এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।’
[কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড : আবদুল মান্নান সৈয়দ]
আধুনিক কবিতার ইতিহাসকে টেকনিকের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন সমালোচকদের অনেকেই। কিন্তু কবিতা তো শুধু টেকনিকের না। কবিতা তো শুধু টেকনিকের ইতিহাস হতে পারে না। কবিতা তো নির্মাণ নয়, যে চাইলাম আর তৈরি করে দিলাম, অথবা নির্মাণে কোনো সামগ্রী কম পড়লো বলেই, পাশের কারখানা থেকে লতিফকে পাঠিয়ে ইস্ক্রপ নিয়ে আসবো। কবিতার ইতিহাস সাধনার ইতিহাস। দীর্ঘদিনের চর্চার ইতিহাস। ‘শিল্প তো নিরাশ্রয় করে না। শিল্প হলো স্বাতীর বুকের মানবিক হৃদপিণ্ড’। সেই মানবিক হৃদপিণ্ডের সন্ধানে একজন কবিকে সময় দিতে হয়, সময় নিতে হয়। দীর্ঘসময় ছিপ হাতে বসে থাকতে হয় কাঙ্ক্ষিত শব্দের জন্য। অথচ এরকম অভিযোগ এন্তার যে আমরা শিল্পের জন্য সেই সময়টিই দিতে নারাজ। আমরা সাধনার কঠিন পথটি পাড়ি দিতে চাই কৌশলে, কোনো পরিশ্রম না করেই।
আমরা সিঁড়ির শেষ ধাপে যেতে চাই, সিঁড়ির শুরুর ধাপগুলো না টপকেই। ফলে আমাদের মাঝে তৈরি হচ্ছে চটজলদি সিঁড়ি ভাঙার প্রবণতা। যাতে করে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। সাময়িক কলরোল, হৈ হুল্লোড় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করলেও, তা কোনো দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রাখতে পারে না। ফলে আজকে যে তরুণ মাতিয়ে রাখছে, যার প্রতিভার দ্যুতির বিচ্ছুরণ আমাদের চমকিত করছে, আগামীকালই তাকে শিল্পের কঠিন পথে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু শিল্পের পথ সাধনার, শিল্পের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা সময় সাপেক্ষ। এ এমন এক মাধ্যম, এমন এক সাধনা, যে জীবন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সুন্দরী তরুণীর দিকে তাকিয়ে থাকার মতো। মনে হবে সব সুন্দরী তরুণীই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমার হাসির পাল্টা হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছে, আমারই ইশারায় সে সাড়া দিচ্ছে। ব্রীড়া ভেঙে এগিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে কারো ইশারাই দেখছে না।
এখন যারা লিখছেন, মানে এই আলোচনার সূত্রপাত যাদের জন্য, তারা হলেন দিপংকর মারডুক, সাফওয়ান আমিন, অ্যালেইনা হোসেন, ইয়ার খান, সাকিব শাকিল, হিম ঋতব্রত, ম্রিতোষ তত্রাচ, সঞ্জয় পুণীক, শৈবাল নূর এবং জেসিকা আক্তার জেসি।
আলোচ্য তরুণদের কারোই শিল্পের পথে হাঁটা শুরুর বয়স পাঁচ হয়নি। সবে মাত্র একটি দশক, যাকে দ্বিতীয় দশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, শেষ হয়েছে। এখন আমরা রয়েছি নতুন দশকের সূচনা পর্ব। যার তিনটি বছর সবে যাই যাই করছে। সেক্ষেত্রে শেষ কথা তো দূরের, শুরুর কথাই বলবার সময় আসেনি। বাংলা সাহিত্যে দশক বিভাজনের শুরু, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। কল্লোল, প্রবাসী, শনিবারের চিঠিসহ সে সময়ের পত্র-পত্রিকার হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ এক ঝাঁক সাহিত্যিকের। এর আগে একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক সাহিত্যিকের দেখা পায়নি বাংলা সাহিত্য। তারা যেমন মেধায়, তেমনি মননেও ছিলেন স্বতন্ত্র্য। তাদের প্রত্যেকের রচনা আলাদাভাবে পাঠকের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি নতুন যুগে প্রবেশের সময় তারা সকলে মিলেই যে যুগযন্ত্রণাকে ধারণ করেছিলেন, সেই ছিল তাদের সনাক্ত করার প্রবণতা। মাত্র দশ বছর, একটি দশকের মেয়াদ। এই সময়ের মধ্যে অনেকেই আসেন শিল্পের সাধনায়, দশক পেরুনোর আগে প্রবল পরাক্রম নিয়ে আসাও অনেকে ঝরে যায়, হারিয়ে যায়।
আবার দশকের শুরুতে, মাঝামাঝি বা শেষেও নিভুনিভু হয়ে জ্বলতে থাকা তরুণটিই হয়তো দশক শেষে, বা দশক পেরিয়েও আরও দীর্ঘ সময় পর আলো ছড়িয়ে যেতে থাকেন। শিল্পের এই-ই নিয়তি, এই-ই পরিণতি। একবিংশ শতাব্দীর দুটি দশক আমরা পেরিয়েছি। এর মাঝে এ দশকের প্রথমে যারা, যাদেরকে আমরা শূন্য বা প্রথম দশক হিসেবে চিহ্নিত করেছি, তাদেরই কাউকে এখনো শক্তপোক্তভাবে পাঠক সনাক্ত করতে পারেনি। দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে তাদের কেউ পাঠককের কাছে পৌঁছুতে পেরেছেন, সে দাবি করার উপায় নেই। একইভাবে সদ্য শেষ হওয়া যে দ্বিতীয় দশক, তাদের নিয়েও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা শেষ হয়নি। দশকের লক্ষণগুলোও এখনো অনেকক্ষেত্রেই অমিমাংসীত। তারই মাঝে তৃতীয় দশক নিয়ে এই আয়োজনকে রীতিমতো দুঃসাহসই বলা চলে। যারা এ আলোচনা উস্কে দিয়েছেন, দুঃসাহস তাদেরও। কারণ দশক শেষ হবার আগেই এই আলোচনায় আসা দশজনের প্রত্যেকেই যে সাহিত্যের ভুবনে সচল থাকবেন তা আশা করাও হয়তো বাতুলতা। আবার এমনও হতে পারে, এদের অনেকেই হয়তো সাহিত্যের সঙ্গেই থাকবেন না, অথবা আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে সবাই টিকে থাকবেন এবং নিজের দশককে শাসন করবেন।
তাদের শিল্পরূপদানের এই পথে তারা পূর্বপুরুষের ইতিহাস স্মরণ করে এগিয়ে যাবেন, আপন লক্ষ্যে সংহত হবেন- এই প্রত্যাশায় ‘কপালে দিলাম ফোঁটা, দুয়ারে পড়লো কাঁটা’।
আলোচিত দশ তরুণকে, ঠিক তরুণ বলারও সুযোগ নেই। কারণ, এরই মধ্যে তাদের কারো কারো বইও আলোর মুখ দেখেছে। একজন কবি, একজন লেখককে তার প্রতিটি লেখাতেই পরীক্ষা দিতে হয়। একবার পরীক্ষা দিয়েই উত্তীর্ণ হয়ে গেছি ভাবার সুযোগ শিল্প দেয় না। এই তরুণরা সাহসী, সাহসী—এই অর্থে যে, তারা কাব্যজগতে প্রবেশের শুরুতেই গ্রন্থ্যের মধ্য দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে পেরেছেন। যা তাদের পূর্ববর্তী অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। পত্র-পত্রিকায় লেখা দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলেও, কবিতার বইয়ের জন্য তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে, ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যা কখনো কখনো দশক পেরিয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের তরুণদের যে ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিতে হয়নি। এ তাদের জন্য সৌভাগ্যেরই। তবে সেই সৌভাগ্য তাদের পরবর্তী সৃষ্টিকর্মে অন্তরঙ্গ উপস্থিতি হয়ে থাকবে কি-না, সে প্রশ্নের উত্তরই সময়ের হাতে। আগামীতে তাদের শিল্পবোধে জারিত হবার অপেক্ষা করতে করতে, বর্তমানে তাদের কবিতার দিকে মনোযোগ দেই। শিল্পের এবং জীবনের যে ব্যাপকতা তাকে ধরতে হলে প্রথম প্রয়োজন অভিজ্ঞতা। তা এই তরুণরা ইতোমধ্যে স্পর্শ করেছেন। ফলে তাদের কবিতায় এসেছে জীবনের নানা অনুষঙ্গ।
‘তুমি তবু ঘুরেফিরে বলছো তোমার গোলার্ধে তোমারই প্রাক্তন প্রেমিকের নাম;’ [দিপংকর মারডুক]
‘ভ্রমণ তো কতই হয়, তোমার দিকে চলার মতন ভ্রমণ পৃথিবী আর কয়টা দেখেছে বল?’ [সাফওয়ান আমিন]‘ছুটতে ছুটতে এই যে কতজন ছেড়ে যায়, যাচ্ছেও/ শুধু তোমার যাওয়াটাই ক্যানো যে বিচ্ছেদ হয়ে ওঠে। [ইয়ার খান]
‘কিন্তু ফুরায়া গেলে তার আর নাই কোনো শুরু’। [ সাকিব শাকিল]
‘মায়ের স্নেহে থাকে না—নেই কোনো বৈষম্য!/ এত এত জরা তবুও জীবনের ব্রত তাঁর সন্তান/ সে যে-ই হোক কাক কিংবা কোকিল-তার-ই তো ছা।’ [হিম ঋতব্রত]
‘দেখো—সন্ধ্যার আবছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি/ মিলিয়ে যাচ্ছি গাঢ় অন্ধকারে’ [ম্রিতোষ তত্রাচ]
‘আয়নার সম্মুখে দাঁড়ালে অভিশাপ মিথ্যে হয়ে যায়;’ [সঞ্জয় পুণীক]
‘মুখদেখা আয়না ভেঙে গেলে/ টুকরো টুকরো রক্তবাসনার ধার প্রতিফলিত হয় তাতে’ [শৈবাল নূর]
‘আম্মার গায়ের মতোন–অশ্রুনদী দিয়ে পারাপার হয় কিস্তির স্যার। হাড়ির খিদে আর/ আগুনের পুড়ে যাওয়ার দুঃখ।’ [জেসিকা আক্তার জেসি]
নিজেদের অবস্থানকে স্থায়ী করতে, জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির আবার কখনো বা জীবনেরই রূপচিত্রণে যে দক্ষতা ফুটে উঠেছে, তা আগ্রহী করে তোলে এই কবি এবং কবিতার প্রতি। জীবনবাস্তবতার আলেখ্য তুলে ধরতে, একনিষ্ঠভাবে প্রকৃতি ও জীবনের ছবি আঁকার যে দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছে এসব পঙক্তির মধ্য দিয়ে, তা কেবল মুগ্ধতাই ছড়ায়। কল্পনা এবং জীবনধারার মধ্য যে তারা যে ছবি আঁকতে সচেষ্ট হয়েছেন, শিল্পের যে দুর্গম পথ পাড়ি দেবার সাধনায় মেতেছেন, তাতে সহায়ক হয়েছে তাদের শিল্পবোধ।
শৈবাল নূর যখন তার ‘অন্ধ জ্যোতিষী’ কবিতায় লেখেন, ‘আর প্রেমিকাÑ/ হাওয়ায় দোলা সজনে গাছের মতো/ টিপ টিপ পাতঝরায়, ভেঙে যায়/ একদিন নিজের ভেতর খুঁজে নেয়/ প্রসন্ন নারীজীবন, সলা সলা সজনেফল।’ তখন যে রসানুভূতির হাওয়া আমাদের মনকে দোলা দিয়ে যায়, যে অপরিসীম শিল্পবোধ আমাদেরকে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চায়, তখন তার রসাস্বদনে একে জীবনবাস্তবতাহীন যেমন মনে হয় না, তেমনি এমন রচনা কোনো তরুণের বলেও বিভ্রম জাগে না।
ম্রিতোষ তত্রাচ যখন তার ‘ক্ষুধা’ কবিতায় বলেন, ‘যে আঙুল পরেছে ট্রিগারের প্রেমে/ আর যে জীবন ভাড়া নিয়েছে বন্ধুক/ বুলেট, একটা অজুহাত মাত্র/ সেখানে আঙুল ও জীবন একই সূত্রে গাঁথা। হুকুমের দাস/ ক্ষুধার বহুমাত্রিক কৌশলে বন্দী বুদ্ধিমত্তা অথবা/ ক্ষুধাকে কেন্দ্র করেই সমস্ত বুদ্ধির উৎপাত’। এখানে প্রাত্যহিক জীবনের সমগ্রতা চিত্রণে যে দৃশ্যকল্পের আশ্রয় নিয়েছেন, যে শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন, হৃদয়ের টানের সঙ্গে তীক্ষ্ম মেধার সংশ্লেষে যে শক্তির সঞ্চার হয়েছে, পঙক্তিগুলোর পরতে পরতে যে অভিজ্ঞান ছড়িয়ে পড়েছে, তা একজন নবীনের দ্বিধামুক্ত আগমনকেই স্পষ্ট করেছে।
সঞ্জয় পুণীক যখন বলেন, ‘যে জীবন বেঁচতে এসেছি এতোদূর, তা-ই যাপিত হচ্ছে চারদিকে,/ অভুক্ত পাগল আর বিনিদ্র কুকুরের জীবন কিনতে এসে বেফাঁস/ শহরের দেয়ালে সেঁটে দিয়ে গেলাম আমার নিখোঁজ সংবাদ।’ (একচক্ষু বেফাঁস শহর)
এই উপলব্ধি, যা আমাদের নিত্যসঙ্গী, যা কণ্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে আসার সুযোগ খোঁজে, যে দাবি আমাদের চৈতন্যে প্রতিনিয়ত জমাট বাঁধে, আমাদের বর্ণনাতীত দুঃখ এবং দুর্দশাকে যেভাবে সঞ্জয় পুণীক ভাষা দিলেন, তা তো এক রূঢ় বাস্তবতারই সত্যভাষণ।
আবার একইভাবে হিম ঋতব্রত যখন তার ‘তোমার মুখের দিকে’ কবিতায় বলেন, ‘তোমার মুখের দিকে তাকিয়েই/ কাটিয়ে দিতে পারি পৃথিবীর মৃত্যু অবধি/ এ শপথ নিয়ে শুরু হলো/ সিংহের শিকার পদ্ধতি ও হরিণের ঘাসজীবন/ ট্রেনের হুইসেল আর রেলক্রসিং রেলিঙের নামা-ওঠা/ সূর্য মেঘ-মেঘ সূর্য লুকোচুরি খেলা/ অতঃপর একদিন/ নীড়ে ফুরিয়ে এলো খড়কুটো/ থামলো ডানা ঝাপটানোর শব্দ/ পুড়ল সমস্ত পালক’ তখন শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য তো বটেই, প্রতিনিয়ত জায়গা করে নেওয়া এক রূঢ বাস্তবতার ছবি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রেমের অজেয় পঙক্তির ভেতর দিয়ে কৌশলী হয়ে বিবেককে জাগিয়ে তোলার এই আত্মভাষণ জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও জটিলতাকেই সামনে নিয়ে আসে।
নগরজীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ এই তরুণদের বিভ্রান্ত করেনি। তারা অবক্ষয়ের উৎসবে সাড়া দেয়নি। তাদের পঙক্তি থেকে হারিয়ে যায়নি জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস। ঐতিহ্যের কাছে, উত্তরাধিকারের কাছে তাদের এই সমর্পণ আশা জাগানিয়া। লোকঐতিহ্য এবং লোকায়ত অনুষঙ্গও তাদের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। তবে একই সঙ্গে কারো কারো কবিতায় যথেচ্ছ ইংরেজি শব্দের ব্যবহার পীড়া দেয়। বাংলা ভাষার গ্রহণের ক্ষমতা অনেক, তার ধৈর্য্য ও সহ্য ক্ষমতাও অনেক বেশি। জীবন্ত ভাষা মাত্রই গতিশীল। যে ভাষা যতো বেশি জীবন্ত তার গ্রহণের ক্ষমতাও ততো বেশি। আমরাও ইতোমধ্যে অসংখ্য বিদেশি শব্দকে আত্মস্থ করেছি। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারে, সেগুলোর যথাযথ পরিভাষা তৈরি না হওয়ায় সেই বিদেশি শব্দগুলোকেই বাংলাভাষা তার নিজের করে নিয়েছে। আবার ধর্মীয় কারণেও নানামুখী শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। ভাষার ধর্মান্তকরনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যার কোপ থেকে মুক্ত ছিলেন না স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলামও। তাই তার কবিতার মহাশ্মশান শব্দটিও হয়ে যায় গোরস্থান। ভাষার ওপর এরকম জুলুম অনেকে মেনেই নিলেও যারা কবি, যারা ভাষারই কারিগর, যারা শব্দের রক্ষক, তারাই যদি বিনা কারণে বিদেশি শব্দের যত্রতত্র ব্যবহার করেন, শব্দের ওপর মর্মান্তিক নির্যাতন করেন, তবে সে পীড়ার যন্ত্রণা সাধারণে বুঝতে অক্ষম।
দার্শনিকতায়, জীবন ও প্রেমানুষঙ্গের প্রকাশে, হৃদয়ের উন্মোচনে, শিল্পমণ্ডিত চিত্রভাষ্যে আলোচ্য তরুণরা যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, তাদের শিল্পরূপদানের এই পথে তারা পূর্বপুরুষের ইতিহাস স্মরণ করে এগিয়ে যাবেন, আপন লক্ষ্যে সংহত হবেন- এই প্রত্যাশায় ‘কপালে দিলাম ফোঁটা, দুয়ারে পড়লো কাঁটা’।