স্বতঃস্ফূর্ত উৎসধারার মধ্যে যে বেহালা বাদক শুনিয়ে যান ম্যাজিক বাটনে জমে থাকা ধুলোর গান, তিনি হচ্ছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। ‘আলপিনধর্মের ইচ্ছে বিজ্ঞান’র কাছে একদিন দীঘল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন-একটি গোলকে যে কোটি কোটি আলপিন বিঁধে আছে তারা সবাই নিউটনের মধ্যাকর্ষণ সূত্র মানে কি না? না মানলেও কবির হাতের মুঠোয় খুলে যায় কবিতার চৌম্বকতরঙ্গ। কবি দ্যাখেন তার তিন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে প্রস্তরগোলকে, ছুটছে গ্রহ-নক্ষত্র, তবু গ্যালাক্সির আধোছায়া পথগুলো ভীষণ ব্যস্ততায় থামিয়ে দিয়ে ধীর লয়ে শুনছে সে সব শব্দের নান্দনিকতা। কবি ধ্বনিপুঞ্জের যে আবির ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার শস্যক্ষেত্রে, সেখান থেকে পথ নেমে গেছে দিগন্তের সীমান্ত রেখায়। হঠাৎ কবি চাইলেন কবিতার পাতায় দেখবেন উটপাখির ডানা থেকে ঝরে পড়া ম্লান-জোসনার ছায়ালিপি, অমনি বেলান্তের ছায়া মেখে একদল উটপাখি রেখে গেলো কবোষ্ণ সংলাপ। সেই থেকে কবি খোঁজেন ডানার বেনামী স্মৃতিমাঠ, লালমাটিয়ার প্রস্তর যুগে ফেলে যাওয়া কোনো পলাতক জাদুকরের বিরহী পদ্য। শীতের পাখিরা যেমন ডানার গভীরাঞ্চলে লুকিয়ে রাখে লুট হতে হতে বেঁচে যাওয়া স্বপ্নের ক্ষয়িষ্ণু ধুলোচিহ্ন, তেমনি কবিও লুকিয়ে রাখেন এক বিশাল আকাশের মতো স্বপ্নকে। কবি মনে করেন, স্বপ্ন না দেখলে কবিতা লেখা যায় না, আর দুঃস্বপ্ন তো কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায় কবিতা লিখিয়ে নেওয়ার জন্যই। কবি কাজী জহিরুল ইসলাম চুলরেখা ধরে হেঁটে যান বালকদিনে অথবা পুরনো কোনো ঋণের কাছে; নিজেকে বারবার ধরা দেন জল, সাঁতার কিংবা ভাঙা সন্ধ্যাবেলায়; কোনো গোল টেবিলে পড়ে থাকা মার্বেলখণ্ডগুলোর কাছে, পড়া যাক কবির কবিতা–
রোদে ভেজা শীত, কী মিষ্টি, কৈশোরচুমুকরোজ্জল
মরা বৃক্ষ এক পুরোনো খুব, নতুন জানালায় বাঁধা
পেছনে আকাশ, কোজাগরী, রঙ পাল্টায় দ্রুত
এই দেখি নীল, আবার এই দেখি ভয়ঙ্কর শাদা।শনশন বাতাস, কাচে, শার্শিতে মাতাল দুঃশাসন
মরা ডালে মর্মর প্রহর, ভেঙে পড়ে মার্চের উঠোনে
ইলেকট্রিক পোল থেকে আকাশে লাফ দেয় কাঠবেড়ালি
ছায়ামানুষেরা আলোপোহায় আর রোদের কনসার্ট শোনে।
কবি কাজী জহিরুল ইসলাম যখন লেখেন ‘রোদে ভেজা শীত’-শীত যেন শুকিয়ে নেয় শরীর, রোদে পিঠে হ্যালান দিয়ে। আবার লিখেছেন ‘কী মিষ্টি’—মানে মিষ্টির প্রকার; হয়তো এমন করে কেউ ভাবে না–মিষ্টি রোদ্দুরের আবার কোনো প্রকার থাকতে পারে। আবার লিখেছেন- ‘কৈশোরচুমুকরোজ্জ্বল’-যেন কৈশোরে চুমুকে চুমুকে গিলেছেন রৌদ্রের উজ্জ্বল আভা। আবার এই কবিতার শেষ বাক্যে একটি শব্দ ঠিক অন্যরকম দ্যোতনায় পাঠককে বেঁধে ফেলেছেন-‘আলোপোহায়’। আলো পোহাতে এসে শঙ্খচিল রেখে গিয়েছিল পায়ের চিহ্ন, কবি সে পায়ের চিহ্ন ধরে ধরে এগিয়েছেন অজস্র অযুত মাইল।
শীত চলে গেলে প্রকৃতির কিছু কারুকাজ চোখে পড়ে। কবি লেখেন–‘মরা ডালে মর্মর প্রহর, ভেঙে পড়ে মার্চের উঠোনে।’ কবি বসন্ত না লিখে মার্চ কেন লিখলেন? রোদের সঙ্গীতানুষ্ঠান না লিখে ‘রোদের কনসার্ট’ কেন লিখলেন? উত্তর অনেক কিছুই হতে পারে কিন্তু একটুও বেমানান মনে হচ্ছে না। আবার ‘উনত্রিশে মার্চবৃত্তান্ত’ কবিতায় লিখেছেন—‘উনশয্যায় স্বপ্নসিক্ত মিলেনিয়ামদৃষ্টি’। এমন মানানসই সমন্বয় তৈরি করেছে যা সামাজিক দৈনন্দিন জীবনে একান্তই সঙ্গত। আরও কিছু গৃহস্থালির ইংরেজি শব্দ যেমন- ‘অডিটোরিয়ামের ফ্লোরে’, ‘ফায়ার প্লেস’, ‘প্রেজেন্টেশন’, ‘ইলেকট্রিক পোল’, ‘ইনবক্স’ প্রভৃতি।
সাধারণ মানুষের আকাশ দর্শন আর একজন কবির উপলব্ধি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। কবি অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে গভীরে নেমে যান, আরও গভীরে; সহসা টের পান অনিয়ম আর অরাজকতা। অচল মুদ্রা হাতে নিয়ে জেনে যান এ পৃথিবী বদলে গেছে। চেনা মানুষ, পরিচিত উত্তুরে হাওয়া কিংবা পোড়া গন্ধ, সবই কবির নখদর্পণে তবু স্বার্থান্বেষী মানুষ বড্ড বেশি লোভী আর বেপরোয়া। কবি অপেক্ষা করেন শেষ দৃশ্যের জন্য; সূর্য অস্ত গেলে ফিরে যাবেন আপন গৃহে, নিয়ে যাবেন রোদ্দুর ভেজা কিছু সুখ-কথা। কিন্তু কবি দ্বিধায় থাকেন, পৃথিবীর মানুষ যেন সময়ের চেয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি কথাও। কবি কাজী জহিরুল ইসলাম বর্ষা ফলকের ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এই সমাজকে অবলোকন করেন এভাবে—
সৈকতে দাঁড়িয়ে ওরা মেয়েদের নগ্ন শরীর দেখে,
আমি দেখি পুড়ে যাওয়া নগর,
ওরা দেখে মেয়েটির নীল চোখ,
আমি দেখি দুটি দেশলাই-কাঠির মাথায় বারুদপিণ্ড বিস্ফোরোনুন্মুখ।
ওরা সমুদ্রের ঢেউ দেখে, আমি দেখি আগ্রাসন
ওরা আকাশ দেখে, আমি দেখি শরণার্থী শিবির, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু
ওরা দেখে বাগান, গোলাপের গুচ্—
অথচ ওরা জানে না, এটা বাগান নয়, সংখ্যালঘুদের মিছিল…
কবি সুদূর নিউইয়র্কে বসে ভুলে যাননি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনের কথা। বৃষ্টি যে তাদের বারবার গৃহহারা করে দেয়, তা তিনি বুকের মধ্যে লালন করেছেন। ‘সাঁওতাল শিশু’ শুধু কবিতা লেখার জন্য কবিতা নয়। চোখের জ্বলন্ত আগুন আর বুকের যাতনা মিশে একাকার হয়ে যখন কাগজ কলম বা কম্পিউটারের কিবোর্ডে নড়ে চড়ে বসে, ঠিক তখনই এক অন্যরকম অবয়ব দাঁড়িয়ে যায়; আর তাই হলো কবিতা। কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় সেই সব শরৎ সন্ধ্যার কথা; সেই সব দিনাতিপাতের কথা; সেই রাঙাগ্রাম, ইক্ষুর শেকড়ের কথা রয়েছে। তিনি লিখেছেন—
কাক আর কুকুরের সাথে দ্বৈরথে ওরা হেরে যায়
‘হামার সোনার লাগি জুটবে লাই এক মুঠো চাল?’
সাঁওতাল রমণীর চিৎকারে উনুনে আগুন জ্বলে
শিশুরা কুড়িয়ে আনে রাজনৈতিক পোস্টার
এর চেয়ে দাহ্য আর কি আছে উনুন ধরাবার।জ্বলছে আগুন সাঁওতাল পল্লীতে,
জ্বলছে আগুন সাঁওতাল চুল্লিতে…পুড়ে যাচ্ছে জয়পুর, মাদারপুর
পুড়ে যাচ্ছে পোস্টার, নেতার ছবি…এর চেয়ে দাহ্য আর
কী আছে আগুন জ্বালাবার।
এ সমাজ এখন বিভক্তির সমীকরণে বিভাজিত। যে ছিল রোদের সতীর্থ, সেও যেন ফাঁকি দিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে ওদের পাথেয়। কবি নিখুঁতভাবে রূপায়ন করেছেন প্রতিটি শব্দ; ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন দৃশ্যপট—‘বাড়ি? অনেক দূরে, পেছনে, ওই চুলরেখার ওপারে/ এই গাছটির নিচে রেখেছি একান্ন-দেহ/ আরো একবার বসেছিলাম এখানে, দূর বালকদিনে/ জল বেড়েছে অনেক সাঁতারে সাঁতারে।’কবিতায় চিত্রকল্পের সঙ্গে এক গভীর উপলব্ধির তলদেশ উঠে আসে চোখের সামনে। পুরনো চিঠির ধুলো সরাতে সরাতে জুনিপারের শুকনো সুর বেজে ওঠে, কবে যেন ভুল করে একটি লাল টিপ, পাতার ভাঁজে লুকিয়ে গ্যাছিল। কবি সেই সব মায়া আর ঋতুর ঝরানো বসন্তগান নিয়ে হেঁটে যান হাডসন নদীতীরে; আর ভাবতে থাকেন ম্যাজিক বাটনের কথা—
টের পাই তুমি প্রতিদিনের মতো আজো দরজায় এসে দাঁড়িয়েছো
এখানে ওখানে হাত রাখো, ধাক্কা দাও রহস্যের দেয়ালে
কিন্তু খুঁজে পাচ্ছ না ম্যাজিক বাটন, যেখানে ছোঁয়া দিলেই খুলে যাবে প্রবেশপথ
হে পুরুষ, ভালো করে খোঁজো, দেখো, মটর দানার মতো
ছোট্ট এক বোতাম লুকানো আছে বন্ধ দরজার মুখে
ওখানে আঙুল রাখো, মৃদু চাপ দাও, স্পর্শ দাও ভালোবাসার,
খুলে যাবে আরাধ্য দরোজা।
কবি এই কবিতায় যেমন দেখিয়েছেন মেটাফর তেমনি সিমিলি, যেমন শব্দ রুপায়ন তেমনি নান্দনিকতা। গভীরতার তলদেশে এক সাবলীল গতি যেন কবিতা পাঠের আগ্রহকে উসকে দেয়। এটাই কবিতার ম্যাজিক বাটন, যা কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় বিদ্যমান। ‘অশ্রুযতিচিহ্নিত’ কবিতায় কবি এঁকেছেন যেমন ইতিহাসের ক্রন্দিত চিত্র অন্যদিকে এক ভাষা সৈনিকের সুনিপুণ বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন—
আমি খুব স্পষ্টতই দেখতে পাই
অহিউল্লার রক্তস্রোতে ভেসে গেছে ভিনদেশি কমা
উড়ে গেছে দাঁড়ির মিছিল
সেমিকোলনগুলো গলে গলে পড়ছে
আশ্চর্যবোধক কপালের ভাঁজ তলিয়ে গেছে রক্তনদীর অতল গহনে
অহিউল্লার অজেয় রক্তস্রোত বালির বাঁধের মতো উড়িয়ে দিয়েছে
প্রশ্নবোধক চিহ্নের ঝাঁক।
কাজী জহির চিত্রকল্পের পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছেন ইতিহাস বিধৌত অহিউল্লার স্বপ্নপাঁজর, ব্যাকরণের যতিচিহ্নগুলোকে অবলীলায় কবিতার শরীরে বসিয়েছেন। কবি নান্দনিকতার সব ধারা উতরে গিয়ে এক নতুন ধারা উন্মোচন করেছেন। যখন অন্য কবিরা শব্দ ভেঙে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছেন তখন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম শব্দগুলোকে ম্যাজিকাল অ্যাডহেসিভ দিয়ে জোড়া দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক যেমন- তোমার বক্ষবিধৌত রক্তস্রোতবন্দনাশিল্পকাব্য, কিছুই শুনতে পাচ্ছি না ওদের বংশবৃদ্ধিশীৎকারধ্বনি ছাড়া, রোদে ভেজা শীত, কী মিষ্টি, কৈশোরচুমুকরোজ্জ্বল। এভাবে উন্মোচিত হয় নতুন পথের, নতুন অরণ্যলোকে যাত্রা করে কবি এঁকে চলেন ম্যাজিকাল আল্পনা। আর পাঠক কবিতার মধ্যে খুঁজে পান সেইসব ম্যাজিক বাটন।