ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমসাময়িক ঘটনা, নারীনির্যাতন, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনাসহ চিরায়ত কিছু বিষয় আমার কবিতায় থাকে। আমার কবিতায় এসব নিয়েই গল্প লুকিয়ে থাকে। এসব গল্পে থাকে আমার নিজস্ব আবিষ্কৃত শব্দের বেশি ব্যবহার। শব্দচয়ন, গতি ও অলঙ্কার প্রয়োগে আমি গ্রামমুখী। তবে শহরকে একেবারে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়। গ্রামীণ আর শহুরে জীবন থেকে অব্যহৃত শব্দ খুঁটে খুঁটে বের করে কবিতায় ব্যবহার করি। অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও তাই।
কবিতায় সবসময় আমি একটা গল্প বলতে চাই, তা হোক যত ক্ষুদ্র। আর সেটাকে অনেক যত্ন করে চিত্রময় রূপ দিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করি। এর ফলে একটা পূর্ণ বার্তা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর প্রয়াস থাকে। সেই বার্তা আলো-আঁধারির রহস্যের মতো নয়। এই জায়গাটিতে আমার কবিতা আলোর মতো স্পষ্ট করে তুলতে চেষ্টা করি। দুর্বোধ্য ও দুরূহতা থেকে আমি কবিতাকে দূরে রাখতে পছন্দ করি। কবিতা লেখার সময় আমার কান গভীরভাবে নিবিষ্ট থাকে নদীর স্রোতের কাছে। নদীর মিষ্টি অথবা শাণিত এমনকী বিক্ষুব্ধ স্রোত আমি শব্দে গেঁথে নিতে চেষ্টা করি। কবিতা আমার কাছে গতিশীল একটি ব্যাপার—অবাধ্য স্রোতের মতোই অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলা—এই ছুটে চলার ভেতর জীবন থাকে—সাহস থাকে—বিপ্লব থাকে—সুর থাকে—ছন্দ থাকে—ভাঙা-গড়ার আনন্দ-বেদনা-বোধের গভীরতা থাকে।
দুই.
কোনো কিছু লেখার আগে তা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে—তাকে কিভাবে ধরবো—সেটা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমি তাতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হওয়ার চেষ্টা করি। বলতে পারি ধ্যানী হয়ে উঠি। কখনো তা ধরতে পারি—কখনো পারি না। যা বলতে চেয়েছি, তা যদি শব্দ-ছন্দ-গতি—সবকিছুর সমন্বয়ে শৈল্পিক করে স্পষ্ট করে বলতে পারি, ভালো লাগে—স্বস্তি অনুভব করি। কিন্তু সবসময় তা পারি না। পারা যায় না। তখন এক অস্বস্তি ও যন্ত্রণা আমাকে ভীষণভাবে তাড়া করে ফেরে। অন্য আর কিছুতে মন বসাতে পারি না।
অধরা কবিতা আমার ভেতর বিক্ষুব্ধ ঝড়ের মতো হয়ে ওঠে। ভেতরে ভেতরে আমি বিধ্বস্ত হতে থাকি। হতে পারে এ আমার অপারগতা। আমার মাথার ভেতর কবিতা হয়ে উঠবে বলে যা কিছু ঘুরপাক খায়, তা আমার সবসময় ধরা হয়ে ওঠে না। এটা খুব যন্ত্রণার। আবার অনেক সময় যুতসই শব্দ না পেলে কবিতাকে কবিতা মনে হয় না। শব্দের ব্যবহারের ওপর কবিতার গতি অনেকখানি নির্ভর করে। গতিই তো কবিতা। ফলে একটা ভালো কবিতা হয়ে উঠতে গতির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে।
গতির সঙ্গে ছন্দ মাত্রা অলঙ্কারের সফল সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ। কোনোটার একটু এদিক-ওদিক ঘটলেই কবিতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনারও অপমৃত্যু ঘটে যায়। আমার কাছে কবিতা পুরো সাধনার মতো। ফলে কবিতা সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। নিজের ভেতর-বাইরের আপন-প্রকাশ। আত্মাই যদি হয় আমার সর্বস্ব বা আমার সত্তাই যদি হই আমি—তাহলে আমার কবিতা তো আমিই। হয়তো সেটা সব সময়ই এই সত্য পুরোটা ধারণ করে না। বিষয় এখানে বড় একটা ভূমিকা রাখে।আয়নার সামনে নিজেকে যেভাবে দেখা যায়, কবিতায় সেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়—ভাবের ভেতর দিয়েই নিজেকে কবিতায় স্থাপন করতে হয়। আর এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ফলে আগের কবিতা আর পরের কবিতা এর মধ্যে অনেক পার্থক্য ঘটে যায়। নিজেকে—নিজের চিন্তাকে—নিজের ভাবকে—নিজের প্রেমকে সর্বজনীন করে তুলতে পারা একজন কবির বড় শক্তি। এটা আমাকে ভাবায়।
দেশ-কাল-রাজনীতি অনেক সময় আলোছায়ার একটা রহস্য কবিতার মধ্যে গেঁথে দিতে হয়। রহস্যের আশ্রয় নিতে হয়—সত্যভাষণ গভীরে রাখতে হয়—সমুদ্রের গভীরতার মতো।
কবিতাকে সহজ সাবলীল-বোধগম্য করে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জটিল বৃত্তে বন্দি করে আলোছায়ার ভেতর কবিতাকে আটকাতে ইচ্ছে করে না। আর এটা যেন নিজেকেই অস্বচ্ছ ও অন্ধকারে রেখে দেওয়া। ফলে যে বার্তাটি পাঠকের কাছে দিতে চাই, তা অধরাই থেকে যায়। এটা অনেক সময় নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়—নিজেকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেও খানিকটা সরিয়ে রাখার মতো ব্যাপার। আমি যে এটা থেকে আমার কবিতাকে পুরোপুরি মুক্ত রাখতে পারি, তাও নয়। আমার কিছু কবিতার ভেতরও রহস্যময়তা আছে। দেশ-কাল-রাজনীতি অনেক সময় আলোছায়ার একটা রহস্য কবিতার মধ্যে গেঁথে দিতে হয়। রহস্যের আশ্রয় নিতে হয়—সত্যভাষণ গভীরে রাখতে হয়—সমুদ্রের গভীরতার মতো।
তিন.
কবিতায় নানামাত্রিক বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। জীবনেরও নানা বাঁক থাকে। নদীরও তাই। চর্যাপদ থেকে এই সময়কালে কবিতা নদীর মতো বহু পথ ঘুরেছে—বহু বাঁক খেয়েছে—বহু রূপ পরিবর্তন করেছে—বহু রূপ ধরেছে। গভীরতা ও অর্থবহতাও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পেয়েছে। ফলে সময়ের সিঁড়ি ধরে কবিতায় নতুন নানা বিষয় যুক্ত হয়েছে। অন্তর্জগত আর বহির্জগত সবই কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। অন্তরের আত্ম-সাধনা, প্রেমের একান্ত বেদনা, খাঁটুনি শ্রমিকজীবন আর ধর্ষণের শিকার নারীর যন্ত্রণা, অপমান, রাজনীতির শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা সবই কবিতার বিষয়।
একসময় প্রেম আর ধর্মচেতনাতেই বন্দি ছিল কবিতা। কবিতা সে সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ভেঙে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রের অলিগলিতে অবাধে ঢুকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক আবহ কবিতা এখন ধারণ করে। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে দেশ আর বিদেশ সবই কবির জানার ভেতরে চলে এসেছে। কবিতাও তা ধারণ করছে। ফলে কবিতা সীমানার কাঁটাতার ভেঙে বিশ্বের হয়ে উঠছে। তেমনি নিজের কবিতা নিজের কাছেও নানারকম বাঁক নেয়। নিজেকেই নিজের অতিক্রম করতে হয়। নিজেকেই নিজের বৃত্ত ভাঙতে হয়। তা না হলে কবিতা নিজের কাছেই গতি হারায়। আমি চেষ্টা করি আমার কবিতায় প্রতিনিয়ত এই পরিবর্তন আনতে বা বাঁক খেলার খেলাটা খেলতে। নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিশ্বায়ন কবিতায় ধরার চেষ্টা থাকে আমার।
চার.
নতুনকে গ্রহণে অনেক সমস্যা থাকে। সহজে কেউ মেনে নিতে চায় না। তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। যেমন কিছুদিন আগে আমি একটা কবিতা লিখেছি ‘টালা সুখ’। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এক নারী যখন তার প্রিয়জনকে বহু বছর পরে হঠাৎ দেখে সারামুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস ফুটিয়ে বলে ‘তোমাকে দেখে আমার জানটা টালা হয়্যা গ্যালো’। ‘টালা’টা তখন বহু বর্ণিল সুখ ও শান্তির সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে।
আবার যখন বলি ‘পাকা কুঁচফলের মতো যৌবনাস্তন’—এটাও কিন্তু অব্যবহৃত। আমি কবিতায় এরকম অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে পছন্দ করি। সুষম ও নির্বাচিত শব্দ ব্যবহারে আমার ঝোঁক বেশি। যেমন পাটকাঠির লাউজাংলা, সিঁধেল চোর, ঘরের পোটনি, মাজিভাই, দুঃখিনী গড়াই, কচুরিপাতার মতো টানা টানা চোখের বউটি, স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উঠোন, কৈশোরিক চাঁদ, কুঁচি দিয়ে পরা সাদাকালো শাড়ি, গরিবানা বালিশ, বিষণ্ন মেঘ, নদীর চওে বালির মেদ—আবহমান গ্রামবাংলা থেকে কুড়ানো শব্দের যেমন প্রচুর ব্যবহার আছে, তেমনি শহরের পোর্স্টমর্টেম, হেরিটেজ, লেটেস্ট মডেলের মুঠোফোন, পোস্টার প্রিন্সবাজার, অ্যাকুরিয়াম, ফ্রেমবন্দি প্রভৃতি শব্দ।
আসলে কবিতায় ‘আমি’একটি সত্তা—যে নিজের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত বোঝা-পড়া করে—করতে থাকে—এই বোঝাপড়ার ভেতর দিয়েই কবিতা ব্যক্তিক থেকে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। আমার কবিতায় সে চেষ্টাটাই থাকে।
আমি চাই কবিতায় ব্যঞ্জনা থেকে ব্যঞ্জনাতীত ধ্বনিকুঞ্জ তৈরি করতে। কবিতার ফর্ম ব্যবহারে মুক্তদৃষ্টির পথিক আমি। রবীন্দ্রনাথের শ্যামলী, পত্রপুট ও পুনশ্চ মুক্তফর্মে লেখা। সমর সেন ও দাউদ হায়দার এ ফর্মের কবি। গতানুগতিকতাকেই সবাই গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একজন কবির কাজই তো হলো গতানুগতিক থেকে বের হয়ে এসে নতুন বার্তা শোনানো। সময়ের প্রবল স্রোতের তোড়ে গতানুগতিকবৃত্ত ভেঙে নতুন আসে—এই আসাটা অনিবার্য—এটাই কবিতার শক্তি। সেই চেষ্টাটা সবারই থাকে—আমি ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করি। কেউ হয়তো পারেন, কেউ পারেন না। যিনি পারেন সমকালে তাকে প্রশংসার চেয়ে তিরস্কারই বেশি পেতে হয়। এটা সবকালেই ছিল। এখনো আছে। সবকালেই নতুনকে কেউ সহজে গ্রহণ করতে চাননি। সে দেশে হোক আর বিদেশে হোক। সব দেশের কবির ক্ষেত্রেই একই রকম নিয়তি বহন করে।
বোদলেয়ার, ব্লেক, র্যাঁবোও-র মতো বিখ্যাত কবিতারাও এ-থেকে মুক্তি পাননি। আমাদের মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ—সব বড় কবিকেও এই যন্ত্রণাকে কম-বেশি সহ্য করতে হয়েছে। কবিতায় নতুনকে ধারণ করার একটা শক্তি ও সাহস থাকতে হয়। সময়ের সস্তাস্রোতে সাময়িক প্রশংসা পেলেও কালের যাত্রায় তা স্থায়ী হয় না। কবিতায় জোর করে জটিল ও কঠিন ভাব তৈরি করতে আমার ভালো লাগে না। কবিতা পাণ্ডিত্য দেখানোর প্রপঞ্চ নয়। এসব থেকে কবিতার মুক্তি ঘটে গেছে বহু আগেই। রবীন্দ্রবৃত্ত ভাঙতে ত্রিশে কবিতায় যে দুরূহতা তৈরি হয়েছিল, সে-বৃত্তও একসময় ভেঙে গেছে। নতুন ধারা, নতুন বিষয় কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। এই যে নতুন ধারা বলছি—এর ভেতরেও আবার নানামাত্রিক বাঁক আছে—কবিতা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল—নতুন রূপে নতুন রঙে—এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই।
আমার কবিতায় দৈনন্দিন জীবন বাস্তবতা—দুঃখ-কষ্ট বেশি আছে। প্রতিদিন যে জীবন দেখি, যে সমাজ দেখি—দেশের যে দুঃখময় করুণ ছবি দেখি—তাকেই কবিতা করে তুলতে চেষ্টা করি। চেতনায় অন্তর্জগতে থাকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম-ইতিহাস-ঐতিহ্য।
পাঁচ.
প্রথমে যে কথা বলছিলাম, আমার কবিতা আমার আত্মা—আমার সত্তা—হয়তো আমিই। এই দেশ-দেশের মাটি-মানুষ আমার প্রেম সবই তো আমার আত্মা—আমার সত্তায় গ্রোথিত। এসব বাদ দিয়ে তো আমি কেউ নই—আমি তো আমাকে দেখি না। এসবই বিশেষ ভাষা, শিল্প-শৈলী ও প্রতিকীতে আমার কবিতা হয়ে ওঠে। আর এ কবিতার ভেতরেই আমি আমাকে দেখি। আমার কবিতা ক্ষতবিক্ষত-আহাজারি-আর্তনাদের অসহ্যনীয় ছবি, কখনো আবার সুরেলা নদী, পাখির গান, সবুজের ফসলের মাঠ, আমার প্রেম-বিরহ-আনন্দ-বেদনা। আসলে কবিতায় ‘আমি’একটি সত্তা—যে নিজের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত বোঝা-পড়া করে—করতে থাকে—এই বোঝাপড়ার ভেতর দিয়েই কবিতা ব্যক্তিক থেকে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। আমার কবিতায় সে চেষ্টাটাই থাকে।