প্রিয় ফাউজুল কবির ভাই,
আশা করি কুশলেই আছেন। প্রতিদিন ফেসবুকে আপনার দেয়ালে কখন কবিতা টাঙাবেন, তার প্রতীক্ষায় থাকি। কোনো কোনো দিন আপনার দু’তিনটি কবিতার রহস্যময় শব্দস্রোতে ভাসতে থাকি, আর ডুবে যাই সেই কবিতানিচয়ের গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞার গহীনে। আপনার সঙ্গে চাইলেই প্রতিদিন ফোনালাপ করা যায় বা যেতো। কিন্তু আপনি যেমন ভাবের অন্তহীন স্রোতে নিমগ্ন, আমিও তেমনি নানা পেশাগত ও পারিবারিক ঝক্কি নিয়ে নানান হুজ্জতে দিন কাটাই। ইতোমধ্যে আম্মার মেরুদণ্ডের হাঁড়ের ভেঙে যাওয়া, আম্মার হয়তো এটা চিরকালের জন্যে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া আমাকে এই সৃজনী জগৎ থেকে কিছুটা ছিটকে বাইরে নিয়ে গিয়েছে। তবু আপনার কবিতার ভেতরে জীবনের গূঢ় রহস্যের কিছু আলোছায়ার দর্শন মূর্ত হয় বলেই হয়তো আপনার কবিতা চোখে পড়লে একবার অন্তত পাঠ করে নেই।
গত পরশু (অর্থাৎ ৩০ জুলাই ২০২০) আপনার একটি কবিতা আমাকে বেশ আপ্লুত ও আক্রান্ত করেছিল খুব গভীরভাবে। যেখানে আপনি কতগুলো এমন প্রশ্ন খুব সাবলীলভাবে উত্থাপন করেছেন যে, আমিও মায়ের শারীরিক সমস্যা ইত্যাদির কারণেই হয়তো এমন সব প্রশ্নে নিজেকেই বিব্রত করছিলাম বেশ ক’দিন ধরে।
মানুষের মৃত্যু নিয়ে কী বলার আছে পৃথিবীর
জীবনের কথা নিয়ে কী বলার আছে সংসারের
অস্তিত্বের সংজ্ঞা নিয়ে কী শোনার আছে আমাদের!
মানুষ যেমন জন্মায়, তেমনি মৃত্যুও সমানভাবে বাস্তব এবং নিত্যকার ঘটনা। পৃথিবীর এতে আর বলার আছেই বা কী! যে জীবন আমরা পার করছি প্রতিদিন, প্রতি প্রহরের খটমট লেগে থাকা সংসার, প্রেম ও বিতৃষ্ণার এক মধুর মিশ্রণ যাকে আমরা সংসার নামে অভিহিত করি, সেই সংসার আসলেই কি বুঝে জীবন কাহাকে বলে? সত্যিই কি আমাদের শোনার কিছু আছে অস্তিত্বের সংজ্ঞা বিষয়ে?
অন্য সবার মৃত্যু বিনা গতি ছিল না। এখানে লক্ষ করেছি, নিয়তি যূধিষ্টিরকে অনন্তকাল পৃথিবীতে বাস করার সুযোগ তো দিলো না।
আজ আমরা কত স্বপ্ন জড়ো করে জীবন ও সংসার সাজাই, যে সুন্দর ধরণীর করপূটে আমি নিয়ত মুগ্ধ বিস্মিত হই। যে পৃথিবীর প্রেমে বুঁদ হয়ে আমরা রবিঠাকুরের ভাষায় বলে উঠি, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ আমার চোখটা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলে, এ পৃথিবী এমনটিই থাকবে তো? যদি এমনটিই থেকে যায়, তবে কী অর্থ বহন করে রবিঠাকুরের সেই চরণ—
আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠলো রাঙা হয়ে।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: আমি)
তবে তো, চেতনার বিলুপ্তি ঘটলে পান্নার সবুজ থাকবে না, চুনিও হবে না লাল। তাই মনে হয় মাঝে মাঝে, আমার অস্তিত্বই তো আমার পৃথিবী। আমি যদি না-ই থাকি, সে পৃথিবীতে আমার কী দরকার? এই চিন্তাটি মনে এলেই নিজেকে বড় ক্ষুদ্র নীচ স্বার্থান্ধ মনে হয়। তখনই আবার রবীন্দ্রনাথ আমাকে আশ্রয় দেন—
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
. যারে খুশি তারে দাও,
. শুধু তুমি নিয়ে যাও
. ক্ষণিক হেসে
. আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
. যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আমার সব কর্ম তুলে দিতে হবে কালের তরণী ‘পরে। আমাকে নেবে না সেই মহাকালের তরী—নেবে আমার কাজ, আমার সৃষ্টি। তাই তো শতবর্ষ পরে কৌতূহল ভরে আমি-আপনি পড়ে যাই রবিঠাকুরের কোনো এক কবিতাখানি। আমারও মৃত্যু অনিবার্য একথা প্রতিমুহূর্তে প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে ইদানীং টের পাই—অ্যাজমাটা জেঁকে বসার পর থেকেই। তার সঙ্গে যেদিন মহা আড়ম্বরে কোভিড-১৯ নীল আর্মস্ট্রং-এর মতো পা রাখলো বঙ্গ-জনপদে। তার দিগ্বিজয়ে মৃত্যু এখন মুড়ি মুড়কির মতো বিস্ময়বিহীন ম্লান মদির হয়ে পড়ে থাকে পথে-ঘাটে, হাসপাতালের বেডে ও অ্যাম্বুলেন্সের প্রাণঘাতী হর্নের শব্দের ভেতর। তখন আপনার কবিতাই যেন আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মৃত্যু সে অমোঘ—নিয়তির চিরায়ত বিধান। সহস্র বছরের ইতিহাসে কত মৃত্যু গান শুনিয়ে গেছে কবিদের ছত্রে ছত্রে।
মানুষেরা মরে আছে দূর মরণের দেশে
তিন হাজার বছর আগেকার মানুষেরা
অথবা ফারাও কাল আরো দূর প্রাচীনের
মিশরীয় মেনেসের যুগান্তর পিরামিড
স্মৃতিময় ধূসরের গন্ধবহ প্যাপিরাস
না। আমি এতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু দেখিনি। সেই প্যাপিরাসের পাঠ হোক আর নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হোক, আমরা জেনেছি পিরামিড বানাতে পারে এমন সম্রাট ফারাওরা যেমন মৃত্যুকে গ্রহণ করেছেন, তেমনি তাজমহলের সম্রাটও জীবনকে অনন্ত করতে পারেননি। মহাভারতের কাহিনী পাঠ আমাকে জানিয়েছে কেবল যুধিষ্টির হেঁটে স্বর্গে গিয়েছেন। অন্য সবার মৃত্যু বিনা গতি ছিল না। এখানে লক্ষ করেছি, নিয়তি যূধিষ্টিরকে অনন্তকাল পৃথিবীতে বাস করার সুযোগ তো দিলো না। অর্থাৎ গাত্রোত্থানের বিকল্প নেই। এই ভাবনায় যখন মথিত-দলিত হচ্ছি, তখনই দেখি আপনার সপ্রশ্ন উচ্চারণ—
পচিত দেহের থেকে
শুকনো কালো রক্ত থেকে গোলাপ ফুটবে শিঘ্রই
কে ফোটাবে গোলাপের স্বপ্ন? কার আছে দুঃসাহস!
এই সে প্রশ্ন, যা চমকে দেয়, সচকিত করে তোলে ভাবতে বাধ্য করে—অস্তিত্বের অধিক কিছু অস্তিত্বের কথা। পচে যাওয়া শরীরের শুকিয়ে যাওয়া কালো রক্ত থেকে শিঘ্রই গোলাপ ফুটবে—এই গোলাপের স্বপ্ন কে ফোটাতে পারে? কার এমন দুঃসাহস থাকে? আমার হৃদয়ের মস্তিষ্কের কাছে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় একটিই নাম—কবি।
শক হুন মঙ্গোলেরা ভূত হয়ে গেছে আজ
হিকসস হিটাইট আলেকজান্ডার মৃত
বিস্মৃতির ছায়া দৈত্য
সিজার ও বর্বরেরা ধূমাভ কবরে নেচে যাচ্ছে
নাটকের কুশীলব হাতে হাতে ঘুরছে তলোয়ার
মৃত্তিকার ঘাস হাসে
দ্বিধার কিরিচ চোখে
সব রাজা মহারাজা ধূলির সন্তান ইতিবৃত্তে।
আপনার পরবর্তী বয়ান পড়তে পড়তে মনে পড়েছিল, রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার কবিতার সেই অবিস্মরণীয় চরণগুলো—
জগতের যত রাজা মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ
সকালে ফুটিয়ে সুখদুখলাজ
টুটিছে সন্ধ্যাবেলা
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: পুরস্কার)
আজ মহাপ্রতাপশালী আলেকজান্ডার, শকহুন, মঙ্গোলদের মৃত বিস্মৃতির ছায়া আমাদের হয়তো কোনো নাটকের কুশীলবের দিকে ইঙ্গিত করছে। আজ একথা সতত প্রমাণিত যে সব রাজা মহারাজাই শেষ পর্যন্ত ধূলিকণার ইতিবৃত্তে নিপতিত হন। এসব নতুন কিছু নয়। তবু নতুন করে হৃদয়ে টঙ্কার তোলে। আবুল হাসানের মতো যেন বলে ওঠে—‘মৃ্ত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।’ হায়, আবুল হাসানের আকুতিতে কোনো সুধী ক্ষান্ত হননি, শান্তও হয়ে পড়েননি গোলাপের মতো।
অতএব, সময়ের যথার্থ ব্যবহার আমাদের জন্যে জরুরি হয়ে উত্থাপিত হয়। সবচেয়ে জরুরি পাঠ হয়তো জীবনানন্দের সেই—
আলো অন্ধকারে যাই
মাথার ভেতরে স্বপ্ন নয়
কোনো এক বোধ কাজ করে
আমি তারে পারি না এড়াতে
(জীবনানন্দ: বোধ)
এই বোধ বলতে কী বুঝিয়েছেন, তা ভেবে কত নিশি বিনিদ্র যাপন করেছি, কত বিদগ্ধ গবেষকের সন্দর্ভে রেখেছি চোখ, যদি সেই বোধ—সেই বোধ এসে জন্ম লয় অধমের মাথার ভেতরে। সে যেন এক পরশ পাথর, যাকে আজন্ম খুঁজে ফিরি খ্যাপার মতন—বোধ, আহা বোধ যদি জন্ম লয়!
কবিতার মৃত্যু আর কবির মৃত্যুতে কোনো ভেদ নেই। আবার এমন উচ্চারণও পাচ্ছি—কবিতার বেঁচে থাকা মানে ‘মানবের উজ্জীবন’।
আপনার পরের পঙ্ক্তিগুলো যেন সেই একই ইঙ্গিতে আমাকে উত্তেজিত—আন্দোলিত করে তোলে—গড়ে তুলতে প্ররোচিত করে নিজেকেই নিজের শত্রুতে।
ক্ষয় আর অবক্ষয় না থাকলে সময়ে
ক্ষরণ আর দহন না জাগলে সময়ে
শব্দের ক্ষমতা ভোঁতা হয়ে যায়—জং ধরে
বোবা কালা অন্ধ হয় ভাষা—বোধের জগৎ—
বুকের ভেতরে যদি
তীব্র তীক্ষ্ণ ঘৃণা ক্ষুব্ধ থুতু হয়ে না জন্মায়
নিজেকে নিজের শত্রু বানাতে না পারলে
আগুন জ্বলে না মনে—
এই যে নিজেকে নিজের শত্রু হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপার—এর ভাবরহস্য বোঝা কি এতই সহজ? নিজের মনে আগুন জ্বালাতে না পারলে, না যদি জন্মে তীব্র তীক্ষ্ণ ঘৃণা থুতুর মতোন বুকের ভেতরে, তবে শব্দের ক্ষমতা তো ভোঁতা হয়ে যাবে। তাই, হৃদয়ে আগুন জ্বালানোর জন্যে নিজেকেই নিজের শত্রু বানাতে হবে। আয়েশ ও আনন্দের সঙ্গে—প্রতাপ আর ক্ষমতার সঙ্গে গড়ে উঠতে হয় সমূহবিরোধ। তবেই শব্দগুলোয় আগুন ধরবে—হয়ে উঠবে কালের আবর্তে টেকসই।
আর শব্দকে আগুন ধরানো না গেলে
যদি শানপাথরের বুকে শানানো না যায়
প্রতিটি ধ্বনির প্রাণ
জীবনের মৃত্যু হয় কবিতার মৃত্যু হয়—
যথার্থই বলেছেন কবিতায়, শব্দ যদি আগুনে ঝলসে না ওঠে, তবে মৃত্যু নেমে আসে জীবন ও কবিতায়। আর আমরা তো জানি একমাত্র যথার্থ কবিতাই পারে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে। আমরা তো মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায়ও দেখেছি জন্মভূমি যদি তাঁকে মনে রাখে (রেখো মা দাসেরে মনে) তবে কিনা মৃত্যুরে ডরান না—দেশের কোলে ঠাঁই পেলে তা অমৃত-হ্রদে ঠাঁই পাওয়ার মতোন।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,
নাহি, মা, ডরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত-হ্রদে!
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বঙ্গভূমির প্রতি)
এ থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, কবিদের অমর হওয়ার সাধ যেমন চিরন্তন, তারা সেই অমর হওয়ার পথও খুঁজে গিয়েছেন নিরন্তর—নানা পদ্ধতিতে। আপনার পত্রেও আপনি উল্লেখ করেছেন যে, সব কবিতাই বাঁচার যোগ্যতা যেমন রাখে না, সব কবিও বেঁচে থাকে না। কবিকে বাঁচতে হলে কবিতাকে, কবিতার শব্দগুলোকে আগুনে ঝলসে নেওয়ার মতে দুঃসাহসী হয়ে উঠতে হয়। অন্যথায় কবিতার মৃত্যু ঘটে। আপনার পরবর্তী বয়ানে আমি কবিতার মৃত্যু বলতে কী বোঝায় তার চিত্র রূপায়ণ লক্ষ করি। কবিতার মৃত্যু উপমিত হয় ‘উচ্চারণে নীল মৃত্যু’, ‘সত্যের অবনত মস্তক’, এবং ‘অকালে বৃক্ষের পাতাঝরা’র সঙ্গে। কবিতার মৃত্যু আর কবির মৃত্যুতে কোনো ভেদ নেই। আবার এমন উচ্চারণও পাচ্ছি—কবিতার বেঁচে থাকা মানে ‘মানবের উজ্জীবন’। আর কবিতা বেঁচে থাকলে সাহসেরা বীর হয়ে ওঠে।
কবিতার মৃত্যু মানে উচ্চারণে নীল মৃত্যু জাগা
কবিতার মৃত্যু মানে সত্যের মস্তক অবনত
কবিতার মৃত্যু মানে অকালে বৃক্ষের পাতাঝরা
কবিতার বেঁচে থাকা মানে মানবের উজ্জীবন
কবিতারা বেঁচে থাকলে সাহসেরা বীর হয়ে ওঠে।
আপনার নিশ্চয় মনে আছে আমি ২০১৮ সালে এমিলি ডিকিনসনের কিছু কবিতা ভাষান্তর করেছিলাম। মৃত্যুকে যেন তিনি খুব গভীরভাবে অবলোকন করেছিলেন। তিনি মৃত্যু সংক্রান্ত একটি কবিতায় লেখেন—
Because I could not stop for Death –
He kindly stopped for me–
(Emily Dickinson: 479)
প্রকৃত কবির সময় থাকে না মৃত্যুর জন্যে থামার। বরং মৃত্যুই একসময় বাধ্য হয় থেমে যেতে। কবি তার কর্মযজ্ঞে নিত্য ছুটে চলে অনন্তের আহ্বানে। শব্দের সঙ্গে শব্দের ঘর্ষণের এ লীলায় রক্তক্ষরণ ঘটে হৃদয়ের গভীর তন্তুতে।
আমি কবিতাকে চিনি অস্তিত্বের নিরংকুশে
আমার কবিত্ব বাঁচে রক্তে–রক্তের সংশ্লেষে
কবিতার চোখ ফোটে সত্যে আগুনের স্বপ্নতেই
কবিতারা বীর্যবান হয় অসংকোচ–আমি’তেই
কবিতা কালের ক্রেতা মৃত্যুহীন সত্তা অশোকের
মানুষের মৃত্যু আছে কবিতা অনন্ত আকাশের।
(আমার কবিত্ব বাঁচে: ফাউজুল কবির)
আপনি কবিতাটির সমাপ্তি টেনেছেন যে সত্যশব্দগুলোর সন্নিবেশনে—তাতে আপনি ঘোষণা করছেন, আপনার কবিত্ব। ধরে নিচ্ছি সার্বিক অর্থে কবি মাত্রেরই কবিত্ব বাঁচে কেবল রক্তের সংশ্লেষের কারণে। সত্য ও আগুনের স্বপ্ন যখন কবিকে অসন্তোষ প্রকাশের দুরন্ত সাহস যোগায় বুকে, কবিতারা সংকোচহীন ও বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে যায়। এই কবিতায় শেষ পঙ্ক্তিতে ঘোষিত হয় মানুষের মৃত্যু আছে কবিতা অনন্ত আকাশের। আর এ কারণেই কবিতা অমর অজর অক্ষয় হয়ে কাল থেকে কালান্তরে পক্ষান্তরে মানুষের সভ্যতাকেই শাসন করে।
যদি ভাবি, এই উপমহাদেশ কিংবা সেমেটিক সভ্যতায় যে আচারনিষ্ঠ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে, তা ওই কালজয়ী মহাকাব্যেরই অনুশাসনমাত্র, তবে মনে হয়ে বিন্দুমাত্র ভুল করবো না।
আর কলম চলছে না। হয়তো নজরুলের ভাষায় মন বলছে, ‘বন্ধু বড় দুঃখে/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও যাহারা আছো সুখে।’
আপনার এই কবিতাটি দেখে আমি এতটা উদ্দীপিত হই এ জন্যে যে, তার মাত্র ২ দিন আগেই আমি একটি কবিতাংশে কবিরা যে মরে না, সে প্রসঙ্গে কিছু পঙ্ক্তি রচনা করেছিলাম। আপনি হয়তো এর মধ্যে জেনেছেন আমি একটি সিরিজ কবিতা রচনায় ব্যস্ত ছিলাম। এরই একটি জায়গায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল। আর এর ফলে লিখেছিলাম—
হাঁসুলি বাঁকে বাঁকে কত যে ইতিকথা
আরোগ নিকেতন আর গণদেবতাসকলি উবে গেছে সে আজ কতো যুগ
ও তারাশঙ্কর, পঞ্চগ্রাম চুপবসন্তরাগের সপ্তপদী সুর
রাইকমল কাঁদে কবির কাঁপে বুককবিই থেকে যায় কবিরা মরে না!
(জিললুর রহমান: একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি: ৩২)
আপনার প্রখর স্মৃতিতে নিশ্চয় স্মরণে আছে কবি উপন্যাসের সেই অমর লাইন, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’ কিংবা ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’। এইসব টুকরো টুকরো কথা, তারাশঙ্করের অন্যান্য লেখা সব ছাপিয়ে যেমন কবি সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়, তেমনি কালে কালান্তরে আমরা এখনো শাসিত হই মহাকাব্যিক সব অনুশাসনে। তাই আমরা ভুলে যাই—
নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি-
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ভাষা ও ছন্দ)
আমরা এই মহাকাব্যের কল্পিত রামের জন্যে কতো রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছি! অথচ ভাবিনি, এতো একটি মহাকাব্য মাত্র। তেমনি অনেক প্যাগান বিশ্বাস রোমক সাম্রাজ্যের হাত ধরে খ্রিষ্টীয় ও অন্যান্য সেমেটিক বিশ্বাসে প্রোথিত হয়েছে। তাই যে কবিতা, মানব অগ্রযাত্রার পক্ষে, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায় অত্যাচারের বিপক্ষে সুদৃঢ় অবস্থানে থেকে কবিতার শব্দে যথার্থই আগুন ধরাতে পেরেছে, সেই কবিতার মৃত্যু ঘটে না, কবিও মরে না তাই। হয়তো বুঝতে অনেক ভুল করেছি, হয়তো সেই ‘বোধ’ জন্ম নেয়নি যখাযথ মেজাজে, তবু আপনার কবিতা আমাকে এমন করেই ভাবতে প্রলুব্ধ করেছে।
প্রিয় ফাউজুল কবির ভাই, এই পত্র যখন লেখা শেষ হচ্ছে, তখন প্রায় ভোর হতে চলেছে। একটু পরেই ভোরের সূর্য পূর্বাকাশ লাল করে দেবে। একটু পরেই ‘মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কী সুমধুর, আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী’র সুরেলা আওয়াজ শোনা যাবে। অথচ আমার চোখে কোনো ঘুম নেই। জানি, ঘুম হইতে প্রার্থনা উত্তম। কিন্তু আমার মায়ের ভাঙা মেরুদণ্ডের জন্যে যে প্রার্থনা সারাক্ষণ কলবের ভেতর গুঞ্জরণ করে বেড়াচ্ছে, তা কি সত্যিই মঞ্জুর হবে কোনো একদিন?
আর কলম চলছে না। হয়তো নজরুলের ভাষায় মন বলছে, ‘বন্ধু বড় দুঃখে/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও যাহারা আছো সুখে।’ না, আমি কিছুই বলবো না। কেবল আপনার আরও একটি কবিতা পড়ার জন্যে আরও একটি সকাল দেখতে চাইবো।
শুভেচ্ছান্তে
আপনারই অনুজ
জিললুর রহমান