মন খারাপ। অনেক খারাপ। মাথার ওপর থেকে অভিভাবক আপন মানুষগুলো খসে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন। চারপাশ কেমন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী চলে গেলেন। তার কয়েকদিন আগে চলে গেলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান। তারও কিছুদিন আগে চলে গেলেন পরম শ্রদ্ধাভাজন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
বিখ্যাত এই তিন মনীষী আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। আমি তাদের স্নেহধন্য হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। তাদের এমন চলে যাওয়ায় চারপাশ কেমন শূন্যতার কষ্টভরা মরু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বিবর্ণ হতাশার চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবীর মায়া ভুলে পৃথিবীর নক্ষত্রগুলো কিভাবে যে আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেলেন! কষ্টে বুক ভেঙে আসে। নিঃশ্বাস কেমন ভারী হয়ে আসে। কেমন তপ্ত পানিতে চোখ ভরে থাকে। পৃথিবীর নিয়ম হয়তো এমনই। কিন্তু এমন নিয়মের ভেতর জীবন যে কতটা বেদনা ও কষ্টে বহমান, তা অনেক সময়ই বোঝানো যায় না।
আমার তো এখনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না হাবীবুল্লাহ সিরাজী চলে গেছেন। আর ফিরবেন না কোনো কালেও। যেমন আমার এখনো বিশ্বাস হয় না আমার ছোট ভাই বুলবুল নেই। চলে গেছে নদীর মতো, আর ফিরবে না। প্রায় বছর ঘনিয়ে এলো। মনে হয়, এই তো যেকোনো সময় সে চলে আসবে কিংবা ফোন করবে। কিন্তু আমার এ ধারণা যে ভুল, তা আমিই মানতে পারি না। আবার মেনে তো নিতেই হয়, না নিয়ে তো উপায়ও থাকে না। জীবনের এই এক কঠিন পথ চলা। যে পথের পরতে পরতে বুকভাঙা বেদনা ছড়ানো। যে দিকে তাকাই, মৃত্যু আর মৃতু। সারা পৃথিবীর দেয়ালে টানানো যেন শুধুই মৃত্যুর ছবি। এত মৃত্যু এত এত আপনজন হারিয়ে যে বেঁচে থাকা, সেই বেঁচে থাকাও তো মৃত্যুর ভেতরেই বেঁচে থাকা। একে কি বেঁচে থাকা বলা যায়!
হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে আমি পরম শ্রদ্ধায় ‘স্যার’ সম্বোধন করতাম। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় অগ্রজতুল্য কবি-গবেষক বিলু কবীরের মাধ্যমে। আমি একসময় সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি। সময় হিসেবে তা প্রায় পাঁচ বছর। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্য পুরস্কারের সিদ্ধান্ত হয়। সে উপলক্ষে গঠন করা হয় ‘সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার নির্বাহী কমিটি’। আমি এই কমিটির সদস্যসচিব ছিলাম। পুরস্কারের নীতিমালা অনুযায়ী বাংলা একাডেমি থেকে একজন প্রতিনিধি এই কমিটির নির্বাহী সদস্য থাকবেন। এটা নির্ধারণ করবেন মহাপরিচালক নিজে। তিনি ইচ্ছে করলে কাউকে মনোনয়ন বা নির্ধারণ না করে নিজেই কমিটিতে থাকতে পারবেন। প্রথমবার পুরস্কার দেওয়ার কার্যক্রমের সময় বাংলা একোডেমির মহাপরিচালক ছিলেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। তাকে এই প্রস্তাব দিলে তিনি নিজেই সানন্দে এ কমিটির সদস্য হতে সম্মত হয়েছিলেন। প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে নির্বাহী সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনিও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। এই পুরস্কার বিষয়ে বিশিষ্ট এই দুই মনীষীর সঙ্গে আমার আন্তরিকভাবে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় বারের পুরস্কারের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। তখন নতুন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কখনো কখনো কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়েছে, সালাম বিনিময় হয়েছে। চেনা-জানার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। নীতিমালা অনুযায়ী তিনি বা তার মনোনীত বাংলা একাডেমির একজন কর্মকর্তা নির্বাহী কমিটির সদস্য হবেন। বিলু কবীরকে বিষয়টা জানিয়ে বললাম, ‘আমি দেখা করতে চাই। আপনি একটু অনুমতি নিয়ে দেন।’ বিলু ভাই বললেন, ‘তুমি নিজেই ফোন করো। তিনি তো সবার ফোন ধরেন।’আমি একদিন নিজেই তাকে ফোন দেই। যদিও বিলু কবীর ভাই আগেই তাকে ব্যাপারটি জানিয়ে রেখেছিলেন।
আমি ফোন করে পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, ‘বিলু কবীর তো তোমার কথা বলেছেন।’ আমি পুরস্কার সংক্রান্ত ব্যাপারটি তাকে জানাই। তিনি বললেন, ‘আমি নিজেই থাকবো।’ সঙ্গে আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য সংক্রান্ত যেকোনো কাজেই আমাকে যুক্ত রাখতে পারো।’ কমিটিতে শামসুজ্জামান খানও থাকলেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজীও যুক্ত হলেন। আনিসুজ্জামান তো মধ্যমণি হয়ে আছেনই। তিন মনীষীর সঙ্গে তখন আমার নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ ঘটেছে। আগে থেকেই আনিসুজ্জামান ও শামসুজ্জামান খানের স্নেহধন্য হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আপনি শারীরিকভাবে অন্তর্ধান হলেও বাংলা সাহিত্যে আপনার সৃষ্টিকর্ম অমর হয়ে থাকবে। আর আমাদের শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আপনি বেঁচে থাকবেন, যতদিন বাঙালি সত্তা পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।
অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী যেদিন সাহিত্য পুরস্কারের প্রথম মিটিংয়ে এলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এসে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘রকিব, আমি তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে।’ আমি দ্রুত তার কাছে আসতেই একটু দূরে সরে গিয়ে, এক রকম আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরালেন। হাসিমুখে বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে তো এসব খাওয়া যাবে না। এখানে একটু খেয়ে যাই।’ এরপর থেকে তার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতে থাকে। খুব দ্রুত আন্তরিক একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিলু কবীর ভাইয়ের কারণেও তিনি খুব দ্রুত আমাকে তার স্নেহের জায়গাটিতে স্থান দিয়েছিলেন বলে ধারণা করি। দ্বিতীয়বারের পুরস্কার দেওয়ার কয়েক মাস পরে আমি কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই।
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর এখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করি। একুশের ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আমি সিরাজীকে ফোন করে বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাব দেই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকার জন্য। চিন্তিত ছিলাম তিনি রাজি হন কি না! আবার এটুকুও ভরসা ছিল, তিনি আমাকে যতটা স্নেহ করেন, তাতে না করবেন না। আমার ভাবনা সত্যি হলো। তিনি হাসি মুখে বললেন, ‘অনুষ্ঠানের দিন সকালে একটু মনে করে দিও।’ অনুষ্ঠানে এলেন। মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা করলেন। সবার মন জয় করে নিলেন। বাংলা বিভাগের জন্য বাংলা একাডেমির বই উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। একদিন বাংলা একাডেমিতে গিয়ে সেই বইও আমরা নিয়ে আসি। এরপর দিনে দিনে সম্পর্কের গভীরতায় ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয়েছে, কথা হয়েছে। তিনি ফোন করলেই প্রাণবন্ত কণ্ঠে বলতেন, ‘রকিব, কেমন আছ?’ কত আপন সেই কণ্ঠ।
তাকে নিয়ে বিশেষ একটি বেদনা থেকেই গেলো আমার। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণা’ পিআররিভিউ জার্নাল প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও
হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেই আমরা। কিন্তু তারা রাজি হবেন কি না, এ নিয়ে আমার একটা সংশয় থেকে যায়। তাই প্রথমে শামসুজ্জামান খানকে ফোন করে বিষয়টি জানাতেই তিনি বললেন, ‘এটা তো অনেক ভালো কাজ। করো। আমি তোমাদের সাথে আছি।’ অনেক খানি ভারমুক্ত হয়ে তারপর ফোন করি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে। তিনি বিষয়টি জেনে বললেন, ‘তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সংক্রান্ত যেকোনো কাজের সঙ্গেই আমাকে যুক্ত রাখতে পারো। তোমাদের জার্নাল প্রকাশনার সঙ্গে আমার সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে।’জার্নাল বের হয়েছে। এমন এক সময় বের হয়েছে, যা আনন্দের পরিবর্তে গভীর বেদনা তৈরি করেছে। করোনার ভয়াবহতায় দুই মনীষীর কারও কাছে গিয়েই জার্নালটি তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি। এই কষ্ট অনেককাল আমাকে পোড়াবে।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তার সমসাময়িকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি। বাংলা কবিতায় তার নিজস্বতা সুনির্দিষ্ট। উপন্যাসেও তার কৃতিত্ব রয়েছে। ছড়া-পদ্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা; সব ক্ষেত্রেই তিনি তার প্রতিভার অসামান্য স্বাক্ষর রেখেছেন। ভালো সংগঠক ছিলেন। জাতীয় কবিতা পরিষদে একাধিকবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্র। প্রকৌশলী হয়েও কবিতাকেই ধ্যানজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবি হিসিবে বাংলা একোডেমি ও একুশে পদকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। কিন্তু মানুষটির জীবযাপনে এসবের কোনো প্রকাশ ছিল না। প্রভাব ছিল না। অহংবোধ ছিল না। সাদাসিধে সাধারণ ও আন্তরিকতাপূর্ণ হৃদয়বান একজন মানুষ হিসেবেই তিনি সবার কাছে অসামান্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।
পরম শ্রদ্ধাভাজন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আপনি শারীরিকভাবে অন্তর্ধান হলেও বাংলা সাহিত্যে আপনার সৃষ্টিকর্ম অমর হয়ে থাকবে। আর আমাদের শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আপনি বেঁচে থাকবেন, যতদিন বাঙালি সত্তা পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।
প্রিয় কবি, আপনার পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।