দীর্ঘ নয়, কিছুটা রোগে ভুগে হঠাৎ-ই কবি রফিক আজাদের মৃত্য হলো আজ (১২ মার্চ, ২০১৬)। অসম এই মৃত্যুকে মেনে নিতে আজ আমি আপসহীন। হয়তো এই উচ্ছ্বাসকে আবেগের প্রলাপ ভাববেন অনেকেই। ভাবুন। কিন্তু আমি হয়তো শুক্লপক্ষের মধ্যরাতেও কবিকে খুঁজতে বেরুব, কেননা ‘মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব’—তখন হয়তো তিনি নিয়মিত পদব্রজে বেরিয়ে পড়বেন। ঘুরবেন তার প্রিয় ‘চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট—কিন্তু ভেতরে-ভেতরে/ খুব শক্তিশালী/ মরণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।’ অতিশয়োক্তি হলেও, বলতে চাই—সামান্য মৃত্যুই একজন কবিকে মুছে ফেলার জন্য যথেষ্ট নয়। কীর্তিমানের মৃত্যু হয় না।
কবি রফিক আজাদের কলমের শ্রেষ্ঠত্বই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকাল—বহুমানুষের সম্মানে। স্বতন্ত্র কবিতায় দীক্ষিত ছিলেন কবি। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ইগো তার জীবন দর্শনের সর্বত্রই স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। কিন্তু আজও কি আমরা তার স্বরচিত আত্মজীবনী ধরতে পেরেছি? আজও কি তার কবিতাগুলো আমাকে অত ভাবায়? হয়তো, এই প্রশ্নের উত্তরে হতবিহ্বল হব, নতুবা কিছু আন্তরিকতার আভাসেই আনির্বচনীয় আমি। তাহলে কবির মৃত্যুতে আমার অন্তরে যে বিষাদ কাজ করছে, এই অদ্ভুত হতাশা কেবল আমার ভেতরেও আজ—কতটা তা!
আমি কোনো কবির জীবনাবসান মানি না। ক্ষণকালের এই মৃত্যু হয়তো সত্য, কিন্তু মৃত্যু যে সব সময়ই বিচ্যুতি, নিঃশেষ বয়ে আনে। এমনটি কিন্তু সবার জন্য নয়। কিছু মানুষের মৃত্যু তাকে এনে দেয় পুনর্জন্মের প্রেক্ষাপট। মেলে দেয় দীক্ষিত সত্তাকে—চূড়ান্ত হয় প্রতিষ্ঠার ঐশ্বর্যগুলো। অনুভূতিগুলো। সৃষ্টির হাজারো পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারিত হচ্ছে কণ্ঠের মহিমায়।
আমরত্বের কাছাকাছি যেতে কবির এই প্রস্থান কি তার গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া সে এক দিগভ্রান্ত পথিক আজ!
কবি রফিক আজাদের কবিতাগুলো তার ঐশ্বর্যের সন্তান। প্রুস্ত যেমন বলেছেন, ‘গ্রন্থসকল নীরবতার সন্তান।… যা বংশানুক্রমে বিক্রিয়া হবে। বিচ্ছুরিত হবে—কীটনাশক। অন্তত সেইসব জ্ঞানপাপীদের বলয় ভাঙবে এবং সুঘ্রাণ প্রচারিত হবে: অপরাহ্নই অন্ধকারের চেয়ে উজ্জ্বল।
তাই, সে আলোর কাছাকাছি হলে আমাকেও বিহ্বল হতে হয়। তবু কবিতায় মূর্খতার বিশ্লেষণ হলে পুরোটাই আমার অজ্ঞতার ভূমি! কখনো মুগ্ধতার ব্যাখ্যায় কবিতার সামান্যতম উপদ্রব—ইশারা আনেকটাই এই অগ্রজের কাব্য থেকে পুণ্যার্জন, যা আমার সৌভাগ্য! কেননা; এখনো নৈঃশব্দ্যে ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’র পাঠ শুনি। প্রতিধ্বনিময় ‘স্পর্শকাতরতাময় এই নাম/ উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,/ আন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা।’
লৌকিক-বাস্তবিক-ঐশ্বরিক, যে যাই বলুক, জীবনানন্দ তো বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’। তাই, আমরত্বের কাছাকাছি যেতে কবির এই প্রস্থান কি তার গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া সে এক দিগভ্রান্ত পথিক আজ!