প্রেম, আবেগ ও ভালোবাসাকে অনুভব করতে না পারলে যেমন সত্যিকারের প্রেমিক হওয়া যায় না, তেমনি ওইগুলোকে ধারণ করে ভাষায় প্রকাশ ঘটাতে না পারলেও কবি হওয়া যায় না। গতানুগতিক সামাজিক বলয়ে থেকে হয়তো একটা বা দুটো অনুভূতি প্রসব করা যায়, তবে আবেগের দুর্দান্ত প্রলয় অনুভব করতে হলে চিরন্তন বলয়ের বাইরে এসে তা উপলদ্ধি করতে হয়। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন কার্ডিফে বসবাসকারী কবি মুনিরা চৌধুরী। সমাজের সংস্কার নামক কুসংস্কারগুলো বারবারই তাকে পীড়া দিতো। তাই তারই ঊর্ধ্বে ছিল তার বসবাস।
পশ্চিমা শিক্ষার পাশাপাশি বাংলাভাষায় ছিল তার অবাধ বিচরণ এবং সমান্তরালভাবে সংস্কৃতিচর্চায়ও ছিলেন একজন পরিশুদ্ধ ত্যাগী দেশপ্রেমিক। ইংল্যান্ডের বুকে বাংলা একাডেমির ধারক ও বাহক হয়ে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন সময়, শ্রম, মেধামনন ও অর্জিত অর্থাবলি। প্রবাসে যারা বসবাস করেন, তারা বোঝেন বিদেশে বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো কত কষ্টসাধ্যের ব্যাপার। কবি মুনিরা খুব কম দিনেই সবধরনের প্রতিকুলতাকে তুচ্ছ করে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিজের লেখা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দ্বারা দেশেবিদেশে প্রগতিশীল গুণীজনদের মহলে একটি স্থায়ী আসন গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কবি মুনিরা চৌধুরীর লেখা কাব্যগ্রন্থগুলো পর্যালাচনা করলে একধরনের ত্রিমাত্রিক ভাববিন্যাসের ধারা দৃশ্যমান হয়, যা আমার দৃষ্টিতে আধুনিক বাংলাকাব্যের মৌলিক রূপক; যা ছিল জীবন, দর্শণ ও পুরাণ মিশ্রিত। প্রবাসীকবি প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর লেখায়ও তা বিদ্যমান ছিল। যে কারণে এই ধারার কাব্যচর্চায় ছিলেন তারা একে অন্যের পরিপূরক। কাব্যচর্চার পাশাপাশি সঙ্গীতের ওপরেও তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। কাব্যরসে ভরপুর এই মহিয়সী একটি কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, ‘খুব সখ ছিল গান শেখার। তবে সা রে গার পর মা’তে এসে আটকে যাই। কারণ, মা’য়ের ওপর আর কিছু আমার মাথায় ঢোকে না!’ কত সুন্দর বিনয়ী হয়ে আবেগ ঢেলে দেশমাতাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে নিজে না গেয়ে শুধু শ্রোতা হয়ে উপভোগ করতেন প্রতিটি সুর ও গীতিকবিতার গাঁথুনি।এই ক্ষনজন্মা, প্রথিতযশা রমণীর আচারব্যবহারে ছিল কৌলিণ্যের সঙ্গে প্রগতিশীলতার ছাপ, যা তার কাব্যচর্চাতেও পশ্চিমা ও প্রাশ্চাত্যের উপাদানগুলো দৃঢভাবে প্রতীয়মান ছিল।
মৃত্যু নিয়ে তার চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে একটি কবিতা রচনার পরবর্তী প্রসব ছিল তারই স্বয়ং অন্তর্ধান। যেমন:
মৃত্যু, মুনিরাহেনা…
আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে
নীল-বর্ণ আলো ঝরছে
নরক প্রদেশে।নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী…
দু’চোখ ছিদ্র করে
গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি
এই গাছ স্বর্গের গাছ
এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটেওহ ঈশ্বর
সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে
সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছেতুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাসনাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!
এই নশ্বর দেহের চেয়েও যে আত্মার বিস্তৃতি সীমাহীন, তা কবি নিজেই গেলেন সেই অনুসন্ধানে, বিনিময়ে পেছনে রেখে গেলেন আমার মতো অসংখ্য গুণগ্রাহী। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।