সব কাজেই মানুষ স্বীকৃতি চায়, উৎসাহ চায়, অনুপ্রেরণা চায়। এই চাওয়াটা তার অধিকার। স্বীকৃতি না থাকলে কাজের প্রতি দরদ থাকে না। আর সৃজনশীল কাজে এসব বিষয় সবচেয়ে বেশি জরুরি। সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্য জগতে স্বীকৃতি বা পুরস্কার প্রাচীন ধারণা। রাজসভায়ও কবিকে পুরস্কৃত করা হতো। আধুনিক যুগে এসে এই স্বীকৃতি বা পুরস্কারের দায়িত্ব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের কাঁধে ন্যস্ত হয়েছে। তাই বিভিন্ন রকম পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছে। তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা মূল্যায়ন নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাবো না।
বলতে গেলে, যুগ যুগ ধরে পুরস্কারের ধারা বাংলা সাহিত্যে বহমান। দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কারের মধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ফলে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে এ পুরস্কার নিয়ে আগ্রহ কম নয়। প্রতিবছর একটা সময় এসে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কারা পাচ্ছেন, এ নিয়ে জল্পনা–কল্পনা শুরু হয়ে যায়। এমনকী পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনাও কম হয় না।
এমন বড় ধরনের স্বীকৃতি বা পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা হবেই। হওয়ারও কথা। অনেকেরই অনেক রকম প্রত্যাশা থাকে। এছাড়া পুরস্কারদাতাদের বাছাই বা নির্বাচন নিয়ে নানা রকম অভিযোগও পাওয়া যায়। অনেক সময় কম যোগ্যরাও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়ে থাকেন। এছাড়া পুরস্কার বঞ্চিতরাও বিদ্রোহ করে বসেন। বাংলা একাডেমি এ পর্যন্ত বড় ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হয়নি। তবে, দলীয় প্রভাব কিছুটা থেকেই যায়। সেসব কথা না হয় বাদই থাকলো।
এবার মূল আলোচনায় আসি, যেহেতু অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা এখন অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সাহিত্যের সঙ্গে যারা জড়িত কিংবা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা অপেক্ষায় থাকেন কে বা কারা পাচ্ছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার—এটা জানার জন্য।
বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখকদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। পুরস্কার হিসেবে ৩ লাখ টাকা, সনদপত্র ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। তবে এ বছর করোনা মহামারীর কারণে বইমেলার সময় পেছাতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারে বাংলা একাডেমি। তবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ হতে পারে জানুয়ারিতেই।
এবারও ময়ূখ চৌধুরীর সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। কারণ প্রচারের আলোয় না থাকলে কারও নামই সাধারণের কাছে পৌঁছায় না। সে হিসেবে প্রচার মাধ্যমের যথাযথ আনুকূল্য না পেয়ে যদি সাধারণ পাঠকের কাছে অনালোচিত-অনাবিষ্কৃত থেকে যান, তবু কাব্যবোদ্ধাদের আগ্রহের তালিকায় তিনি প্রথম সারিতেই আছেন।
জানা যায়, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৫৫ সালে। একাডেমির বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর ১৯৬০ সাল থেকে এ পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। এতে বিবেচনা করা হয়—কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, ছোটগল্প, শিশুসাহিত্য, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা-ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-পরিবেশ ও অনুবাদ সাহিত্য। পুরস্কার শুরুর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শাখায় বছরে ৯ জনকে দেওয়া হয় এ পুরস্কার। এরপর বছরে দুই জনকে এ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। তবে ২০০৯ সালে এসে আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে শুরু হয় সাহিত্যের চারটি শাখায় পুরস্কার দেওয়া।
আমরা জানি, সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন ১০ জন সাহিত্যিক। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন—কবিতায় মাকিদ হায়দার, কথাসাহিত্যে ওয়াসি আহমেদ, প্রবন্ধে স্বরোচিষ সরকার, অনুবাদে খায়রুল আলম সবুজ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় রফিকুল ইসলাম, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনিতে ফারুক মঈনউদ্দীন, নাটকে রতন সিদ্দিকী, বিজ্ঞান বা কল্পবিজ্ঞানে নাদিরা মজুমদার, শিশুসাহিত্যে রহীম শাহ ও ফোকলোরে সাইমন জাকারিয়া।
ফলে পুরস্কারের প্রতি আগ্রহটা শুরু হয় ডিসেম্বর থেকেই। বিজয়ের মাসজুড়ে আলোচনায় সরব থাকেন কবি-লেখকরা। বিভিন্ন মাধ্যমে সে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। সেই আগ্রহের সূত্র ধরেই চিন্তাসূত্র একটি পরোক্ষ জরিপ চালিয়েছে। সে জরিপে বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। এরমধ্যে কবিতায় ময়ূখ চৌধুরী, আসাদ মান্নান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ফারুক মাহমুদ ও বিমল গুহর নাম উঠে এসেছে।
কথাসাহিত্যে রফিকুর রশীদ, মনিরা কায়েসের নাম আলোচনায় রয়েছে। নাটকে নিরঞ্জন অধিকারী, গবেষণায় ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অনীক মাহমুদ পেতে পারেন। প্রবন্ধে জুলফিকার মতিন, বেগম আকতার কামালের নামও উল্লেখযোগ্য। অনুবাদে গোলাম সারোয়ার, জিএইচ হাবীব ও রাজু আলাউদ্দিন আলোচনায় এগিয়ে রয়েছেন। বিজ্ঞান বা কল্পকাহিনিতে অপরেশ বন্দ্যেপাধ্যায়, শিশুসাহিত্যে তপংকর চক্রবর্তী ও ফারুক নওয়াজ অগ্রগণ্য। ফোকলোরে তপন বাগচী, আবদুল খালেক, মহসিন হোসাইনের নাম শোনা যাচ্ছে। আত্মকথা বা ভ্রমণকাহিনিতে হায়দার আকবর খান রনোর নাম উল্লেখ করার মতো।
তবে, সবকিছু মিলিয়ে আলোচনার মূল ফোকাস থাকে কবিতা, কথাসাহিত্য ও ফোকলোর গবেষণায়। এই তিনটি বিভাগে যারা পাচ্ছেন; তাদের নিয়েই আলোচনা বেশি হচ্ছে। ফলে কবিতায় এবার আসাদ মান্নানের হাতে উঠতে পারে পুরস্কার। কবি আসাদ মান্নান ১৯৫৭ সালে সমুদ্রতীরের সন্দ্বীপে বেড়ে ওঠেন। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে। প্রথম কবিতার বই ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। ঠিক দুই বছর পর বের হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘সৈয়দ বংশের ফুল’। বইটি চিনিয়ে দেয় কবির স্বরূপ। সৈয়দ বংশের ফুলের মধ্য দিয়েই পাঠক একজন সম্পূর্ণ প্রস্তুত কবির দেখা পান। তার আগমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার শব্দ, কল্পনা ও ভাষার দক্ষতার সঙ্গে পাঠকের সেতু তৈরি হয়।
কিন্তু ময়ূখ চৌধুরীও পাওয়ার যোগ্য। তবে কোনো এক অদৃশ্য কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। তাই এবারও ময়ূখ চৌধুরীর সম্ভাবনা নেই বললেও চলে। কারণ প্রচারের আলোয় না থাকলে কারও নামই সাধারণের কাছে পৌঁছায় না। সে হিসেবে প্রচার মাধ্যমের যথাযথ আনুকূল্য না পেয়ে যদি সাধারণ পাঠকের কাছে অনালোচিত-অনাবিষ্কৃত থেকে যান, তবু কাব্যবোদ্ধাদের আগ্রহের তালিকায় তিনি প্রথম সারিতেই আছেন। ১৯৫০ সালে জন্ম নেওয়া ময়ূখ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। অথচ তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। প্রায় বিশ বছর লেখার পর, তিনি নিজের প্রথম বই প্রকাশের পথে হেঁটেছেন।
এছাড়া, অর্ধশতাধিক বইয়ের লেখক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কবিতার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায়ই নিজের সুদৃঢ় অবস্থান জানান দিয়েছেন। আবার কবি ফারুক মাহমুদের জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। এরমধ্যে অন্যতম— ‘পাথরের ফুল’, ‘অনন্ত বেলা থেকে আছি’, ‘অপূর্ণ তুমি আনন্দ বিষাদে’, ‘অন্ধকারে মুগ্ধ’, ‘হৃদয়ে প্রেমের দিন’, ‘রৌদ্র এবং জলের পিপাসা’, ‘মহাভারতের প্রেম’ ও ‘স্মৃতিমেঘ ও স্মৃতিরোদ’ প্রভৃতি। এদিকে, বিমল গুহ একাধারে কবি ও লেখক। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশের কবিতায় যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন; কবি বিমল গুহ তাদের অন্যতম। ১৯৮২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’। এ পর্যন্ত ১২টি কাব্যগ্রন্থ, ৭টি কিশোর কাব্যগ্রন্থসহ মোট ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো—‘সাঁকো পার হলে খোলাপথ’, ‘স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর’, ‘নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘প্রতিবাদী শব্দের মিছিল’, ‘বিবরের গান’, ‘প্রত্যেকেই পৃথক বিপ্লবী’, ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ‘কবিতাসংগ্রহ’।
আবার এমনও হতে পারে, আলোচনার বাইরে থেকেও যে কেউ পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না। কারণ বাংলা একাডেমি তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার পথ ধরেই পুরস্কারগুলো দেবে। তবু, আশা করবো, যোগ্য ব্যক্তির হাতেই যেন ওঠে যোগ্যতম পুরস্কার।
কথাসাহিত্যে যে দু’জন আলোচনায় রয়েছেন; তার মধ্যে রফিকুর রশীদ অন্যতম। রফিকুর রশীদ জন্মগ্রহণ করেন মেহেরপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষের পর ১৯৮৩ সালে সিলেটের এক চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখান থেকে যোগ দেন কলেজ শিক্ষকতায়। তিন যুগেরও বেশি সময়জুড়ে চলছে তার সাহিত্যচর্চা। লেখালেখির প্রিয় প্রাঙ্গণ কথাসাহিত্য। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব কাগজে তিনি বিরামহীন লিখে চলেছেন নানামাত্রিক গল্প এবং বিশেষ সংখ্যায় উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ তার প্রিয় প্রসঙ্গ। গল্প-উপন্যাসে তো বটেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তিনি উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিমায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত অথচ অনিবার্য অনেক প্রসঙ্গ বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
এদিকে, উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছেন অধ্যাপক ড. মনিরা কায়েস। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তিনিও গল্প লেখেন চমৎকার। একইসঙ্গে আখ্যান, গবেষণা, শিশুসাহিত্যে পদচারণা রয়েছে তার। এছাড়া, তিনি কবি ও সাবেক সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ারের স্ত্রী। আবু হাসান শাহরিয়ার এর আগে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। সেক্ষেত্রে হয়তো মনিরা কায়েসের অবস্থান বিবেচনা করা হবে ভিন্ন আঙ্গিকে।
কবিতা ও কথাসাহিত্যের পরেই বাংলা সাহিত্যে ফোকলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে ফোকলোর নিয়েও আলোচনা কম নয়। তাই তো এবার অধিকাংশের মুখে উঠে এসেছে ড. তপন বাগচীর নাম। ফোকলোরে তার অবদানও কোনো অংশে কম নয়। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। ফোকলোর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাই জোর দিয়েই বলা যায়, তপন বাগচীর পুরস্কারপ্রাপ্তি তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে বসাবে। তিনি পুরস্কারটি পেতেই পারেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সবমিলিয়ে বলা যায়, যাদের নাম আলোচনায় এসেছে; তারা প্রত্যেকেই যোগ্য। তবে, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বিভাগে একজন করেই পাবেন পুরস্কার। ফলে অন্যদের আশাহত হতেই হবে এবার। তবে পরবর্তী সময়ে যে তারা পাবেন না, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আবার এমনও হতে পারে, আলোচনার বাইরে থেকেও যে কেউ পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। তাতে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না। কারণ বাংলা একাডেমি তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার পথ ধরেই পুরস্কারগুলো দেবে। তবু, আশা করবো, যোগ্য ব্যক্তির হাতেই যেন ওঠে যোগ্যতম পুরস্কার।