এমন একজন মানুষকে নিয়ে লিখতে বসলাম যাকে নিয়ে আমার লেখার বিষয় বিচিত্র। তাকে লিখতে গেলে তাকে অক্ষরে পরিণত করতে গেলে সেই অক্ষর দিয়ে অযুত-নিযুত পৃষ্ঠার বই লেখা যেতে পারে। কামরুল বাহার আরিফ ভাইকে আমি প্রথম দেখি বগুড়া সাতমাথায় নিকুঞ্জের চায়ে দোকানে। মনে আছে, চায়ের আড্ডায় সপ্তরথী বসে আছেন, আর তাদের সামনে আমি দুরুদুরু বুকে বেজায় নার্ভাস এক তরুণ। ওই রথীদেরই একজন ছিলেন আরিফ ভাই। আমি তখন তাকে শুধু নামে চিনতাম তার লেখা পড়ে, কিন্তু চোখে দেখিনি।
সেবার বগুড়া লেখক চক্রের কবি সম্মেলনে আমি আগত অতিথিদের আতিথেয়তার দায়িত্বে। কাঠের বেঞ্চে বসা হাতে ওয়েকার, সম্ভ্রান্ত চেহারার এক ভদ্রলোক আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন। প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে আমি যখন আগামীকাল সকালে কখন কিভাবে কোথায় যেতে হবে সেসব নিয়ে কথা বলছি তখন অন্যদের মতো তিনিও ওই কথোপকথন বেশ উপভোগ করছিলেন বোঝা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর কাছে ডেকে নিয়ে কাঁধে হাত রেখে আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন তারপর ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে খোঁজ নিলেন সেটা বেশ আন্তরিকতার সাথে। যেখানে কোনো কৃত্রিমতা ছিলো না। প্রথম দিনের এইটুকুতেই আমার মনমগজে সুবৃহৎ ইমারত দাড়িয়ে গেল আরিফ ভাইয়ের নামে। পরে যখন জানতে পারলাম তিনি রাজশাহী বিদ্যালয়ে প্রশাসনে কর্মরত। তখন আরো কিছু বিষয় ভালো লাগার পালে হাওয়া লাগিয়ে দিলো। কেননা আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষার্থীর সাথে প্রেমে মশগুল তখন। মনে মনে ভাবতাম যাক একজন ক্ষমতাধর মানুষের সাথে আমার পরিচয় হলো।
যদিও একজন কবি তো আসলে কোনও ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। তিনি থাকেন ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে। অথবা হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের মতো ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে থেকেই অন্তর্ঘাতী। এই দ্বিতীয় ভূমিকাটি হয়ে ওঠা খুবই কঠিন। কিন্তু আবার একজন কবি, ভয়ংকর সময়ের এক জীবন্ত দলিল রচনাও করতে পারেন। তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি বিভিন্ন কবির লেখায়। লোরকার কবিতায় তা জীবন্ত, গা শিরশির করে ওঠে। স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ দেখে যেমন আমরা অস্থির হয়ে উঠি, এ সময়টা তো তেমনই।
সারা বিশ্বেই তো চলছে একপ্রকার হিংসা ও প্রতিহিংসার খেলা। তার তরঙ্গে আমরা নিজেরাও যে সহিষ্ণুতা হারাচ্ছি না, তা নয়। হয়তো আমাদের মনের ভিতরেও হয়ে চলেছে একপ্রকার অভিযোজন, যার কথা আমরা জানতেও পারছি না। কিন্তু এই চলমান ধ্বংসলীলার মধ্যে একজন কবি যখন তাকিয়ে থাকেন, তখন তাঁর অসহায়তা ও পাথর হয়ে যাওয়া দুঃখের ভিতর থাকে একপ্রকার অন্তর্দৃষ্টি। তা অনেকাংশেই হয়তো আবেগপূর্ণ, আবার অনেকাংশেই আবেগ বর্জিতও বটে।
কামরুল বাহার আরিফের কবিতা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন এক অনন্য সহজতার সাধনা তিনি করেছেন সারা জীবন। এইটুকু সহজ সত্যিকার অর্থে এত অসামান্য, যে তা অর্জন করা খুব সহজ নয়। বস্তুত জীবন জীবিকা আর আমাদের বেঁচে থাকা যেখানে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তার স্তর ও স্তরায়নের চাপে আমরাও হারিয়ে যাচ্ছি জটিলতার যন্তরমন্তরে, সেখানে সহজতার সাধনা হতে পারে এই সভ্যতার নিরুপম আশ্রয় ও নিরাময়।
কবিতা মূলত পরিমার্জিত শিল্প, সূক্ষ্মতা এবং সংবেদনশীলতার সমার্থক। কবি অনেকটা জাদুকরের মতো। স্বাচ্ছন্দ্যে হাতের তালু ঘষে পায়রা ওড়ানোর মত, ঝুপ্পুস করে লুকিয়ে ফেলতে পারেন মনখারাপের ছাপ। সব অনুভূতি কবির একান্ত। তেমনই এক অনুভূতির কথা শেয়ার করছি, এই মুহূর্তে একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে খুব। হতাশার বাড়ি কোন দিকে, নর্থে না ইস্টে? কোন ঋতুতে বেশি আসে? ‘ও সর্বনাশ এসো’ বইটি পড়লাম এই কবিতার বইয়ে কোনও আশাবাদ নেই। আশাবাদ থাকার কথাও নয়। কারণ কবি এই কবিতাগুলি লিখতে চাইছেন না। অথচ কবিতা ছাড়া আর অন্য কোনও মাধ্যম নেই তাঁর কাছে যেখানে তিনি এই কথাগুলি বলবেন। এই কথাগুলি কি রাজনৈতিক? রাজনীতি মানে কী? দলীয় বিবাদ? মিছিল, মিটিং, নির্বাচন? বিপ্লব শব্দটি তো এখন আভিধানিক। হয়তো দিবাস্বপ্নে মানুষ উচ্চারণ করে। রাজনীতি মানে তবে কী? কোন দল, কোন গোষ্ঠীর মধ্যে হিংসা নেই? আমরা যদি মানুষ হিসেবে উন্নত না হতে পারলাম, তবে রাজনীতি করেই বা আমরা কী করব? যদি না হিংসার বিপরীতে প্রতিহিংসাকে প্রশ্ন করতে পারলাম, তাহলে আমরা কী রাজনীতি করি? আদিম প্রবৃত্তিগুলিকে আধুনিক অস্ত্র করে তোলার নাম তো রাজনীতি নয়। বা, তারই নাম হয়তো রাজনীতি। আমরা জানি না। কিন্তু এর ফলে কী হয়?
এই ঝুঁকি একজন লেখককে নিতে হয়, অন্তত যিনি, নতুন এক কিন্তু এই ঝুঁকি একজন লেখককে নিতে হয়।
অনুভবের বৈচিত্র্য এবং প্রকাশভঙ্গির সারল্য কখনো কখনো কবিতার সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। কামরুল বাহার আরিফের অনেক কবিতাই তার উদাহরণ। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বচ্ছতা। সেটা অধিকাংশক্ষেত্রেই পাঠককে স্পর্শ করেছে। তাঁর বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ ‘ ‘তুমি জেগে রবে, জেগে রহো’ গ্রন্থের মধ্যে যে ঘন আবেগের স্ফূরণ আছে তা প্রচলিত কবিস্তুতির চেয়ে অনেকটাই স্বতন্ত্র।
অনেক কিছুই আজ স্মৃতি হয়ে উঠে আসছে চোখের সামনে। সেসবের কিছুই আমি বলতে পারছিনা সঙ্গত কারণেই। তবে আরিফ ভাইয়ে কবিতা নিয়ে আমার একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে যা কোনো একদিন খোলসা করা যাবে। তবে একটি কথা না বললেই নয়, যখনই কোনও একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ ওঠে, তখনই তা সকলের কাছে সমান ভাবে গৃহীত হবে কিনা, সে প্রসঙ্গও উঠে আসে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, অনেক সময়ই নতুন কোনও বিষয় সমাজের কাছে সে সময়েই গৃহীত হয় না। পাঠকদের কাছেও না। কারণ, পাঠককে সেই শিল্পকে গ্রহণ করার জন্যেও সমানভাবে দীক্ষিত হতে হয়, প্রস্তুত হতে হয়। এর মানে এটা নয় মোটেই, সেই শিল্প মহাকালের কাছে পরীক্ষিত হয়ে গেল, বা প্রকৃতই তা নতুন! নতুনকে নতুন হয়ে ওঠার পথেও মনে হয় অনেকখানি রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। এ হল নতুনের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব। একজন প্রকৃত শিল্পী বা প্রকৃত শিল্পকে সৃজনের নিরভিসন্ধি নিয়ে রাখা শিল্পীর কাছে এই প্রস্তুতিপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার প্রথম পদক্ষেপ হল, চেনা অভিজ্ঞতার পরিধি থেকে লেখাকে বের করে আনা এবং পরিচিত, গতানুগতিক ও চলতি টেক্সট- আর লিখনের ছাঁচ থেকে আগে লেখাকেই বের করে আনা। ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ঝুঁকি একজন লেখককে নিতে হয়, অন্তত যিনি, নতুন এক কিন্তু এই ঝুঁকি একজন লেখককে নিতে হয়। অন্তত যিনি, নতুন একধরনের অভিজ্ঞতা তৈরি করতে চাইছেন। আরিফ ভাই জীবনভর ঝুঁকি নিয়ে চলা মানুষ, আশা নয় বিশ্বাস আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি ঝুঁকি নিয়ে বাংলার কবিতাঙ্গনকে ঝাঁকিয়ে দিবেন।