কবিতা এমন এক মিথ্যার জগৎ যা সত্যের ইশারাকে জাগিয়ে তুলতে প্ররোচিত করে। ভাষাদের শস্যদানা যেভাবে ঘুম থেকে জেগে উঠতে চায়, সেই জেগে ওঠার প্রকরণকৌশলের পরিণত প্রকাশই কবিতা; যা হতে পারে ব্যাকরণ মানতে না চাওয়া বাক্য অথবা বাক্যের ইশারা; অর্থ অথবা অর্থের ইশারা; পরম্পরাহীন আপাতপ্রলাপসদৃশ বাকপ্রবাহ, যা মনোজগতে মন্ত্রতুল্য প্রভাব প্রবাহ করে; ফলে ক্রমশ জেগে উঠতে থাকে জাদুছবি; পক্ষান্তরে যা আপনাকে হিপটোনাইজ অর্থাৎ সম্মোহিত করে। এতে করে আপনি প্রতারিত হতে পারেন; অথচ সেই নন্দননির্ভর প্রতারণা থেকে আপনি দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না নিজেকে। কবিতা এমনই এক জাদুবিদ্যা, যা পক্ষান্তরে মগজের কিয়দংশের ভেতর সৃষ্টি করে হাজার ঝালরবিশিষ্ট জানালা; যে জানালা দিয়ে কোটি বছর ধরে কোটি সৌরবছর অতিক্রম করে আসা মহাজাগতিক রশ্মি প্রবেশের সুযোগ লাভ করে; আর এভাবেই আপনার মগজ যখন আলোকপ্রাপ্ত হয়ে উঠতে থাকে তখন আপনি হয়ে ওঠেন ত্রিকালদ্রষ্টা; স্বয়ং টিরোসিয়াস।
কথাবৃত্তের জলছবি
০১ আগস্ট ২০১৭
দুদিন হলো কুকুর দুটো বাসার সামনে জোড়া লেগে আছে। এইসব অসভ্য দৃশ্যের ভেতর হাঁটছি। কেউ কুকুরমৈথুন দৃশ্যটিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে না রাস্তা থেকে।
মানুষের সাথে কুকুরজন্মের মতো প্রতিনিয়ত কুকুরমৈথুনে লেপটে আছি। কেউ আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে না সমাজ থেকে।
০২ আগস্ট ২০১৭
ছেলেটি পাড়াগাঁর আকাশ থেকে তিনটি তারকা খসিয়ে নিয়ে শহরে এসেছে। একখানা তারকা সে রেখেছিল বাম চোখে; যে চোখ দিয়ে ছেলেটি কাকতাড়ুয়ার জামা গায়ে ফসল পাহারা দিতো। আরেকটি রেখেছিল ডান চোখে; যে চোখ দিয়ে সে তাকিয়ে দেখতো কিভাবে প্রতিদিন স্লেট থেকে মুছে যায় পরিচিত নাম। তৃতীয় তারাটি বুকে চেপে রেখে ছেলেটি এসেছে শহরে। শহরের কোলাহলে দাঁড়িয়ে দেখছে ছেলেটি, ওদের গাঁয়ের সবগুলো তারা ডুবে গেছে আগস্টের জলে। এইভাবে জল থেকে যে প্লাবনের জন্ম হল সেই প্লাবনের গায়ে হাত রেখে বুঝতে পারল ছেলেটি, আমাদের বাম চোখগুলো ডান চোখকে সাথে নিয়ে ভেসে চলেছে ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া পথ ধরে, দায়িত্বহীন, ক্ষুধা ও আশ্রয়বিহীন; অবশেষে আকাশবিহীন।
০৩ আগস্ট ২০১৭
প্রথম দিন ছেলেটি মেয়েটির সৌন্দর্য ভিক্ষা করলো; মেয়েটি মোটেও অবাক না হয়ে জানিয়ে দিলো, এ আর এমন কী চাওয়া, সৌন্দর্য তো বিলিয়ে দেবার জন্য। দ্বিতীয় দিন ছেলেটি মেয়েটির কাছে প্রেম কামনা করলো; মেয়েটি আশাবাদী হলো, এক রাতেই ভিখেরি থেকে অন্ধ কামুক হয়ে উঠেছে যুবক। তৃতীয় দিন ছেলেটি মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাইলো; মেয়েটি কেঁপে উঠলো; বুঝতে পারলো, বাবা ও মাকে বিষ খাইয়ে ছেলেটির সাথে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
০৪ আগস্ট ২০১৭
রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ভালোবাসা এক অন্তহীন রহস্য; একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে বোঝা যায় না ওকে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, কবিকে ছেড়ে গেলে ডুবে যাবে নীলরঙ তরলের ভেতর; যে নীলরঙ তরল থেকে বিষণ্নতা ছেঁকে নিয়ে আমি মানুষের চোখ আঁকি।
আমি রবিঠাকুরের আঁকা চোখের দিকে তাকিয়ে আছি; দেখতে পাচ্ছি চোখের রেটিনা ভেদ করে চলে গেছে পথ; যে পথের ওপর মাটিজীবী শামুক মাটি খুড়ছে এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা অবধি; এভাবে মাটি খুড়তে খুড়তে শামুকটি এক সময় পৌঁছে যাবে ভালোবাসার কাছে।
০৫ আগস্ট ২০১৭
মেঝের টাইলসে আঁকা রয়েছে যে কারুরেখা সেই কারুরেখার মতো আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেছে। তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছো মেঝের ওপর; অথচ তুমি অনুপস্থিত; এই থাকা না থাকার মাঝে যে শূন্যতা সেই রহস্যময় শূন্যতার নাম তুমি। ‘তুমি’ অর্থ, শঙ্খের ভেতর জেগে ওঠা সমুদ্রধ্বনি। আমি সমুদ্র বরাবর যেতে যেতে মধ্যবয়সী কোন এক ধীমতি মহিলার মতো বাড়ির আঙিনায় সাজিয়ে তুলেছি মিথ্যের সমুদ্র; যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছো তুমি সমুদ্র-শিকারি পুরুষ।
০৬ আগস্ট ২০১৭
ছেঁড়া শূন্যতা থেকে বৃষ্টি নেমে এলে গন্ধ ফিরে পাই; মাটিদের শারীরিক ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে আমারও শিশুকাল ছিল। জন্মের পর থেকে দরজার বাইরে মাথা ঠেলে দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি দৃশ্যের দিকে; দেখছি কিভাবে প্রাকৃতিক দৃশ্যসমূহ ক্রমশ নাগরিক হয়ে ওঠে। অতীত পৃথিবী থেকে অতীতসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে মেঘ; বৃষ্টিঘর থেকে ভেসে আসছে শিশুদের কলরব। ভুলে যাচ্ছি এইসব শব্দছবি। পাশে বসে আছে পেইড-প্রেমিকা। কাম শেষে ফিরে গেছে নুনিয়া ঝুমু। মনে পড়ছে না কিছু।
০৭ আগস্ট ২০১৭
সেলাইমেশিন সেলাই করতে শুরু করেছে সন্ধ্যাদের স্কুলড্রেস। সন্ধ্যারা তিনবোন; ওদের স্কুলড্রেস থেকে রাস্তার পাকারোদে ঝরে পড়ছে নীলরঙ। স্কুল থেকে ফেরার সময় তথ্যবহনকারী বিকেলগুলো খসে পড়ছিল সেলাইমেশিনের শব্দের সাথে; যেন বা ফাল্গুনের প্রথমদিন, গাছে গাছে সেলাইমেশিনের শব্দে সেলাই হয়ে যাচ্ছে খসে পড়া পাতা। আর তখন একটা আপেলফল আইনস্টাইনকে অবাক করে দিয়ে মাটির দিকে ছুটে না এসে অভিকর্ষের বিপরীতে ক্রমশ শূন্যতার দিকে ভেসে যেতে থাকলো। সন্ধ্যারা তিনবোন তাকিয়ে আছে শূন্যতার দিকে।
০৮ আগস্ট ২০১৭
তুমি যখন কবিতা পড়ছিলে তখন আমি ঈশ্বরীর শ্বাসগ্রহণের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। কবিতা হল ঈশ্বরী নিঃশ্বাস, জৈবিক ঘ্রাণ। আশলে তুমি হলে সেই ঈশ্বরী, যে থাকে শস্যের সবুজে, ফুলের ঐশ্বর্যে আর আপেলের হৃদয়ে। তোমার ঠোঁট স্পর্শ করা মাত্র ঈশ্বরীর সুগন্ধে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকলাম।
০৯ আগস্ট ২০১৭
মোমবাতি জ্বালছে, মায়া ও জাদুকরী; অনেকটা তোমার চোখ থেকে গড়িয়ে নামা কথার মতো; জ্বলন্ত মোমের মতো গলে গলে গাল বেয়ে নেমে আসা মসৃণ ও রহস্যকাতর। মোমশলাকা এখনো জ্বলছে; সূর্য ওঠা অবধি জ্বলবে; তারপর অবশেষ, শরীর ও মন আগুনবিহীন জমে থাকবে সাদা, জমাট ও হীম। এইভাবে মোম ও আগুনের ভেতর বসবাস করছি।
১০ আগস্ট ২০১৭
একজোড়া চড়ুই ঘুলঘুলি গলে উড়ে গেল। এখন আর মোমবাতি জ¦লছে না। শপিঙমলের চলন্ত সিঁড়ির মতো রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ উঁচুতে। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, স্থির। উঠে যাচ্ছি উঁচুতে। মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতি গলছে। মোমবাতি নিভে যাচ্ছে; দেয়ালে ওর ছায়াটা কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে স্থির ও অন্ধকার। আলো না থাকায় সিঁড়ির ওপর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।