাজীবনের সাম্যবাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে বটে, কিন্তু সে চিন্তা পশ্চাৎপদতার নয়, বরং তাকে মাথায় রেখে সম্মুখের সাম্যের দিকে অগ্রসরতার ভাবনা।
নিঃশব্দে গুমরে গুমরে মরে মানুষের দুঃসহ নির্মমতায়। দয়াল বিধাতার কাছে তার অনুযোগ, তিনি কেন বৃক্ষদের কোনো ভাষা দিলেন না।
রাজা সুলেমানের দোহাই
রাণী বিলকিস আর হুদহুদ পাখির দোহাই
কেবল একদিনের মতো বৃক্ষদের ভাষা দাও দয়াল হে
(পেরেকবেঁধা বৃক্ষ / আয়নাজোড়া অন্ধকার / পৃ ৩০ / ঋতবর্ণ প্রকাশন / ২০০৩)
খালেদের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম সম্পন্ন সাম্পান (২০১২)। এক অসামান্য প্রস্তাবনা দিয়ে কবি এই বইটির সূচনা করেছেন। এই সাম্পান বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের জীবন জীবিকার দোসর। ভেনিসের যেমন গন্ডোলা, আমাদেরও তেমনি সাম্পান। এই সাম্পান নিয়ে লোকগানসহ নানা উপাখ্যান জড়িয়ে আছে এতদঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে।
সম্পন্ন সাম্পানে ভাসি আসিয়াছি আমি
প্রবল প্রপাত ফেলে আসিয়াছি নামি
তারকার নীচে জ্বলা নিয়তির হিম
মৃদুলয়ে বাতাসেরে ধরিয়েছে ঝিমশান্তির কান্তিকে চেয়ে বাঁধা খেলাঘর
প্রহর ফুরালে পরে পলায়নপর
গো-পালের ইতিহাস নিছক অতীত
তারোপরে পৃথিবীতে কতোবার নেমে এলো শীত
গ্রীষ্ম-বর্ষা, মহামারী, জাতিদ্বেষ-হানাহানি
রাষ্ট্রবিপ্লবের ধূয়া, রকমারি গীত
জানেন জীবনবাবু, আর আমি জানি
(প্রস্তাবনা / সম্পন্ন সাম্পান / ২০১২)
প্রস্তাবনা পাঠের পরেই সূচিপত্রের দিকে চোখ ফেরালে সহজেই অনুমান করে যায় যে, প্রায় ৯ বৎসর কাল সময়টা কবি নিয়েছেন আরো পরিপক্কতা অর্জনের জন্যে। তাই দেখি, অনেক গুছিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। এই গ্রন্থে কবিতাগুলো তিনটি পৃথক পর্বে বিন্যস্ত। মানচিত্রের মানচিত্রে অমনোতোষের মমি, মগজে মননে জমা গমনাগমনের ভূমি, এবং তাকে দেখতে দেখতে কাকে দেখি। এখানেও তিনি প্রকৃতিকে তাঁর নিজস্বতায় মূর্ত করেন।
চাঁদ জাগে, জল জাগে, রাত-দিন জাগে রূপচাঁদা
জেগেও জাগে না রোজ ভজনের সুজন-শা’জাদা
পেয়েছে আভাস তার মোহনার সারেঙ-কোম্পানি
(জলের জানালা / সম্পন্ন সাম্পান / ২০১২)
আবার গুহাগৃহে গুরুগান কবিতায় কবির ইতিহাস চেতনা, এবং আদিম সাম্যবাদী সমাজের কিংবা গুহামানব জীবনের শিকারের মাংস ভাগ করে খাওয়া, এমনকি অজন্তা ইলোরার শিল্পকর্মের প্রতিও দুর্বার আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। তাই তিনি এই কবিতায় কালের কল্লোল খোলেন দ্বিধা ও সন্দেহে। দ্বিধার কারণ কবি প্রগতির যাত্রী, অথচ এখানে তার মন গুহাজীবনের দিকে আকৃষ্ট। পূঁজিবাদী সমাজের নানা বৈপরীত্য কবিকে গুহাজীবনের সাম্যবাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে বটে, কিন্তু সে চিন্তা পশ্চাৎপদতার নয়, বরং তাকে মাথায় রেখে সম্মুখের সাম্যের দিকে অগ্রসরতার ভাবনা। কিন্তু কবির দ্বিধা ও সন্দেহ সমকালের পাঠক তা অনুধাবন করতে পারছে কিনা।
গুহায় ছিলাম ভালো
উৎসবের দুরন্ত উচ্ছ্বাসে
শিকারের কাঁচা মাংসে কৌম ভোজন
উল্লাসের ঐক্মত্যে ভেঙ্গেছি ধনুক
অগ্নি কুণ্ডলের পাশে জেগে সারারাত
নিঃশংক প্রহরী
শত্রুপক্ষ ফিরে গেছে ব্যর্থ মনোরথ;
অজন্তা ও ইলোরায় তুলির আঁচড় আর
পাথর-ছেনীর গানে
তীক্ষ্ণবোধ
বুঁদ হয়ে এঁকেছি কখনও
পেশিবাজ ভগিনির পাণি গ্রহণে ছিলো না কোনো জোরালো ওজর।গুহায় ছিলাম ভালো
গুহা ছেড়ে আজ গৃহে গৃহে গুহাবাসী
গৃহ থেকে ঘরে ঢুকে কোণে কোণে খুঁজি কার মুখ!
কাঠামোর কড়িকাঠে কাদাখোঁচা পাখি
পুরাণের পৃষ্ঠা ফুঁড়ে বরাবরই বেরিয়ে এসেছি
(গুহাগৃহে গুরুগান / সম্পন্ন সাম্পান /২০১২)
এই গ্রন্থের এক পর্যায়ে এসে খালেদ মাহবুব মোর্শেদ কাব্যিক আবহের মধ্যেই উত্তীর্ণ দার্শনিকতায় উপনীত হন। মূলত প্রকৃতি প্রেমিক উপাস্যের সন্ধান অপেক্ষা জল-হাওয়া, তৃষ্ণা-ঘুম, কিংবা বাসি গোলাপের ঝরা পাপড়িতেও অনেক বেশি গুরুত্ব খুঁজে পান বিমুর্ত ইলাহ’র চেয়ে। করুণাময়ের বর-দানে প্রাপ্য জান্নাতের কোমল গালিচা কবিকে টানে না। এম্নকি সন্ত্রস্ত করে না জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের অভিশাপ। বরং তিনি নিজেকে নিয়ে খেলেন পার্থিব আলোর খেলা। রুমি’র সুফিবাদী দর্শনের বিপরীতে এ এক অনন্য বস্তুবাদী এবং বাস্তবতার দর্শন। অতএব, কবির কোনো ইলাহ নেই, নিজেকেই ক্রমশ ইলাহ রূপে ভাঙেন গড়েন; এবং পুনরায় ভেঙে ফেলেন অভীষ্ট শিল্পের সবল তৃষ্ণায়।
আমার পৃথক কোনো ইলাহ নেই
নিজেকে ক্রমশ ইলাহরূপ বর্ধিত সজীব কলেবরে গড়ি
মাটিহীন মৃত্তিকার মূর্তি বসাই হৃদমন্দিরে সুনিবিড়
… … …
পার্বত্য ঝোরার পাড়ে নেচে ওঠে অখণ্ড সুন্দর
মেঘেরা আনত ঢঙ্গে পর্বতের অর্ঘ্য দিয়ে যায়আমাকে টানে না কোনো ইলাহের বিমূরত বাহির,
এরচে’ বিদেশ-বিভুঁ’য়ের জল–হাওয়া তৃষ্ণা-ঘুম
বাসি গোলাপের ঝরা পাওড়িও বেশি মূল্য ধরে।
(ইলাহের খোঁজে / সম্পন্ন সাম্পান / ২০১২)
খালেদ মাহবুব মোর্শেদের চতুর্থ এবং এ যাবৎ সর্বশেষ কবিতার বই ‘মহাপ্লাবনের পলি’ (২০১৬)। এই বইটিতে আমরা কবিকে আরো পরিণত এবং জীবন ও দর্শনের মেলবন্ধনে একটা সার্বিকতায় নিবিষ্ট দেখতে পাই। বইয়ের নামেও তার আভাস রয়েছে। আমরা নূহের মহাপ্লাবনের কাহিনী সম্পর্কে অবগত আছি। এর হয়তো রয়েছে ঐতিহাসিক ভিত্তি; কিন্তু মানুষের মুখে মুখে এর কথা জন্ম জন্মান্তরে ভেসে এসেছে মিথের অববাহিকায়।
প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়ি-ঘর, আসবাব, হাঁস-মুরগী, গবাদি, ফসলের মাঠ; বুকের ভেতরে আগলে রাখা শিশু থেকে যুবক-বৃদ্ধ পর্যন্ত খড়কুটোর মতো ভেসে যায়
আমরা মিথের গল্পে কিংবা পরবর্তীতে ধর্মগ্রন্থে গ্রথিত হবার সূত্রে মহাপ্লাবনের অভিশাপের গল্প পাই, নোয়া বা নূহের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রজাতির বেঁচে যাওয়ার তথ্য পাই। কিন্তু আমরা এসব থেকে জানতে পারি না যে, প্লাবন সে হোক না মহাপ্লাবন, একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। সমুদ্রবক্ষে এমন শত সহস্র ঘুর্ণির জন্মলাভ ঘটে, যার ফলে ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস-প্লাবন-মহাপ্লাবন ইত্যাদির উদ্ভব ঘটে।
প্লাবন মানেই ভেসে যাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া, সংসার, ঘর দোর, ঘটিবাটি স্মৃতি-স্বপ্ন-প্রেম সবকিছু মুহূর্তের স্রোতে ভেসে যায়, তলিয়ে যায় মহাকালের অতলে। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন কি, এই প্লাবনের পরে প্রকৃতি কী মোহনীয় হয়ে ওঠে? চারপাশের ধ্বংসের স্তুপের মধ্যে নতুন করে গজিয়ে ওঠে সতেজ সবুজ; ফসলের মাঠ ভরে যায় নতুন পলিতে। এই মহাপ্লাবনের পলি আমাদের আবার নতুন করে ভরিয়ে দেয় সবুজে, সুষমায়। তাই সাগরপাড়ের ছেলে খালেদ মাহবুব মোর্শেদ, যিনি ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও মহাপ্লাবনের ভেতর দিয়ে নতুন নূহের মতো বেড়ে ওঠেন তার অসামান্য দীর্ঘ কবিতায়।
যখন জোয়ার মানে কূলপ্লাবী ঢেউ
ভূকম্পের অবিকলে কেঁপেছে অধর
অথচ অষ্ঠের স্পর্শ থেকে বহু দূরে বয়ে গেছে
যুবাধারা জলধির নিরন্তর খোঁজ
যখন আলিঙ্গনের আকাংক্ষায় আকুতি ছড়িয়ে
বর্ষাস্নাত রাতপাখি ওই নদে ডুবিয়েছে পাখা
তখনোতো নোনাস্রোতে আমি এক অনভিজ্ঞ মাঝি
বুঝিনি হাওয়ার হানা, মোচড়ের গতিবিধি, ঘূর্ণির আঘাত
(জাতিস্মর / মহগাপ্লাবনের পলি / তৃতীয় চোখ / ২০১৬)
আমরা যারা ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সাগরতীরে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে দেখেছিলাম হাওয়ার মোচড়, তারা কিছুতেই ভুলতে পারবো না, এই ভয়ঙ্কর রাত্রির কথা। সেদিন সত্যিই আমরা প্রস্তুত ছিলাম না এমন হাওয়ার হাহাকারের জন্যে, জলের প্রমত্ত কাতরতার জন্যে। প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়ি-ঘর, আসবাব, হাঁস-মুরগী, গবাদি, ফসলের মাঠ; বুকের ভেতরে আগলে রাখা শিশু থেকে যুবক-বৃদ্ধ পর্যন্ত খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। তারপরে যারা জীবনকে ফিরে পায়, তাদের নবজন্মের অনুভূতি হয়, মনে হয় যেন মহাপ্রলয়ের শেষে পুনরুত্থানের দিনে তারা আবার উঠেছে দাঁড়িয়ে:
বহু তন্দ্রা বহু ঘুম বহু অনিদ্রার মহাজাগরণ শেষে
বিক্ষোভের ক্লান্তি মেশে পুনরুত্থানের ক্ষমাময় ময়দানে
এখন পলক ফেলে হাল বুঝি, পাল বুঝি, চিনি রঙ্গিলা বাদাম
অংকের পালংকে শুয়ে পংকহীন হয়েছি নিজেই
দুহাতের বেষ্টনিতে ধরা আবেগের বেগে পৃথিবী জেনেছে
এই অধরোষ্ঠে জমা রয়েছে রসালো দক্ষতার মধুরেণু
এতে অভিসিক্ত যারা, বলে, ‘পরিপক্কতায় তুমি তুলনারহিত প্রিয়
জীবধারা মহাস্রোতে ভেসে যাই
ভেসে যেতে থাকি দিশাহীন
দিকহীন-দ্বিধাহীন
কূলহীন-ঠাঁইহীন
জীবন এমনই বয় নিয়মের অনিয়মে অনিউন্দিত সদাই স্বাধীন
এখানে সময় নেই অসময়ও নেই…
(জাতিস্মর / মহাপ্লাবনের পলি / ২০১৬)
এইভাবে জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে দার্শনিকতায় উত্তীর্ণ হয় কবির জীবনবোধ। দীর্ঘ কবিতার পরিসরের কারণে কবিতা বৃহত্তর ক্যানভাসে মহাজীবনের চেতনা থেকে সমকালীন রাজনৈতিকতা ও মানুষের অধিকারের সংগ্রাম পর্যন্ত অবলীলায় বিস্তার লাভ করতে থাকে অভিজ্ঞ কবির সুদক্ষ মেধার আঁচড়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছুকাল খালেদ স্নায়ুজটিলতার রোগে আক্রান্ত। দীর্ঘদিন হাসপাতালের বিছানায় অচেতন অর্ধচেতন রাত্রিযাপন করতে হয়েছে। এখন তিনি অনেকটা সেরে উঠেছেন বলে জানি। তাঁর পূর্ণ সুস্থতা এবং দীর্ঘ সৃজনশীল জীবন কামনা করি, যেন তার হৃদিপটে নিরন্তর স্বজনের মুখ বুনে যেতে পারেন:
এই হৃদিপটে
স্বজনের মুখ বুনি আনন্দের তাপে
পানের পাতায়
এই হৃদিপটে
সন্তানের স্বপ্ন পুষি প্রগাঢ় উত্তাপে
সুরস্রষ্টা গানের খাতায়
এই মনঘাটে
ফোটে রোজ স্বতঃস্ফূর্ত অরণ্যের সাবলীল অধিকারনামা
(জাতিস্মর / মহাপ্লাবনের পলি / ২০১৬)