পাহাড়ঘেরা প্রকৃতির প্রতি আমার আলাদা একটা ভালো লাগা ছিল আশৈশব। হয়তো সেই সুবাদেই হিমালয়ের হাতছানিতে নেপাল ঘুরতে যাওয়া। যাওয়ার আগে আত্মীয়-বন্ধুদের কেউ কেউ নিরুৎসাহিতও করেছেন। কেউ বলেছেন, সেখানে প্রচণ্ড শীত, কেউ বলেছেন ওটা দরিদ্র দেশ। দেখার কিছু নেই। কেউ বলেছেন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত দেশ। তবু সবকিছুকে উপেক্ষা করে জানুয়ারির প্রচণ্ড শীতেই যাওয়া স্থির করলাম।
অবশ্য নেপাল যাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ যোগালেন কোয়াণ্টাম ফাউন্ডেশন রাজশাহী সেন্টারের শ্রদ্ধেয় মোমেনটিয়ার মেহেদী ভাই। ভ্রমণ আনন্দদায়ক করতে অনেক পরামর্শও দিলেন তিনি। যাই হোক ঘন কুয়াশার কারণে তখন ফ্লাইট বাতিল হচ্ছিল প্রায়ই, কিন্তু আমাদের ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন পেয়ে গেলাম। পাহাড়ি পথে বিমানভ্রমণ অনেকের কাছে আতঙ্কের। ব্যাপারটা বুঝলাম বিমান আকাশে ওড়ার পর। অনেককেই দেখলাম চোখ বন্ধ করে আছেন। বিমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও ঘোষণা এলো জানালায় উঁকিঝুঁকি না দিতে। কিন্তু আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গের গায়ে সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে । কাঠমান্ডুর ত্রিভুবনে ল্যান্ড করার আগেই এ অপার্থিব সৌন্দর্য বিমোহিত করলো। মাইলের পর মাইল তুষারাবৃত অঞ্চল একসময় ধূসর-সবুজ পাহাড়ের গায়ে এসে আছড়ে পড়লো।
প্লেন এসে পৌঁছালো এয়ারপোর্টে। চারদিকে সবুজ পাহাড়বেষ্টিত ছোট্ট ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বিকেলের ঝিরঝিরে শীতল বাতাস আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। নেপালিরা পর্যটনকে সহজ করতে অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ রেখেছে। ত্রিভুবনে নেমে কোনো ঝামেলা ছাড়াই দ্রুত ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দেখলাম। আমাদের প্রধান গন্তব্য ছিল পোখারা। কাঠমান্ডুর সিনামঙ্গলে রাতটুকু কাটিয়ে পরদিন সকাল ছ’টার মধ্যে চলে এলাম কান্তিপথ।
অসংখ্য টুরিস্ট বাস সারি সারি দাঁড়িয়ে। অগ্রিম টিকিট করা ছিল না আমাদের। এজন্য খানিকটা ভাবনা ছিল। কিন্তু দিনের শুরুতে যে বাসটি ছেড়ে যাবে, সেটির টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাদের ভাবনার অবসান করে দিলো বাস স্টপেজে পৌঁছে দেওয়া ট্যাক্সি ড্রাইভার ছেলেটি। তৃতীয় বিশ্বের এ গরিব দেশটিতে যেকোনো প্রয়োজনে হাত বাড়ালেই ট্যাক্সি। তিন সিটের ছোট ছোট ট্যাক্সি এককথায় চমৎকার। ব্যবস্থাটি পর্যটন শিল্পকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়েছে আমার। আরও চমৎকার লেগেছে স্থানীয়দের কমিউনিকেট করার দক্ষতা দেখে। সাধারণ দোকানি, হোটেল বয়, ট্যাক্সি ড্রাইভার—প্রত্যেকেই যোগাযোগ করার মতো ইংরেজি বলতে-বুঝতে পারছে। এ ব্যাপারটি পরবর্তী সময়ে পোখারায়ও লক্ষ করেছি। যাই হোক কাঠমান্ডু থেকে পোখারা দু’শ কি.মি. পথ। এ পথটুকু বাই এয়ারে না কি রোডে যাবো, এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। শেষ পর্যন্ত রোডে যাওয়া ঠিক হলো।
সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল, তা বুঝেছি জার্নির ছয়-সাত ঘণ্টা সময়ের পুরোটাতেই। পাহাড়ের গা বেয়ে চলা পথের ধারে কখনো উপত্যকা, কখনো নদী, ঝরনা, গভীর জঙ্গল। বলতে গেলে পুরো পথটাই এত বৈচিত্র্যমণ্ডিত যে, কখনো ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলেও মন আকুল হয়ে উঠেছে সেসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তবে দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট রেস্টুরেন্টের চা-বিরতিতে। এসব রেসটুরেন্টে পদ্মপাতা আর স্যালোফেন কাগজের পাত্রে খাবার পরিবেশনের রীতি যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি স্বাস্থ্যসম্মতও মনে হয়েছে। ঘুঘনি, ডালের বড়া, আলুর চাটনি, ভাজা মাছ, সবজি বিরিয়ানি কিংবা চাউমিন—এ রকম সাধারণ খাবারের আইটেমে পেয়েছি জিভে জল আসা স্বাদ।
রোপিং কিংবা ঝুলন্ত ব্রিজ ব্যবহার করে মানুষ কিভাবে প্রকৃতির দুর্গমতাকে জয় করেছে, প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা ওদের না দেখলে বুঝি জানা যেতো না। নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় মানুষের বসতি দেখে মনে হয়েছে এরা প্রকৃতির সন্তান। ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ উঁচু উঁচু এ মাটির পাহাড়গুলোর অন্যতম আকর্ষণ মাটির ফাঁকে ফাঁকে ছোট বড় নানান আকৃতির পাথর। নেপালের এ অংশের মাটির বৈশিষ্ট্যই এমন। মাটি সরালেই পাথর। এ পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে পোখারা শহরের রাস্তা-ঘাট, বাড়ির দেয়াল, মেঝে। দারুন আভিজাত্যপূর্ণ এসব স্থাপনা। তবে মাটিতে সম্পদ আছে বলেই যত্রতত্র পাহাড় কেটে পাথর সংগ্রহ কিংবা বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে জমি দখল করার প্রবণতা কম নেপালিদের মধ্যে। বরং নিজেদের আবাসগৃহের পরিসর ছোট রেখে প্রকৃতিকেই জায়গা করে দিয়েছে এরা।
যাই হোক কাঠমান্ডু থেকে পোখারায় যখন পৌঁছলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। লেক সাইট এলাকায় হোটেল পেনিনসুলায় আমাদের অন লাইন বুকিং দেওয়া ছিল, বাস থেকে নেমে ট্যাক্সিতে করে সেখানে আমরা পৌঁছালাম। স্থানীয় ফলের জুস, স্যালোফেন পেপারে মোড়ানো মিষ্টি, বিস্কুট ইত্যাদি দিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের আতিথেয়তা ভোলার নয়। তখন প্রচণ্ড শীত হলেও পোখারার আবহাওয়া ছিল বেশ আরামদায়ক। হালকা গরম পানির শাওয়ার শরীরটাকে আরও ঝরঝরে করে দিলো। গোসল সেরে বিকেলের মিষ্টি আলোয় হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম অন্নপূর্ণা ট্রেইল। সন্ধ্যার পর লেক সাইট মার্কেটে আত্মীয় বন্ধুদের গিফট কিনতে গিয়ে দোকানিদের সঙ্গে অনেক গল্প হলো। ভারতের কাশ্মীর থেকে আসা মুসলমান, স্থানীয় নৃগোষ্ঠী মনে হলো সব জাতি ধর্মের মানুষই পোখারায় ব্যবসা বাণিজ্যের সুবাদে বসবাস করছে। তাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা বেশ চমৎকার। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তার ব্যাপারটাও অনেক ভালো মনে হয়েছে। প্রতিটি দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মেয়েরা কাজ করছে চোখে পড়ার মতো। কোনো বাড়ির বারান্দায় গ্রিল কিংবা কলাপসিবল গেট দেখতে পাইনি। লেক সাইট পার্ক, রেস্টুরেন্টে উঠতি বয়সের যুবক যুবতি যারা সময় কাটাচ্ছে, তাদের আচরণে অদ্ভুত পরিশীলিত, যেটা আমার দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
পরদিন সূর্যোদয় দেখার পালা। যেতে হবে আঁধার থাকতে থাকতে। হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের জিপগাড়িটি ব্যবহারের অনুমতি দিলো। মোবাইলের ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। আজান শুনতে না পেলেও বাংলাদেশের সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ফজরের নামাজ আদায় করলাম আমি ও আমার স্বামী প্রফেসর ড. জালাল উদ্দিন। তারপর যতদূর সম্ভব গরম কাপড়ে নিজেদের আবৃত করে রওনা হলাম সারাংকোট ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশে। সুবহেসাদিকের আলো-আঁধারীতে গভীর গিরি খাদের ধার দিয়ে ক্রমাগত ওপরে উঠতে থাকলো জিপ গাড়ি। এ সময়কার প্রকৃতির যে রূপ তার বর্ণনা দেওয়া সত্যি কষ্টসাধ্য। শুধু এটুকু বলতে পারি, ভয় এবং ভালো লাগায় মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতি তখন আমাদের মধ্যে। সারাংকোটে পৌঁছে দেখি, আমাদের আগেই বহু দর্শনার্থী চলে এসেছে। কেউ চেয়ারে বসেছে, কেউ ওয়াচ টাওয়ারের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়েছে একটি সকালকে ক্যামেরাবন্দি করবে বলে। চারদিক অন্ধকার। দূরে কালো কালো পাহাড় দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। গিরিখাদের গভীর থেকে উঠে এলো লাল আলোর বিন্দু। ধীরে ধীরে তা অবয়ব নিতে থাকলো সেই চিরচেনা দাম্ভিক সূর্যে। অন্যদিকে ক্রমাগত ভার্চুয়াল আলো জ্বলে উঠলো একুশ শতকের মানুষের হাতে হাতে। প্রত্যেকে ক্যামেরা বন্দি করছেন কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটিকে। খানিক বাদেই দেখি সূর্যের উল্টো দিকে অন্নপূর্ণা ট্রেইলের চূড়া হলুদ সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত। এ এমন অপার্থিব সৌন্দর্য, যা ভাষায় বর্ণনা করা দূরূহ ব্যাপার। সূর্যোদয় দেখার পর সারাংকোট ওয়াচটাওয়ার থেকে হোটেলে ফিরে গোসল এবং সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর প্রায় সারাদিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম পোখারার সৌন্দর্যদর্শনে।
আমাদের দু’জনের ছোট্ট টিমের জন্য তিন সিটের ট্যাক্সিক্যাব যথার্থ ছিল। ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে প্রথমে গেলাম স্তুপা। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই প্যাগোডাকে বলা হয় ওয়ার্ল্ড পিস। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে এর শেষ প্রান্তে পৌঁছতে বেশ কয়েক বার থেমে থেমে দম নিতে হলো। নিজের হাঁটু আর হৃৎপিণ্ডের সক্ষমতারও একটা পরীক্ষা হয়ে গেলো যেন এখানে। তবে সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে প্রতিটি বিরতি মনকে দিলো পরম প্রশান্তি। কারণ এর একদিকে লেক ভিউ অন্য দিকগুলোতে নীলাভ-সবুজ উপত্যকা। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য প্রয়োজনীয় নানান সামগ্রী ওখানে বিক্রি হতে দেখলাম। একটা বুদ্ধমূর্তির জন্য আবদার করেছিল আমার ক্লাস থ্রিপড়ুয়া ভাইপো তাসিন। নেপালিদের জাতীয় পোশাকের অংশ নেপালিটুপি ঢাকায় তৈরি হয়, এটা শুনেছিলাম। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি এটা জেনে নেপালি বিক্রেতা সেই তথ্যটি আনন্দের সঙ্গে আমাদের জানালো। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ভাইপোর জন্য বুদ্ধমূর্তি, নেপালি টুপি, চাবির রিং আরও অনেক স্যুভনির সেদিন কেনা হয়েছিল।
স্তুপা থেকে নেমে সিদ্ধার্থ হাইওয়ে ধরে এবার গেলাম গুপ্তেশ্বর মহাদেব কেভ দর্শনে। এবার ক্রমাগত নিচে যাওয়ার পালা। স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে কিছুটা নামতেই গরম গুমোট বাতাস মুখে এসে লাগলো। ওপরে তাকিয়ে দেখি গুহার ছাদ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। টানেলের ভেতর ব্যাকআপ আলোর ব্যবস্থা। তাই হঠাৎ আলো বন্ধ হয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো সব কিছু। চিৎকার করে উঠলো দর্শনার্থীরা। তবে কয়েক সেকেন্ড মাত্র। হাতে হাতে জ্বলে উঠলো মোবাইল ফোনের আলো। তারপর আবার ব্যাকআপ আলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহার ছবি দেখেছি কেবল ইংরেজি ম্যুভি আর গোয়েন্দা উপন্যাসের বর্ণনায়। নিজেকে অমন জায়গায় কখনো কল্পনা করিনি। নিঃশ্বাসের স্বাভাবিক ছন্দে বাধা অনুভব করছিলাম। একবার ভাবলাম ফিরে যাই। স্বামীকে বললামও—আর যাবো না। কিন্তু বললেই তো আর হলো না! পথ একটাই । এ পথে সবাই শুধু আসছে। ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পেতে হলে সবাই যেদিকে চলেছে সেদিকে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। আশপাশে তাকিয়ে দেখি, এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে চলেছেন। আর একজন মহিলা ছোট্ট শিশুকে কোমরের বেল্টে জড়িয়ে প্রকৃতির দুর্গমতাকে জয় করতে এসেছেন। ওঁদের দেখে নিজেকে শাসন করলাম মনে মনে। আমি মেডিটেশনে অভ্যস্ত একজন মানুষ। আমার কেন দম নিতে কষ্ট হবে! বুকে সাহস নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। আরও কিছুটা যেতেই ঝরনার কলকল ধ্বনি আর কিশোর কিশোরীদের উচ্ছলতায় মুখোরিত পরিবেশ থেকে শরীরে এসে লাগলো ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ।
অবশেষে ফিরে যাওয়ার পথটা পেয়ে গেলাম এখানেই। জানা যায় ২৯৫০ মিটার লম্বা এ গুহা আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৬শ শতকে। একদল কৃষক ঘাস কাটতে এসে মাটির নিচের ঝরনা ও গুহার সন্ধান পেয়েছিল। তারপর দীর্ঘ সময় ১৯৯১ এসে এ গুহায় প্রবেশের পথ নির্মিত হয়। গুহার ভেতর শিবমূর্তি ছিল বলে বর্তমানে গুহার এক অংশে শিবমন্দির নির্মিত হয়েছে। মাটির নিচের যে ঝরনা, বর্ষায় তাতে পানির ফ্লো খুব বেশি থাকে বলে বছরের সে সময়টা দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধ আছে। গুপ্তেশ্বর মহাদেব কেভ-এর ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার পাশেই ডেভিস ফল। ডেভিস ফলকে( মাটির নিচের ঝরনা) কেন্দ্র করে চমৎকার পার্ক তৈরি করা হয়েছে সেখানে। আসলে গুপ্তেশ্বর মহাদেব কেভ এবং ডেভিস ফল-এর মধ্যে রয়েছে আন্তঃযোগাযোগ। কিন্তু বাইরে মাটির ওপর থেকে তা বুঝতে পারা যায় না। পোখারায় এমন আরও অনেক কেভ (গুহা) রয়েছে। মাহেন্দ্রা এবং ব্যাট কেভ ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
গুপ্তেশ্বর থেকে বেরিয়ে মাহেন্দ্রার ওপরের অংশের পার্কে ঘুরাঘুরি করলাম কিন্তু ভেতরে যাওয়ার আর সাহস হয়নি। আসলে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় যারা তাদের জন্য কেভ উৎকৃষ্ট জায়গা। তবে সঙ্গে একজন গাইড নিতে পারলে আরও ভালো। আমাদের কেভ দর্শনেই যখন দুপুর গড়িয়ে গেলো, পেটে তখন প্রচণ্ড ক্ষুধা। আমরা চাইলাম কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে পরবর্তী দর্শনীয় স্পটে যাবো।
ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে বলার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা। কিন্তু ড্রাইভার কিছুতেই কোনো রেস্টুরেন্টে থামলো না। মনে হলো পোখারার যে ক’টা দর্শনীয় স্থান আজ দিনের আলোর মধ্যে তাকে দেখাতে বলা হয়েছে, সেগুলোতে না যাওয়া পর্যন্ত সে থামবেই না। পেটে চো চো ক্ষুধা নিয়ে আমাদের তখন কাহিল দশা। পোখারা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক রাজু পান্ডে, যিনি আমার স্বামীর এক ছাত্রের মামা। ভদ্রলোক আমাদের নানান সহযোগিতা করেছিলেন পোখারায়। এই ট্যাক্সিক্যাবের ব্যবস্থাটাও তিনি করে দিয়েছিলেন। একবার ভাবলাম রাজু পান্ডেকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। দেখাই যাক না কপালে কী আছে? হ্যান্ড ব্যাগে খাবার পানি আর বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। বিস্কুট-পানিতেই পেট ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করলাম তখনকার মতো। এবার ট্যাক্সি এসে থামলো ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেইন মিউজিয়ামে। বিশাল সবুজ চত্বর। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এখানে দেখা গেলো দর্শনার্থী হিসেবে। মূলত হিমালয়কে কেন্দ্র করে এই মিউজিয়াম। মাউনটেরিয়ানদের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এখানে। আরও তুলে ধরা হয়েছে হিমালয় রেঞ্জে বসবাসকারী নানান জাতি গোষ্ঠির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে বিকেল পাঁচটায় এটি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা যখন ওখানে পৌঁছলাম তখন চারটা বেজে পার হয়ে গেছে। আমাদের অভুক্ত রেখে এখানে ছুটতে ছুটতে আসার কারণটা এবার ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজেই ব্যাখ্যা করলো। লজ্জা পেলাম নিজেদের কাছে। সত্যি তো একবেলা না খেলে কিংবা কিছু কম খেলে কী এমন ক্ষতি! মিউজিয়াম দেখা শেষে সেদিন বিকেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরেছিলাম এক মাড়োয়ারি রেস্টুরেন্টে। বিশাল আকারের মসালা দোসা, জেরি (জিলাপি) আর রস মালাইয়ের স্বাদ যেন এখনো জিভে লেগে আছে। এরপর ঠিক সূর্যাস্তের আগ দিয়ে পৌঁছলাম ফেওয়া লেক। সূর্যের গোলাপি আভা তখন লেকের পানিতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। বোটিং শেষে অনেকে জেটিতে নামছেন, কেউ কেউ তখনো লেকের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বোটিং করছেন।
আসলে পোখারা শব্দের অর্থই হচ্ছে লেক। পোখারা শহরে মোট আটটি লেক রয়েছে, ফেওয়া যার মধ্যে অন্যতম। পর্যটকরা ট্যাক্সিতে না ঘুরে কেউ কেউ দিনমানের জন্য লেকের পানিতে বোটিং এ চলে যান । এ পথেই তাঁরা অন্নপূর্ণা ট্রেইলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। জেটির পাশে এক বিশাল আকারের সাইনবোর্ডে দেখলাম নানান ধরনের বোটিং এর দর-দাম উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় লেকের স্বচ্ছ নীল পানিতে বোটিং করা সম্ভব হয়নি। এক রকম অতৃপ্ত মন নিয়েই পরদিন ফিরে এলাম কাঠমান্ডু। ফিরতি পথে নাগোরকোট যাবার একটা ছক এঁকেছিলাম মনে মনে কিন্তু সেটাও আর বাস্তবায়ন করা যায়নি। কারণ পোখরা থেকে কাঠমান্ডু আসতে গিয়ে পড়ে গেলাম আমাদের অতি পরিচিত সমস্যা সেই যানজটে। ঢাকার মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেলো রাস্তায়। সব দেখে শুনে মনে হয়েছে পোখারা শহরকে নেপালিরা যতটা উপযুক্ত করেছে পর্যটকদের জন্য, রাজধানী শহর কাঠমান্ডুকে ততটা গুছিয়ে নিতে পারেনি। কিংবা রাজধানীতে বাস করা মানুষ হয়তো অপেক্ষাকৃত ঠগবাজ। কারণ পাহাড় কেটে বাড়ি ঘর বানানো, রাস্তা দখলে নিয়ে বাণিজ্য করার প্রবণতা এখানে লক্ষ করা গেছে। ফল হিসেবে যানজট।
২০১৫ সালের ভূমিকম্পে কাঠমান্ডু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বেশি মাত্রায়। হয়তো সেকারণে এখনো সারাশহরে ধূলার এত প্রকোপ। অবশ্য কাঠমান্ডুর থামেল এলাকাটি তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন, গুছানো। মন্দিরের শহর কাঠমান্ডু একবেলার মধ্যে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তবে ফিরতি ফ্লাইটে ওঠার আগে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দরবার স্কয়ার, নারায়াণহিতি প্যালেস, পশুপতি মন্দির ঘুরে এসেছিলাম। শেষ মুহূর্তে পশুপতি দর্শনের যে অভিজ্ঞতা, সেটাও রীতিমতো মনে রাখার মতো। বাগমতি নদীর তীরে অবস্থিত এ মন্দিরের গেটে আমাদের ট্যাক্সি থামতেই দেবতাকে অর্ঘ্য দেওয়ার নানান সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে এলো বিক্রেতারা। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমরা দর্শনার্থী। ট্যাক্সি ড্রাইভার ছেলেটি কী বুঝলো জানি না, মনে হলো সে আমাদের একা ছেড়ে দিতে চায় না। বলতে গেলে সে নিজেই গাইডের ভূমিকা নিয়ে নিলো। মন্দির কম্পাউন্ডের বিশাল চত্বরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ও আমাদের জুতো, স্যান্ডেল খুলে রাখার শুধু পরামর্শই দিলো না, তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলো। তারপর পইপই করে সাবধান করলো দেবতার ছবি তোলার ব্যাপারে। আমরাও সম্মতি দিয়ে খালি পায়ে এগিয়ে গেলাম মূল বেদীর দিকে। কিন্তু বেশ খানিকটা যাওয়ার পরে বিস্ময়ে থেমে যেতে হলো আমাদের। যথেষ্ট উঁচু এক বেদীর ওপর প্রমাণ সাইজের ব্রোঞ্জের তৈরি এক গরুর ভাস্কর্য । অসম্ভব গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সেখানে। শতশত ভক্ত এই বেদীর নিচে নীরবে অর্ঘ্য দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমার হাজব্যান্ড, ছবি তোলা ওঁর একরকম নেশা বলা যায়। বেচারা সেলফি তুলতে ক্যামেরা অন করেছেন। আর যায় কোথায়! মন্দিরের এক সেবিকা তেড়ে চলে এলো। দেবতার অপমান হয়েছে। যত ছবি তোলা হয়েছে সব মুছে ফেলো, নেপালি ভাষায় রীতিমতো বকতে শুরু করল মেয়েটি। ড্রাইভার ছেলেটি দেবতাকে প্রণাম করে এবার ছুটে চলে এলো এদিকে। দ্রুত মধ্যস্থতা করে ওদের বুঝিয়ে দিলো, না দেবতার কোনো অপমান হয়নি। কারণ দেবতার কোনো ছবিই তোলা হয়নি এ ক্যামেরায়। মন্দিরের সেবিকা মেয়েটি চুপ করে গেলো। আমরা মুগ্ধ হলাম সাধারণ এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের বুদ্ধিমত্তায় এবং মানবিকতায়। বুঝতে পারলাম, কেন সে আপনা থেকেই এখানে গাইডের ভূমিকা নিয়েছিল।