কবি মানেই দ্রষ্টা। সত্যকে তিনি যেভাবে নিজের মধ্যে খুঁজে পান, কাব্যের দর্শনে ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করেন নিজেকে। স্রষ্টা ও দ্রষ্টা হিসেবে কবি কামাল চৌধুরীর মূল্যায়ন বাংলা সাহিত্যচর্চার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে হয়েছে। নতুনভাবে তার ও তার কবিতা সম্পর্কে আলোচনার আর কোনো প্রয়োজন হয়তো নেই-ই। তারপরও কামাল চৌধুরীর কবিতা, তার ভাবপ্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র্য, তার বলিষ্ঠতা, তার প্রতি স্তরে স্তরে অন্তর্নিহিত অর্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন বার্তা বহন করেছে। তাই, তার কবিতা সম্পর্কিত আলোচনার প্রয়োজন হয়তো কোনোদিনই ফুরোবেও না। তবে আজকের এই প্রবন্ধে পুরো আলো স্থির থাকবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম প্রতিবাদী কবি কামাল চৌধুরীর সেই সব প্রতিবাদের দিকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর ঘাতক, যড়যন্ত্রকারী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ নাম। সামরিক জান্তার ভয়ে কেউ কথা বলতে পারছে না। প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সরকারি মদদে সৃষ্টি করা হয়েছে ফ্যাসিবাদী ছাত্র সংগঠন। এ রকম প্রতিকূল সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশ্যে কলমকে তলোয়ারের মতো উন্মোচিত করেছিলেন কামাল চৌধুরী। কবিতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যখন তর্কের ধোঁয়া ওঠে, কামাল চৌধুরী তখন আমাদের ভাবান। একজন কবির মধ্যে কী রকম দম থাকলে, বিশ বছর বয়সে পা রেখেই কবিতাকে অস্ত্র বানিয়ে পিতার হত্যার জবাব দেন শক্তভাবে।
১৯৭৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের একুশের স্মরণিকা ‘জয়ধ্বনি’-তে কামাল চৌধুরীর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম কবিতা ‘জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু’ প্রকাশিত হয়।
রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে
বক্ষপুরে ভয়
ভাবলে না কার রক্ত এটা
স্মৃতিগন্ধময়
দেখলে না কার জন্মমৃত্যু
জাতীয়তাময়।
(জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু: সচিত্র বাংলাদেশ জুলাই-আগস্ট, ২০০৯)
‘জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু’ কবিতার লাইনগুলো দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দেওয়ালে পোস্টার সাঁটা হয়েছিল ওই সময়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত মাসিক সমকাল পত্রিকার বিজয় দিবস সংখ্যা ১৩৮৫-তে কবিতাটিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে কামাল চৌধুরীকে পচাঁত্তর-পরবর্তী বাংলা কবিতার সোচ্চার উচ্চারণের ভোরের পাখি আখ্যাও দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কামাল চৌধুরীর আরও একটি সাহসী পদক্ষেপের কথা আমরা জানতে পারি। ১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আদমজী জুট মিলের অফিসার্স কোয়ার্টারে ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুটি কবিতা পাঠ করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কামাল আবদুল নাসের, যিনি এখন কামাল চৌধুরী নামেই খ্যাত। এই তথ্যটি জানা যায়, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার এক লেখায়। ১৯৭৭ সালে তিনি ছিলেন আদমজী জুট মিলসের ২ নম্বর মিলের সহকারী ব্যবস্থাপক।
এভাবেই নানাবিধ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদের কারণে জনজীবনের নিবিড় সংযোগে গণমানুষের কাছের হয়ে উঠেছে তার কবিতার স্বর, তার সাহসী বিবেক।
ওই সময় মিলের চিফ লেবার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার প্রয়াত আহমদ হোসেন চৌধুরী ছিলেন কামাল চৌধুরীর বাবা। স্বাধীনতা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন কে এম নুরুল হুদা। তিনি জানাচ্ছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশে দুঃসহ নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তখন সামরিক শাসনের কারণে বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করা যেতো না। সারা দেশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে বাস করছিল। … আহমদ হোসেন চৌধুরীর মেজো ছেলে কামাল চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তরুণ কবি হিসেবে তার একটা পরিচিতিও তৈরি হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে আমরা কামালকে কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানাই। কামাল মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানালেন। আর বললেন, ‘আজকে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতাকে স্মরণ না করে কোনো অনুষ্ঠান হতে পারে না।’ একথা বলে কামাল নিজের লেখা একটি কবিতা এবং নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। ‘জয় বাংলা’ বলে কামাল কবিতা পাঠ শেষ করলেন।
কামালের বক্তব্য ও কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে ততক্ষণে আতঙ্কিত হয়ে অনুষ্ঠানস্থল থেকে চলে গেছে। কামাল এ অবস্থায় আবার মঞ্চে উঠে সবাইকে সাহস দিলেন। সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আমি নিজ দায়িত্বে এ কবিতা পড়েছি, এতে কারও ভয়ের কোনো কারণ নেই।’ (বঙ্গবন্ধু হত্যা: আদমজী জুট মিলে প্রকাশ্য প্রতিবাদ; কালের কণ্ঠ, ১৫-০৮-২০১৯)।
জনজীবনসম্মত কবিতা কবিকে ছড়িয়ে দেয় মানুষের মধ্যে। কবির মধ্যে মানুষ আবিষ্কার করতে পারে নিজেকে। তেমনি মুঠো তোলা স্লোগানের রাজপথে কামাল চৌধুরীর কবিতা হয়ে উঠেছে চিরভাস্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী স্লোগানও লেখেন তিনি।
মুজিব লোকান্তরে
মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে
এই স্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্লোগানমুখর কবি হিসেবে খ্যাত হন সবার কাছে। এরই সূত্রধরে ১৯৭৯ সালের ছাত্রলীগের সংকলনের নাম করা হয় ‘মুজিব লোকান্তরে মুজিববাংলার ঘরে ঘরে’। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনাব ওবায়দুল কাদের, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাহলুল মজনুন চুন্নু। এমন অসংখ্য স্লোগানমুখর কবিতা রাজনীতির সীমানা ডিঙিয়ে কামাল চৌধুরীকে নিয়ে গেছে অস্তিত্বের গভীরতর মানবিক চেতনার অভিমুখে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম প্রতিবাদী কবিতা লেখার পাশাপাশি প্রথম প্রতিবাদী গানের ক্যাসেট প্রকাশের উদ্যোগও নেন কামাল চৌধুরী। তার লেখা ‘মুজিবর আছে বাংলার ঘরে ঘরে/বাঙালির অন্তরে’ শিরোনামের এই গানটি আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে সাজেদ আকবরের দরাজ কণ্ঠে লিয়াকত আলী লাকীর সুরে ১৫ আগস্টের পর প্রথম লিখিত, গীত ও ক্যাসেটভুক্ত সংগীত।
এভাবেই নানাবিধ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদের কারণে জনজীবনের নিবিড় সংযোগে গণমানুষের কাছের হয়ে উঠেছে তার কবিতার স্বর, তার সাহসী বিবেক। কবির এই স্বাতন্ত্র্য বাংলা কবিতায় অবশ্যই ব্যতিক্রম। কামাল চৌধুরী তাই এক অনন্য ভাষাশিল্পী, স্বতন্ত্র কথক। জীবনদৃষ্টির অনন্য শিল্পী। সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি কামাল চৌধুরী ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয় করা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদী এই কবিকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা।
আরও পড়ুন: আমি জানি খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়-৩৮ ॥ মায়া অ্যাঞ্জেল্যু