যার মাথায় যত বুদ্ধি, সে তত বোকা। যেখানে বুদ্ধিমানদের ভিড় দেখবেন, সেখানে চোখ বুঁজে বুঝে নেবেন, আসলে বুদ্ধিমান নয় তারা। অধিকাংশই নির্বোধ। মানুষের বুদ্ধি বা মেধা একটা সময় পর্যন্ত কাজ করে। তারপর সেটা নির্বুদ্ধিতার পর্যায়ে চলে যায়। তাদের আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে, আরে এই লোকটাই কি সেই লোক! আজকাল অনেক ‘তথাকথিত’ জ্ঞানী বা বুদ্ধিমানের ছড়াছড়ি দেখছি চারপাশে।
আপনার অনেক জ্ঞান, আপনি খুব দামি মানুষ। বুঝলাম। কিন্তু মানলাম না। আপনাকেই কেন প্রচার করতে হবে যে, আপনি জ্ঞানী! প্রাচীন সত্য—বৃক্ষ তোর নাম কী? ফলে পরিচয়। আপনার কথাবার্তা, আচার-আচরণই প্রমাণ করবে, আপনি জ্ঞানী না নির্বোধ শ্রেণির। আপনাকে ঘিরে রেখেছে যে চ্যালা-চামুণ্ডার দল, তাদের কাজই হলো আপনার তোষামোদ করা। আপনাকে পচানো। আপনি যাই করেন না কেন, তারা বলবে ভালো। আসলে ভালো না মন্দ করছেন, সেটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করেই দেখুন না। অবশ্য সেটুকু বোধই যদি থাকবে, তাহলে কি আর আপনি নির্বোধের মতো কথা বলবেন, কাজ করবেন? আপনি তো সেটাই চান, আপনার চারপাশে চামচারা থাকুক। আপনার সব কাজে বাহবা দিক। মারা খেলে তো জাতি খাবে। আপনার বা চামচাদের তাতে কী আর আসবে-যাবে।
অবাক ব্যাপার। আত্মসম্মানবোধ বলে একটা শব্দ অভিধানে ছিল। এখন আছে কি না, জানি না। অনেকদিন অভিধান খুলে দেখিনি। আপনার বা আপনাদের কর্মাকাণ্ড দেখে তো মনে হয়, আত্মসম্মান বোধ শুধু অভিধান নয়, এই দেশ ছেড়েই পালিয়েছে। আমাদের মরার এই দেশের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো- যোগ্য চেয়ারে অযোগ্যরা বসে আছে। তাদেরই বা দোষ দেই কী করে! তাদের বসার সুযোগ দিয়েছেন বলেই তো তারা বসেছে। অযোগ্যতাই যে তাদের বড় যোগ্যতা।
আগে জনপ্রতিনিধি বানানো হতো, যিনি জনগণের জন্য কাজ করেছেন বা করছেন, তাকে। আর এখন? তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কে হবেন জনপ্রতিনিধি। প্রথমত, তার টাকা বা ক্ষমতা কতটুকু। দ্বিতীয়ত, তার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা রয়েছে বা তিনি কয়বার জেলে গেছেন। তৃতীয়ত, তিনি কত বেশি অযোগ্য, অশিক্ষিত আর মূর্খ।
একাডেমিক শিক্ষা তার আছে কি না, সেটা বিষয় নয়। তিনি কতটা বেসিক শিক্ষিত সেটাই বিবেচ্য হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। আমার স্কুল জীবনের বাংলার শিক্ষক ছিলেন, গফুর স্যার। তাঁর একটা কথা এখনো কানে বাজে। একদিন ছাত্রদের উদ্দেশে ক্লাসে বলেছিলেন, ‘বাবারা, শিক্ষা হলো তিন প্রকার। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর সুশিক্ষা। তোরা জীবনে সুশিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করিস। না পারলে অশিক্ষিত থাকিস। তা-ও কোনোদিন কুশিক্ষিত হবি না।’ সেই গফুর স্যার আজ বেঁচে থাকলে দেখতেন, এদেশে অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা যতটা, তারচেয়েও অনেক বেশি কুশিক্ষিত লোক। বলাবাহুল্য, তারাই সাধারণ মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা।
মাছ, তরকারি, ফল থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছুতেই ফরমালিন। ফরমালিনযুক্ত আর ভেজাল খাবারে আমাদের এতটাই অভ্যস্ততা, আসল খাবার কদাচিৎ খেলেই আমরা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হই। তেমনটি চারপাশে এত্ত-এত্ত অযোগ্য মানুষজন, যোগ্যদের অবস্থা- ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’। আমাদের চোখে ছানি পড়েছে। যোগ্য লোক চোখেও পড়ে না আজকাল। ফলে সমাজ আর রাষ্ট্রের সব জায়গাতেই এই অযোগ্যদেরই আধিপত্য ।
আদার বেপারির নাকি জাহাজের খবর নিতে হয় না। অথচ আমরা সব আদার বেপারি দিয়েই জাহাজের খবর নিচ্ছি বা নিতে বাধ্য হচ্ছি। যার যেখানে নাক গলানো বা কথা বলার দরকার নেই, সে সেখানে কথা বলছি। সবাই যেন, ‘মুই কী হনুরে’। সব জান্তা শমশেরদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট আমজনতা। যার কাজটুকু সে করছি না ঠিকমতো। অন্যের কাজের সহযোগিতা তো করছিই না, বরং বিরূপ সমালোচনা করছি। নিজের কাজ রেখে অন্যের কাজে নাক গলাচ্ছি। এটাই আজকালের নয়া সংস্কৃতি।
রাজনীতি কী করে একজন মানুষের পেশা হতে পারে, বুঝি না ! পেশা মানে তো কাজ করা। মাস শেষে টাকা আয়। সে টাকায় সংসার চালানো। আমজনতা তো তাই বোঝে। তাহলে যে মানুষটা বলে, রাজনীতি তার পেশা, সে মাস শেষে টাকা কোথায় পায়? কে তাকে টাকা দেয়? তার সংসার চলে কী করে? তার অর্থনৈতিক অবস্থা তো দেখি আমজনতা বা যেকোনো প্রথাগত পেশাজীবীর চেয়ে ঢের ভালো। তা হলে লাখ লাখ মানুষ কেন এত পরিশ্রম করছে? তার চেয়ে তো রাজনীতিই করাই ভালো। বিধি চাইলে তো কোনো একদিন বিরাট কোনো চেয়ারেও বসে যেতে পারেন। বাড়ি, গাড়ি, অঢেল টাকা কোনোটারই কমতি হবে না। পরিচিত লোকজন আপনাকে দেখলে হয়তো হাসবে, টিটকারি মারবে। তাতে কী? পাছে লোকে কত কিছুইতো বলে। এইভাবে একদিন আমি বা আপনি একজন ‘কাণ্ডজ্ঞান বিবর্জিত উর্বর মস্কিষ্কের আবাল’ হয়েই যাব।