গাছেরাই এখন আর প্রকৃতির নিয়ম মানতে পারে না। কাকে কখন কিভাবে বড় হতে হয়, পাতা খসাতে হয়, ফুল ফোটাতে হয় বুঝে উঠতে পারে না। কেউ আর স্বাধীন সত্তার স্বাদে লালিত হয় না। আমাদের নাগরিক উপনিবেশ তাদের অস্থি জুড়ে বিপরীত স্রোতের কামড় দিচ্ছে। এলোমেলো হচ্ছে ঋতুমাস।
আমাদের মনও যেভাবে বিকারগ্রস্ত তাতে নির্বাণের অশত্থ মরে যাচ্ছে দ্রুত। সমস্ত রকম বিচ্ছিন্নতা, ধ্বংসের ভেতর আমাদের ইন্দ্রিয়ের ভেতর জেগে থাকা অল্প পরিমাণ কিয়ের্কেগার্দ বছর বছর দস্তয়ভস্কিকে খুঁজতে যায় গরমের ছুটি, ঈদুল ফিতর, পূজা, ক্রিসমাসে। আমার কোথাও যাওয়া নেই। আমার ঋতুকে শরীরেই উপভোগ করার নেশা খুব। বহু প্রাচীন দেশীয় কবিদের রক্তে প্রথম ধরা পড়েছিল এ নেশা। চণ্ডীদাসের অভিসারে গেলে বৃষ্টি যে কেন ঝমঝমিয়ে নামে!
যক্ষ ভাবার্থ লেখার জন্য এত উত্তর-দক্ষিণ মেঘ যে কী করে পেলো! জাতকের চোখ যে কী করে দেখলো এত দূর অতীতে বুদ্ধ নবজাতককে! এক প্রকৃতি হয় গাছপালা, পরিবেশ আর এক প্রকৃতি হলো নিয়ম। এই দুইকে ভালো রাখার জন্য আদম-ইভের আগে নিউটনের জন্মানো উচিত ছিল। অন্তত, জ্ঞানবৃক্ষের ফলটা মাটিতে পড়তে দিতো। খেয়েই যত গোলমাল। যাই হোক, ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমারও ইচ্ছে করে পাখনার পালক হতে।
সিজনাল রোগের মতো প্রথমটায় ভেবেছি নিজেকে। এরপর বুঝলাম এই আমি ভেতরকার আমি জন্ম আগেও জন্ম পরেও। এরপর শত অন্ধকার অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে দেখেছি সমস্ত অসুখের ভেতর একটা বেহুলার ভেলা ভেসে যায়। আমাদের যে চির আকাঙ্ক্ষার বস্তু–বসন্ত, তাকে ছুঁয়ে দেখার আগেই ওঁৎ পাতে প্রখর গ্রীষ্ম। ফর্সা রাতকে নিয়ে আমার কোনো দাবি নেই। রাতের উজ্জ্বল তারা তাই মিলিয়ে যাক ধীরে। বুকের ভেতরের নদীটাকে বোঝাবো ভেলা ভেসে গেছে ফিরে আসবে। আজ আমায় নেয়নি, কাল নেবে। আমি পালক না হয়ে তখন বরং কোজাগরী হই। বসন্তকে নিয়ে লিখতে চাইছি কিন্তু এত নিরাসক্ত যে প্রেম ও ফুলকে বাদ দিয়ে জ্ঞান ফলাচ্ছি। বোঝাতে পারছি না যে, আমি বসন্ত বলব বসন্ত লিখব। হে পাঠক! আমি বসন্তের সৈনিক, বাসন্তিক আমার হাবভাব। এই আমিই কদিন পর সাদা কিংবা হলুদ পাঞ্জাবি পড়বো, রঙ খেলব, সেলফি নেবো, বিভিন্নভাবে পোজ দেবো, কবি কবি ভাব খাবো।
পলাশের কথা বলা ভারী দরকার। ওই নামে এখন আমার ভাই ও ফুল দুইই ক্যাম্পাসে আছে। আমি ফুলের কথাই বলবো।
ভার্চুয়াল কবিদের এখন অনেকেই আর সইতে পারছে না। অনেকের ঘর ভেঙেছে এই কবিদের জন্যে। এদের রসে টুইটুম্বুর দু-চারখানা কোয়ান স্বর্ণ গোধিকার মতো প্রকট হয়ে থাকে তারপর অবোধ নিরীহ তপোবনের শ্রমিকদের কমলে কামিনী দেখিয়ে চলে যায় স্রোতে। সবাই অমন নয়। আমারই কি সবটা মন পাষণ্ড! আমার মধ্যে কুসুম প্রেমও আছে। শুধু তুমি ছিটমহল বলে আমি তোমার সবটুকু দেখা পাইনি। তোমার দোষ নাই। আমার খুব ইচ্ছে রঙিন ছবি, ধারকরা ক্যাপশনে প্রচুর বান্ধবী হৃদয় হরণ করবো। জেনে রাখো এই সেরা সময় বসন্তকে নিয়ে কে কী লিখে গেছেন, সেইসব চরম বাণীগুলো মুখস্থ করে রাখার। সময় মতো ঝেরে দেবো। মাঝেমধ্যে দু-একটা শব্দ আপনাদেরই প্রিয় মানুষ, পোশাকের আবরণ থেকে বদলে নিয়ে নিজের করবো। কত কী করবো! সত্যিকারের ভালোবাসায় কি এতকিছু থাকে! কী জানি। চারুকলায় বাউল সেজে গেছিলাম। ওখানেও জরা লেগে আছে। গ্রিন হাউস এফেক্ট বোধ হয়! সঙ্গে এতটা পথের ক্লান্তি এখনো সইছি। আমার কাছে বসন্ত অসুখের ঋতু।
‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চনফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল’ যতই থাক আমি খুঁজে খুঁজে বার করি কোন গাছে এখনো মুকুল ধরেনি! কোনো ফুলে এখনো মৌমাছি আসেনি! প্রকৃতি আমায় এসব দেখার দায়িত্ব দেয়নি কিন্তু আমিও একদিন কাঞ্চনফুলকে রবীন্দ্র-ভানু মঞ্চের সামনে ফুটতে দেখেছি ঝরে পড়তেও দেখেছি। তাই যখন দুই-একটা বাইক-সাইকেলের চাকা ছাড়া কেউ তাদের ছুঁয়ে দেখে না, সন্ধ্যার সাদা-আলোয় জোড়া জোড়া শ্বাস বাতাসে খাবি খায় অথচ কোনো খোঁপাই তার সুবাস ধরে রাখে না।
হ্যাঁ! তখনই আমার নৈতিক দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে। ইচ্ছে করে সৌন্দর্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাই। নাহ! থাক। আমি বেশ কয়েকবার নান্দনিক হতে চেয়েছিলাম। দর্শনের ছাত্র বলে বুক থেকে চিত্রকল্প উপড়ে নিলো এবং শিখলাম নৈঃশব্দ্যই আসল ভাষা। আমার বাসন্তিক শৈলী এখন দুপুর হলে দুহাতে গন্ধপাতার ধোঁয়া উড়িয়ে লেবুজল খায়। পলাশের কথা বলা ভারী দরকার। ওই নামে এখন আমার ভাই ও ফুল দুইই ক্যাম্পাসে আছে। আমি ফুলের কথাই বলবো। এটা বলেই নৈঃশব্দ্যে যাব। ক্যাম্পাসে পলাশের অবস্থা এম.এ ক্লাসের এক চেনা মেধাবী ছাত্রীটির মতো। ঠিক সুবিধামতো একটা ক্লিপে নিজেকে আটকে নিয়েছে, এখন দেদার নম্বরের ঝলকানিতে চোখ ছানাবড়া আমাদের। আমিও পলাশকে কাছ থেকে দেখতাম। কুড়োতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একটাই নন্দিনী ছিল সে হলো পলাশ।