প্রসঙ্গগুলো শুধু পাল্টে যেতে থাকে। আমরা কোনো ঘটনায়ই থিতু হতে পারি না। যেই একটি ভয়াবহতার কথা উঠে আসছে, তো আর একটি মহাবিপর্যয় সামনে এসে যাচ্ছে। আমাদের চিন্তা যেহেতু ইস্যুকেন্দ্রিক, সেহেতু ইস্যুর পিছনে ছুটে চলছি। একটি ইস্যু এসে পূর্ববর্তী ঘটনাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমরা যেন একটি চলন্ত বাসের জানালায় বসে আছি, যেখানে কোনো দৃশ্যই পূর্ণাঙ্গ নয়। একটি দৃশ্যের ভেতরে আরেকটি দৃশ্য ঢুকে পড়ছে। আমরা তাই দৃশ্য বর্ণনা করতে না পেরে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলি। আমরা বলি, দৃশ্যের ভিতরে কোনো মহত্ত্ব নেই, দৃশ্যগুলো তো একই বর্ণনার পুনর্বিন্যাস। পথ মানেই পথিক, দু’একটি নুলো ভিক্ষারি, সুদৃশ্য অট্টালিকা। শহর থেকে বেরিয়ে গেলে সারিসারি সবুজ বৃক্ষ, কোথাও নীল জলরাশি, আর একই রঙের আকাশ।
আসলে কোনো দৃশ্য নয়, সময় ক্ষেপণ, আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে হবে। সুতরাং, আমাদের চোখ ও বিবেক ওই দৃশ্যান্তরে আবদ্ধ হয়ে গেছে। যা ঘটছে, তা নিয়ে এককাপ চায়ের ভেতরে দৃশ্যান্তর ঘটছে, আর অপেক্ষায় আছি নতুন একটি ঘটনার, বিপ্লবের মওকা নিয়ে যারা নেমে এসেছিল পথে, তারাও প্রতিমুহূর্তে পাল্টে নিচ্ছে স্লোগানের ভাষা। খেই হারিয়ে অনেকেই ফিরে গেছে ঘরে। আর যারা এখনো টিকে আছে, পথে তাচ্ছিল্যে তারা একটি সার্কাস দলে পরিণত হয়েছে। নানাবিধ ইস্যুকেন্দ্রিক জটিলতায় জনগণ শোক ও সংশয়ের পরিবর্তে বিনোদিত হচ্ছে! আর যেহেতু তাদের বিনোদনের অনেক মাধ্যম তাই চ্যানেল বদলে তারা সিরিয়াল দেখতে বসে গেছে। অভিনয় দেখতে দেখতে তারাও রপ্ত করে নিয়েছে শিল্প। তাই শোকে বুক চেপে কান্নার ঢেঁকুর তুলছে, পরক্ষণেই দৃশ্য বদলে ক্লোজআপ হাসির বিজ্ঞাপন।
আমাদের লেখারও কোনো বিষয় কেন্দ্রিকতা থাকছে না। যে ইস্যু নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম প্রসঙ্গ বদলে গেছে তাই কতগুলো অবিন্যস্ত বাক্য এসে শুধু ভিড় করছে। সুতরাং, লেখাটা শেষপর্যন্ত কোথায় থেমে যাবে বলা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক জঙ্গিদের ক্ষোভটা লেখক থেকে ডাইবেট হয়ে প্রকাশকদের ওপর গিয়ে পড়েছে। আসলে প্রকাশক যদি লেখা প্রকাশ না করে বা তাদের ভেতরে ভীতি তৈরি করা যায় অর্থাৎ প্রকাশের মাধ্যমটা বন্ধ করা যায় তবে তো কেল্লা ফতে। তাই হত্যা করা হলো জাগৃতি প্রকাশক দীপন ভাইকে, প্রচণ্ড জখম নিয়ে বেঁচে গেলেন শুদ্ধস্বর প্রকাশক টুটুল ভাই, কবি তারেক ভাই। আর আমরা যারা এসব হচ্ছে কি! হচ্ছে কি! বলে যারা চিৎকার চেঁচামেচি করছি তাদের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। অনুভূতি প্রবল প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করছেন—‘আপনারা লেখালেখি বন্ধ করুন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ছে, সুতরাং আমার অনুভূতিতে আঘাত লাগছে।’ আমরা নীরবতা অবলম্বন করি/ করতে বাধ্য হই। কারণ ধর্মের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকুক আর নাইবা থাকুক আমরা ধার্মিক। কোরআন সুন্নার আলোকে জীবন না চললেও আমরা মুসলমান। জীবনে কোনো দিন মন্দিরে না গেলেও আমরা হিন্দু। আর আমরা যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেও যিশুর নামে শপথ নিচ্ছি আমরা খ্রিস্টান। কারণ, যেহেতু আমার পূর্বপুরুষ ধার্মিক ছিলেন! যেহেতু জন্মের পরই আমার নামের সঙ্গে মোহাম্মদ, শ্রী, গোমেজ যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
_________________________________________________________________________________________________
ধর্মরক্ষা বা জেহাদের নামে তারা সাধারণ মানুষের মনে কৌশলে ঢুকিয়ে দেন আদিম বর্বরতা। তাই সত্যবাদী যিশুর জন্য যুগে যুগে ক্রুশকাঠ প্রস্তুতই থাকে।
_________________________________________________________________________________________________
আমাদের পূর্বপুরুষরা যেহেতু প্রতিদিন হাগু করতেন, আমরাও হাগু করি, পূর্বপুরুষরা সুরা পান করতেন, আমরা মদ খাই। আমাদের পূর্বপুরুষরা হেরেমে-জলসায় উপপত্মী রাখতেন, আমরা তাই ঘরে মহিলা কেয়ারটেকার রাখি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেহেতু আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন, তাই আমিও প্রতিদিন জন্মদেওয়ার রিহার্সেল দিচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেহেতু টুপি, টিকি পরতেন ও রাখতেন, তাই আমরাও টুপি পরি, টিকি রাখি। যিশুকে হত্যার নিদর্শনস্বরূপ আমাদের পূর্বপুরুষরা গলায় ক্রুশকাঠ রাখতেন, তাই আমরাও তোমাদের মধ্যে যেন কেউ সত্যবাদী যিশু জন্ম নিতে না পারে, তাই গলায় ক্রুশকাঠ ঝুলিয়ে রাখি। যুগে যুগে যিশুর পরিণাম যেন তোমরা ভুলে না যাও।
আমাদের মধ্যে যখনই কোনো সত্যবাদী যিশুর জন্ম হয়, তখনই ধর্মের নামে, এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের ব্যবসামন্দার আশঙ্কা করেন। ফলে তারা ফতোয়াবাজিতে লিপ্ত হন। তারা স্বধর্মচ্যূতদের জন্য একমাত্র কতলকে জায়েজ করে নেন। ধর্মরক্ষা বা জেহাদের নামে তারা সাধারণ মানুষের মনে কৌশলে ঢুকিয়ে দেন আদিম বর্বরতা। তাই সত্যবাদী যিশুর জন্য যুগে যুগে ক্রুশকাঠ প্রস্তুতই থাকে। আর এই ক্রুশকাঠের ক্ষমতা এতই যে স্বয়ং রাষ্ট্রও তাকে ভয় পায়। তাই এইসব ক্রুশকাঠের বাহকদের বগলে রাখতে যিশুর মৃত্যু খবরে রাষ্ট্র শঙ্কিত হয় না বরং সত্যপ্রচার করে তারা যে জনমনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন, তার জন্য সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এমন অভিযোগ ওঠে। অথবা এইসব ধ্রুবপতনে যারা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে চায়, তাদের জন্য বরাদ্দ হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর তাদের সহযোগিতার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে মৌলবাদীর রক্তাক্ত হাতিয়ার। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রক্তাক্ত পড়ে থাকেন হুমায়ুন আজাদ, রাজপথে লাশ হয়ে থাকেন রাজিব হায়দার, অভিজিত রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, ফয়সল আরেফিন দীপন, চাপাতির আঘাত নিয়ে মৃত্যুও প্রহর গোনেন টুটুল, তারেক, দীর্ঘ নিরুদ্দেশে কবি অভিজিৎ দাশ। রাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয না বরং স্বস্তি পায়। তদন্তের নামে গঠিত হয় সার্কাস পাটি। বছর শেষে সার্কাস পার্টি ঘোষণা করে, মানুষ মাত্রই মরণশীল, রাস্তায় পড়ে মরার মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই সুতরাং যারা মরতে চান না তারা এদেশ ছেড়ে চলে যান।
আমরা অনুগত নাগরিক হয়ে শামুকের খোলসে আবৃত হই। কেউ কেউ ঘাড় বাঁকা করে হাঁটি।