ভরা শ্রাবণের অন্ধকার স্তব্ধ রাত। মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরছে। সেই শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। ঘরের মা-জেঠাইমায়েরা সন্ধ্যে সন্ধ্যেয় খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে তেলের পিদিমের আলোয় রামায়ণ কি মহাভারত পড়ছেন সুর করে, আর ঘরের পনেরো ষোলো বছরের ছোট্ট মেয়েটি হেঁসেল আগলে বসে রয়েছে। তার চোখ বিনিদ্র, উৎকণ্ঠিত।
তার ওপর আজ ঘোর দায় চেপেছে, এক জেল পলাতক আসামিকে আশ্রয় দেওয়ার। জানালার ফাঁক দিয়ে যতদূর দেখা যায়, ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। পরনের শাড়ির আঁচল ভালো করে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে একবার ভাবে উঠোনে নেমে দেখবে কি না। সেই পলাতক আসামি তো আজ প্রথম তার বাড়িতে আসছেন। এই ঝড় বাদলের রাতে তিনি ঠিকঠাক পথ চিনে আসতে পারবেন তো! মনের ভয়-কৌতূহলের চাপা উত্তেজনা কিশোরী মেয়েটি ঠেকায় কী করে! অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। কেন তার ওপরই এতখানি দায় বর্তালো, কে জানে! কে এই পলাতক আসামি? ইনি কি সেই তিনি, যার কথা এতদিন নির্মলদার মুখে শুনে এসেছে? কিশোরী কন্যার আর তর সয় না। মুষল ধারার বৃষ্টি উপেক্ষা করেই নিঃশব্দে দরজা খুলে নেমে গেলো উঠোনে।
যাকে সে তিনদিন আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের ঘরে। এক রাতে মনিদা তাকে নিয়ে দাড় করিয়ে দিলো সেই ক্ষীণকায় মানুষটির সামনে।
দৌড়ে গিয়ে ভিজে কাপড়ে ঠাকুর ঘরের চাতালে দাঁড়াতেই দেখলো অন্ধকারের বুক চিরে একটু আলোর রেখা। হাতে টর্চ আর মাথায় জুঁইর চাপিয়ে আসছেন এক ক্ষীণকায় মানুষ। কিশোরীর মুখে এবার হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এতখানি দায়িত্বের ভার তার ওপর আগে কেউ কখনো চাপায়নি। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে, কারণ এই মানুষটাকে তার লুকিয়ে রাখতে হবে। মা, জেঠাইমা, কাকা, কাকিমার সংসারে এই আসামিকে যে সে কী করে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে আশ্রয় দেবে, ভেবে কুল পায় না। অথচ নির্মলদার কড়া নির্দেশ, কেউ যেন এই আসামিকে আশ্রয় দেওয়ার কথা জানতে না পারে। বাড়ির আপাতত অব্যবহার্য একটি কামরায় তার থাকার বন্দোবস্ত হোলো। খাওয়া-দাওয়া সবই সেই ছোট কামরার ভেতরেই, কেউ যেন জানতে না পারে। ভোরে অথবা রাতে খাবার দিয়ে আসতে হয়, বাকি সময়টুকু বাইরে থেকে তালা বন্ধ।
আসামিও কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, ‘খবরদার, কেউ যেন জানতে না পারে আমার কথা।’ কিশোরী কন্যাও বাধ্যের মতো ঘাড় নেড়ে নীরব সম্মতি জানান দেয়। বন্ধ ঘরের আধখোলা জানলার মৃদু আলোয় সেই আসামি সারাদিন বই পড়েন, আর ডায়রিতে কী যেন লেখেন। একদিন এই লুকোচুরি ধরা পড়ে গেলো মায়ের কাছে। মা সাফ জানিয়ে দিলেন, এক্ষুনি বের করে দিতে হবে এই আসামিকে। কিশোরীর তো মন মানে না, এই ঝড় বাদলের রাতে না খাইয়ে মানুষটিকে বিদায় দিতে। কিন্তু ততক্ষণে আগন্তুকের পোটলা-পুটুলি বাঁধা শেষ। ঘরের লোক জেনে গেছে মানে বিপদ। সুতরাং আর থাকা চলে না। যাওয়ার আগে আশ্রয়দাত্রী কিশোরী কন্যাটির হাতে একটি বই আর একটি পেপার তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি চিঠি দেবো। খামের ওপর আমার সাংকেতিক নাম থাকবে—জমিদার।
সেই রাতের পর থেকে কিশোরী মেয়েটির জিদ চেপে গেলো তার সঙ্গে ফের অন্তত একটি বার করার। পরে মণিদার কাছে বায়না জুড়লো, সেই আগন্তুকের সঙ্গে দেখা করবে, যাকে সে তিনদিন আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের ঘরে। এক রাতে মনিদা তাকে নিয়ে দাড় করিয়ে দিলো সেই ক্ষীণকায় মানুষটির সামনে। কথাবার্তার একপর্যায়ে কিশোরীর ডানহাতের পাঞ্জা নিয়ে জোর চাপ দিলেন। ব্যথায় হাত টেনে নিতেই তিনি বললেন, ‘এই শক্তিতে দেশের কাজ করবি? হবে না, হবে না। রীতিমতো ব্যায়াম করতে হবে।’ অন্ধকারের টিমটিমে আলোয় সেদিনের আশ্রয় প্রার্থীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে কিশোরীর তাকে চিনে নিতে ভুল হলো না। সে বললো, ‘আপনি শিখিয়ে দিন, আমি ব্যায়াম করবো মাস্টারদা।’
শত-শত বিপ্লবীর মতো কেন যেন তার নামও ইতিহাসের বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে গেলো!
তারপর তো সেই আসামি কিংবা অকুতোভয় কিশোরী অথবা নির্মলদা আর সেই বর্ষণ মুখের শ্রাবণের রাতগুলো ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেলো ক্রমেই। তাদের চারপাশ হয়ে উঠলো রণাঙ্গন। কিশোরীর কোমল হাতে উঠে এলো রিভলবার। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই পলাতক আসামি মাস্টারদা সূর্যসেনের নাম জ্বলজ্বল করছে আজও। বিপ্লবে, সংগ্রামে, সাহসে চট্টগ্রামের নাম সমগ্র ভারতবর্ষে আলোড়ন তুলেছে। সেই শ্রীপুর, গৈড়লা কিংবা সুচক্রদণ্ডীর মতো বহু গ্রামের অকুতোভয় দামাল সন্তানদের নাম পৃথিবীর শোষিত, নির্যাতিত, স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রেরণার ইতিহাসে সদা জাগরুক। সেই ইতিহাসের ফাঁক-ফোঁকর গলে একটি চপলা মেয়ের মুখ বারবার আলোর ঝলকানির মতো উঠে আসে, সেই কিশোরীই বিপ্লবী কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা।
স্বাধীনতার করাল সময়ে একদিন ঠিক হলো সি. আইডির গুপ্তচরদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। রাত দুটোর সময় এই দঃসাহসিক কাজে প্রধান নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা। কালো পোশাকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে তার জুড়ি ছিল না। কয়েকজন সঙ্গীসমেত বেরিয়ে পড়লেন। সিআইডির গুপ্তচর ত্রিপুরা ভট্টাচার্য, অশ্বিনী চৌকিদার ও ত্রিপুরা বোসকে খোলা মাঠে ফেলে মুখে মাটির ঢেলা ঢুকিয়ে বেদম মেরে শায়েস্তা করেছেন। সেই অপরাধে বাবার কাছে খড়ম পেটাও কম খেতে হয়নি। তারপরও দমে যাননি। বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অন্ধকারের পথ মাড়িয়ে স্বাধীনতার আলো খোঁজার চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর। শেষে সেই সিআইডির গুপ্তচর ত্রিপুরা ভট্টাচার্যের সাহায্যেই পুলিশের হাতে বন্দি হন বিপ্লবী কুন্দপ্রভা।
কারান্তরীণ থেকেও কুন্দপ্রভার কণ্ঠরোধ করা যায়নি। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হাইড সাহেবের সামনেও জোর কণ্ঠে বলেছেন, তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চান। তিনি পুলিশ কিংবা আদালতে তার পক্ষে কোনো জামিন চাননি। তার পক্ষে মোকদ্দমা চালাতে উকিল নেননি। ক্ষমা চেয়ে মুক্তির পথ বেছে নিতে বললে, একবাক্যে অস্বীকার করেন। ফলত দুই বছরের কারাদণ্ড হয়ে গেলো। কারাবাসেও কত প্রলোভনের মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। আদর্শ বিচ্যুত হননি। বিপ্লবী কুন্দপ্রভার সাহস, একাগ্রতা বিবেককে আন্দোলিত করে। তিনি এই চট্টগ্রামের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এক সাহসী নারী ছিলেন। শত-শত বিপ্লবীর মতো কেন যেন তার নামও ইতিহাসের বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে গেলো!