চারিদিকে দখলের মহড়া। অনেকেই নিশ্চুপ। কেউ কেউ চেপে যাছে। কেন এত অরাজকতা। জানতাম জল পড়ে, পাতা নড়ে। না এখন জল ঠিকই পড়ছে পাতা নড়ে না। নড়ছে না। নিথর সবকিছু। পরাজিত একটি শক্তির অন্যনাম এখন ‘মানুষ’। মানুষের হাতেই মানুষ খুন হচ্ছে। ধর্ষিতা নারীর ডিএনএ চায় আদালত। ধর্ষক পার পেয়ে যায়! কী ভয়ানক এই শাসন। আমি কবি। কবিতা লিখি। এরচেয়ে আর বেশি কী করতে পারি! তাই বলি—’কেউই জানতে চাইবে না, এই লোকালয়ে/ আদৌ কোনো শাসনতন্ত্র ছিল কি না কোনোদিন।’
কবি শহীদ কাদরী নিউইয়র্কে একটি সাহিত্য আড্ডার হোস্ট ছিলেন। এর নাম ছিল ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’। শহীদ কাদরী চাইতেন, নতুন কবিতা লেখা হোক। আমি খুবই অনুপ্রেরণা পেতাম তার কাছ থেকে। ‘আমাকে দেখতে এসেছিল যে শঙ্খচিল’ কবিতাটি সেই কবিতা আড্ডাকে ঘিরেই লেখা।একজন নবীন কবির প্রতি আমার বার্তা। মনে পড়ছে, আমি যখন কবিতাটি পড়ে শেষ করি, তখন শহীদ কাদরী একবাক্যে বলেছিলেন, ‘বাহ!’ আমি শুধুই তাকিয়েছিলাম তার মুখের দিকে।
মানুষ ভ্রমণকামী। প্রতিদিন সে পথ হাঁটে কিংবা সাঁতরায়। কোথায় যায়! ফিরে আসে কোথায়! সবকিছু কি অন্যকে বলে যেতে পারে! পারে কি শেষ করতে সব স্বপ্ন একজীবনে! হয় না। আমি কাঁটার নিগুঢ় আলোয় বহুবার পরখ করেছি আমার মুখ। প্রান্তিক মানুষ আমি। কোণেই থাকতে ভালোবাসি। না—আমাকে কেউ দেখুক, তা-ও আমি চাই না মাঝেমধ্যেই।
জল পড়বে, পাতা নড়বে না
রাশিফল দেখতে দেখতে আমরা গুনতে থাকি রাতের তারা। যারা
ভাগ্য বিপর্যস্ত—তাদের কথা না ভেবেই ডুবে থাকি রবীন্দ্রনাথের গানে।
জানি অনেক কিছুই, এমন একটি ভাব দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে
আমরা দখল করতে থাকি নদীর কিনার।
এই দখলদারিত্ব কবে ঘুঁচিয়েছে একাকীত্বের সন্ধ্যা—তা এখন আর
খুঁজে পাই না আমরা। বরং এটা জানতে শিখি, একদিন পরিচিত
ছাদেই আমাদের দিকে উল্টোমুখ করে বসেছিল ছন্দ ও তার কন্যারা।
ছন্দপুত্ররা মাছ ধরতে গিয়েছিল নদীতে। যারা শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ
হয়ে গিয়েছিল চিরতরে।
এখন শীতলক্ষ্যা কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীতে যে শবদেহগুলো ভাসতে
দেখা যায়—তারা কি সেই ছন্দসন্তান! যারা একদিন গান গাইতো,
বাঁশি বাজাতো, হারমোনিয়ামের ছায়ায় মিশিয়ে দিতো নিজেদের ছায়া!
প্রশ্নগুলোর উত্তর চেয়ে আমরা একজন ছায়াবিদের কাছে সম্মিলিত
চিঠি লিখি। অনেক অপেক্ষার পর একদিন ফেরত ডাকে সেই চিঠির
উত্তর আসে। তিনি আমাদের জানান—
‘বৎসবৃন্দ! নগরে এখন নারকীয় কীটদের উৎপাত। যে আঙুল
পথ দেখাতো, সে আঙুল উত্থাপিত হবে ঠিকই—কিন্তু ডানে বামে
নড়বে না। যে ঢেউ আমাদের চেনাতো উজান, সেই ঢেউ
দাঁড়িয়ে থাকবে অপরিপক্ক বর্ষায়। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ভাসমান
মৃতদেহ দেখে কেউই জানতে চাইবে না এই মানুষটি একাত্তর দেখেছিল
কি না। রক্তকে জল ভেবে কেউ কেউ পান করবে অরিরত।
বৃষ্টি হবে।
মানুষের মাথার উপর থেকে সরে যাবে জগতের সকল ছাতা।
সবাই ভুলে যাবে—ভেজার কৃতিত্ব।
এবং জল পড়বে,
নড়বে না পাতা। কেউই জানতে চাইবে না, এই লোকালয়ে
আদৌ কোনো শাসনতন্ত্র ছিল কী না কোনোদিন।’
আমাকে দেখতে এসেছিল যে শঙ্খচিল
কবি হবার জন্য আমি কখনোই উঁচু করিনি হাত।
হাজির, হাজির বলে কোনো কাব্যসভায় দিইনি হাজিরা। পেছন সারির
দর্শক হিসেবে আজীবন শুনতে চেয়েছি কবিতা—আর নান্দনিক সন্ধ্যার
ছবিগুলো ধারণ করতে চেয়েছি আমার ক্যামেরায়। বনেদি যে পথ
আমি পেরিয়েছি—তুমি সে পথে পা, না বাড়ালেও পারো। কারণ নদীতে
পা দিলেই ভিজে যেতে পারে পায়ের পাতা। ধূসর হয়ে যেতে পারে
আলতার রঙ। কিংবা মৃত শামুকের ভাঙা খোলস রক্তাক্ত করে দিতে
পারে পায়ের আঙুল। নিশীকামী জোনাকীরা মিটিমিটি আলোয় ছায়া ফেলে
তোমাকে দেখাতে পারে ভুল পথ।
অথবা এমনও হতে পারে—তোমাকে কবিতা শিখাবে বলে কোনো হাঙর
দেখাবে তার বীভৎস দাঁত! অতএব ফিরো না সে পথে।গ্রহণ করো অন্য
কোনো চাঁদের যাদুবিদ্যা। হাত রাখো এমন কোনো বিজলীতে, যে ঝলক
ঝলসে দেয় না পাঁজরের উত্তর মেরু। আমাকে এই নদীনক্ষত্রে দেখতে
এসেছিল যে শঙ্খচিল—তাকেও একই কথা বলেছি। কবি হবার যোগ্যতা
নেই আমার।আগুনের সাথে বায়ুর মিশ্রণে সাজিয়েছি যে তাম্রলিপি, বার বার
তা পাঠ করে হতে চেয়েছি নিতান্ত শব্দকামার।
বৃত্তান্তহীন ভ্রমণবিলাপ
বৃত্তান্তে কখনও ভ্রমণের কাহিনি লেখা থাকে না।পদ্মায় ফিরেছে মাঝিরা,
আবার ধরা পড়বে ঝাঁক ঝাঁক ইলিশ, আবার রূপোলি ঝলকে হেসে উঠবে
ঢেউয়ের কিনার—এমন সংবাদ মুখে ফিরে যায় দিগন্তের পাখি। আর
মানুষেরা সাহসী বাহুর হাড়ে সাঁতারের কৌশল লিপিবদ্ধ করে এগিয়ে যায়,
যেতে থাকে এই জীবনের মহান উদ্যানে, যেখানে থাকে ফুল-থাকে কাঁটা।
আমি কাঁটার নিগুঢ় আলোয় বহুবার পরখ করেছি আমার মুখ। দেখেছি—
ভোমর উড়ে যাবার পর পুষ্পের বিরহ বিলাপ, বিচ্ছেদের অনন্ত লহরী।
দেখেছি, সারারাত জাল বেয়ে মাছ না ধরার বেদনা নিয়েও ঘরে
ফিরছে বয়স্ক ধীবর। প্রিয়তমার আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কেবলই বলছে,
এই গঞ্জ আর আমাদের নয় সখি,
চলো, অন্য কোনো গ্রামে, যেখানে নদী নেই—ক্রন্দন নেই।