ধরা যাক—এ শহর কবিতার নয়, কবির নয়। এরপরও তো এই শহরে এক সময় আবুল হাসান ছিলেন। ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। ছিলেন শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ।
কবিতাও তো ছিল, নাহলে আবুল হাসান কী করে বললেন—‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে’। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ গাইলেন, ‘অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই’।
অলৌকিক ইস্টিমার-র কবি হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল/ ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান/ ভালো থেকো’। শামসুর রাহমান বলে গেলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান’। এবং এই শহরে কদিন আগেও ছিলেন কবি রফিক আজাদ। তিনিও চলে গেলেন শেষ শয্যায়। ‘এখনো এপারে আছি, চ’লে যাব সুতোর ওপারে,/ সুতোর ওপারে সুখ, সম্ভবত স্বাধীনতা আছে’।—এটা রফিক আজাদেরই উচ্চারণ।
সুতোর ওপারে কী আছে আর নেই—তা আমরা জানি না, জানতে চাই না, তবে এটুকু জানি, কবি চলে গেলে শহর তার শ্রী হারায়, প্রাণ হারায়। কবি আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্রাণ কিংবদন্তী। কবি হুমায়ুন আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ফুলার রোড, একুশের বই মেলার আলো ছিলেন। আর শামসুর রাহমান পুরো শহরের রূপ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে।
রেখে গেছেন ‘কবিতার পাগলামি’
যুগ-যন্ত্রণা, প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করে, পঙ্কিলতাকে ঠেলে ঠেলে শেষ পর্যন্ত কবিতার সঙ্গেই জীবন-যান করেছেন তারা। কবিতাকেই জীবনের ধ্রুবতারা মেনেছেন। কবিতা, কেবল কবিতার জন্য অমরত্বকে তাচ্ছিল্য করেছেন। তারপর রণ-হিংসা আর ক্রুরতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে প্রবল অভিমানে হয়তো চলে গেছেন তারা, কিন্তু এ শহর আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন ‘কবিতার পাগলামি’।
আবুল হাসান আর নির্মলেন্দু গুণের বন্ধুত্ব যতটা খ্যাতি পেয়েছে সময় ছাপিয়ে, তারচেয়েও কবিতা নিয়ে শহরময় তাদের ‘পাগলামী’ হয়ে আছে কিংবদন্তী। যারা সৃষ্টি করেন, যারা নতুন কথা বলেন, তাঁরা একটু অন্যরকম হবেন, এটাই স্বভাব-সুন্দর।
এই শহরের একজন অন্যরকম মানুষ আছেন, তিনি হেলাল হাফিজ। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র কবি তিনি। টাকা নয়, কবিতায় মানুষ জমাতে চেয়েছেন তিনি। দীর্ঘকাল ধরে তা-ই করে চলেছেন। সামান্য কিছু সুখস্মৃতি নয়, বেদনাকেই জীবনব্যাপী মনে রাখতে চান তিনি। বলেন, নান্দনিক বেদনা দেওয়ার মানুষের বড্ড অভাব এ শহরে। বসন্তের এক সকালে কবির মুখোমুখি হয়ে জেনে নেওয়া গেলো প্রেম এবং প্রেমই একমাত্র আরাধ্য সত্য তার কাছে।
আবুল হাসানকে আমি দেখিনি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে শ্রদ্ধাষ্পদ দূরত্ব রেখে কথা হয়েছে কয়েক দফা। স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখনো তাঁকে গ্রেফতার করেনি। একুশের বইমেলায় সাপ্তাহিক পূর্বাভাস পত্রিকার হয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার কাছে প্রতিক্রিয়া চাইলাম। তিনি একটু রাগী ভঙ্গিতে বললেন, ‘এরশাদ কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শ্বশুর হয় যে, তাকে এখনো গ্রেফতার করা হচ্ছে না।’
কবিতার ‘রাজপুত্র’ ছিলেন তিনি
প্রথা আর মঞ্চবিরোধী ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তবে বইমেলা ছিল তাঁর খোলা দরজা। সেই দরজা দিয়ে আমরা ঢুকে যেতাম। তার নিকটবর্তী হতাম। এবং প্রতিদিন শুনতাম নতুন-নতুন কথা। হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা মানে নতুনকে হত্যা করা হয়েছে। সাহসকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। তার চলে যাওয়ায় শহর কবিহারা, কবিতাহারা হয়েছে পুনর্বার।
আর শামসুর রাহমান? এই শহর আর কবিতার ‘রাজপুত্র’ ছিলেন তিনি। কবিতার মতো মানুষের সংগ্রামে রাজপথে হেঁটেছেন সময়ের হাত ধরে। ছুটে গেছেন বিপন্ন মানুষের কাছে। তাঁর বিদায়ে শহর অশ্রুসজল হয়েছে।
চলে যাওয়ার এ ধারায় সর্বশেষ যোগ হলেন রফিক আজাদ। তাঁর যাওয়ায় আরও একবার প্রাণহীন হয়ে পড়ল শামসুর রাহমানের ‘স্মৃতির শহর।’
দিনে দিনে শহর বিস্তার লাভ করেছে। বেড়েছে রণ-হিংসা, হাহাকার। পাখিরা উড়ে গেছে নীরবতা না পেয়ে। গাছ-বাগান বিরান করে তোলা হয়েছে ইমারত। কবিতার শহর একটু-একটু করে পরিণত হয়েছে টাকা আর খুনের শহরে। কবিতার লালিত্য নেই, আছে বেঁচে থাকার নিত্য হাহাকার।
তবে, এই ‘নাই’র মধ্যে এখনো কবি শূন্য হয়ে পড়েনি এ শহর। ‘সোনালী কাবিন’র কবি আল মাহমুদ, তাঁর দৃষ্টি প্রায় ক্ষয়ে গেছে। তিনি এখন আর ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ লিখতে পারেন না। জরা আক্রে ধরেছে তাকে। তারপরও তিনি এক ধরনের আলো হয়ে আছেন এ শহরের এক কোণায়, নিজের মতো।
কবি হেলাল হাফিজের কথা একটু বলা হয়েছে আগেই। ঘর নেই, সংসার নেই, তিনি এই শহরে আছেন তাঁর মতো করে তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নিয়ে।
প্রকৃত কবিদের কদর করুক শহর
‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’র কবি নির্মলেন্দু গুণ এখনো এই শহরের ব্যতিক্রমী এক চরিত্র। কবিতার অভিমানে ভর করে এখনো তিনি বিদ্রোহ করতে পারেন। ফেসবুকে লিখে দিতে পারেন তাঁর ‘চাহিদা’ আর বেদনার কাব্য।
‘এই গৃহ এই সন্নাস’র কবি মহাদেব সাহা, এখনো সটান হেঁটে গেলে এই শহরে, মনে হয় একটি সুললিত কবিতা হাঁটছে তাঁর পায়ে-পায়ে।
আরও, আরও অনেক তরুণ ‘উজ্জ্বল’ কবি আছেন, তাঁরা হয়ত অনেক সময় পাবেন, কিন্তু যারা, যে কোনও সময় চলে যেতে পারেন রফিক আজাদের মতো, তাদের খবর কতটুকু জানে এ শহর?
আর জানলেই বা কি? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—কবির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে রাজা-রাজ্য। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, কবি, তাঁর কাজ নতুন নতুন পঙ্ক্তি সৃষ্টি করা। অধরা শব্দকে ধরে আনা। তিনি যদি জীবিকার জন্য ছোটেন, তাহলে কবিতা ধরা দেবে কী করে? তাই বলি, সময় থাকতে সবাইকে নয়, প্রকৃত কবিদের কদর করুক শহর। ঢাকা শহর একটু-একটু করে কবি আর কবিতার শহর হয়ে উঠুক।