[চিন্তাসূত্রের বিশেষ আয়োজন ‘আমার প্রিয় কবিতা’। এই আয়োজনে লিখছেন প্রধান কবিরা, জানাচ্ছেন নিজের অনুভূতি। আজ লিখেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মামুন রশীদ।]
প্রিয় কবি, প্রিয় কবিতা নিয়ে লেখা এই প্রথম। শুধু লেখা না বলাও সম্ভবত প্রথম। আমার প্রিয় কবিতা সম্পর্কে বলার আগে প্রিয় কবিকে জানানো প্রয়োজন। কারণ, যার কবিতা আমার প্রিয়, তাকে জানাও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা দেই। এতে পাঠকের সুবিধা না হলেও আমার নিজের সুবিধা। কবিতা ভালো লাগে। পড়তে ভালোবাসি, শুনতে অতটা না। নিজের চোখে দেখে, শব্দের গন্ধ শুকে কবিতা পড়তে ভালো লাগে। ছেলেবেলা থেকেই, মানে স্কুলে পাঠ্য কবিতা পড়ার সময় থেকেই কবিতা ভালো লাগে। কিন্তু বই পড়তে ভালো লাগতো না, পড়ার কথা শুনলেই গা কাঁপিয়ে যেন জ্বর আসতো।
বই বলতে বুঝি—স্কুলের পাঠ্যবই। এর বাইরে যা, তার সবই আউট বই। তবে স্কুলে পড়ার সময়েই পাঠ্যসূচির বাংলা বইটির প্রতি একটা আলাদা টান অনুভব করেছি। বাবা-মা পড়ার কথা বললেই, অথবা পড়ার নির্ধারিত সময় হলেই আমি বাংলা বই খুলে বসতাম। গল্প পড়তাম, কবিতা পড়তাম। কবিতা পড়ার সময় যে কবিতাগুলো আমার ভালো লাগতো সেগুলো পড়তাম জোরে জোরে, অনেক বার করে। স্কুলের পাঠ্যসূচির অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। অন্য বই হাতে নিতেই চাইতাম না। স্কুল ফাইনালে বাংলায় কেমন কেমন করে যেন বেশ ভালো নম্বর উঠলেও অন্যগুলোতে কোনোমতে শেষ লাইন ডিঙাতে হতো। যদিও আটকে যাইনি কখনোই একই ক্লাসে— তাই বাড়িতেও হয়তো একটা চাপা স্বস্তি থাকতো। সেই স্কুলের সময়ে যে কবিতাগুলো ভালো লাগতো, যেগুলো আমার কণ্ঠস্থ ছিল, সে কবিতার রচয়িতা কবিদের প্রিয় ভাবতাম একসময়। সেই সঙ্গে এও মনে হতো—এই কবিতাগুলো আমার নিজেরই লেখা উচিত ছিল। পাঠ্যবইয়ে সবার অগোচরে কবির নাম পাল্টেও দিয়েছি কখনো কখনো।
এখন প্রিয় কবিতা নিয়ে লিখতে বসে, মনে পড়ছে অসংখ্য কবিতার পঙ্ক্তি। স্কুলের পড়া পাঠ্যের অনেক পঙ্ক্তিই এখনো মনের মধ্যে গুনগুন করে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়া, সমাসময়িক তো বটেই অগ্রজদের অনেক কবিতার কথাও মনে আসছে। কিন্তু এখন লিখতে বসে সত্যিকার অর্থেই ভাবতে শুরু করেছি, কে আমার প্রিয় কবি? কোন কবিতাটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। কবিতা তো অনেকেরই পড়েছি, এখনো পড়ি। সমসাময়িকদের যেমন তেমনি অগ্রজদেরও। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ার বিষয় ছিল—বাংলা। ফলে প্রাচীন কবিদের কবিতা যেমন, তেমনি মধ্যযুগের বিভিন্ন পর্বের কবিতাও পড়তে হয়েছে। কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো ভালো লাগা থেকে। আর সেইসঙ্গে কবিতার প্রতি আগ্রহ থাকায় এসব কবির কবিতা শুধু পরীক্ষার খাতায় উদ্ধৃত করে উতরে যাওয়ার জন্যই নয়, মনের তাগিদেও পড়েছি। এখনো সেই সময়ের কারো কারো কবিতা পড়ি। কিন্তু প্রিয় কবি ও কবিতা প্রশ্নে দ্বিধা ভর করে। যদিও দ্বিধা থাকার কথা না, তবু। তার কারণ—প্রিয় কবির কথা ভাবতে গিয়ে দুজন কবির নাম আমার মনে আসে। তাদের একজন বাঙালি বাংলাভাষার কবি আর অন্যজন বাঙলার কবি নন এমনকি বাংলার ভাষারও কবি নন, তবু তিনি স্বীকৃত বাঙালির কবি হিসেবেই। তাই ভাবছিলাম তাদের মধ্যে কে প্রিয়? যিনি বাংলা ভাষায় লেখেননি, তিনি কি আমার প্রিয় হতে পারেন? তার কবিতা কি আমার প্রিয় হতে পারে? মনের এই দ্বিধা একসময় সরিয়ে ফেললাম, মনে হলো বাংলায় না লিখেও যিনি বাঙালির মন জয় করেছেন, যিনি বাঙালির আবেগকে ধরেছেন, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, যার কবিতা বাঙালির মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে, যার কবিতার মধ্য দিয়ে আমার মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে, তাকে প্রিয় কবির তালিকার প্রথমেই রাখা যায়। হ্যাঁ, আমার প্রিয় কবি—বিদ্যাপতি। অভিনব জয়দেব অথবা মৈথিল কোকিল নামেও যিনি পরিচিত, সেই বিদ্যাপতি আমার প্রিয় কবি।
বিদ্যাপতি এই বাংলার কবি না হয়েও আমাদের হৃদয়ের কবি। আমার হৃদয়ের কবি। খুব বেশি একা হলে, মন খারাপ হলে, নিজের চারপাশের জগৎ অসহ্য মনে হলে বড় বেশি আপন হয়ে ওঠেন বিদ্যাপতি। যদিও সাহিত্যের বিশেষত বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছাড়া সম্ভবত তিনি এখন আর সাধারণের কাছে পরিচিত নন, তার কবিতাও হয়তো পঠিত হয় না সাধারণ্যে, তবু তিনি আমার প্রিয়। বৈষ্ণব ধর্ম চর্চার স্বর্ণযুগে, শ্রী চৈত্যদেব বর্তমান থাকাকালীন সময়ে এবং তার অনেক পরও বিদ্যাপতি ছিলেন এই বাংলার জনপ্রিয়তম কবি। ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দ বিন্যাসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অদ্বিতীয়। উপমা ও অলঙ্কার সৃষ্টিতে তার দক্ষতা ও কৃতিত্ব অসামান্য। তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলি রচনা।
রাধা-কৃষ্ণের স্পষ্ট উল্লেখ আছে তার এমন পদের সংখ্যা পাঁচ শতেরও বেশি। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে বর্ণিত নায়ক-নায়িকার প্রকরণ অনুসারে তিনি রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগ, প্রথম মিলন, রাধার বয়ঃসন্ধি, বাসক-সজ্জা, অভিসার, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিত কলহান্তরিতা বা মান, বিরহ বা মাথুর, পুনর্মিলন বা ভাবসম্মিলন প্রভৃতি লীলা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে রাধা কৃষ্ণের বিরহ ও মিলনলীলা বর্ণনা করেছেন। আর রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বিরহ, রাগ, অনুরাগের প্রকাশের মধ্য দিয়ে পঞ্চদশ শতাব্দীতে তিনি বাঙালি না হয়ে, বাংলা ভাষায় না লিখেও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পড়েন। এর প্রধান কারণ, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনার মধ্য দিয়ে তিনি ভাষাকে অতিক্রম করে বাঙালির মনোজগতে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। যা তাকে করে তোলে বাঙালির কবি, বাঙালি হূদয়ের কবি। বিদ্যাপতির পদে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাধা চরিত্রের উত্তরণ। বয়োসন্ধি থেকে রাধার বেড়ে ওঠা, তার জীবন ও চরিত্রের বিকাশের নানা পর্যায় উঠে এসেছে বিদ্যাপতির পদে। বিদ্যাপতি মৈথিলি, সংস্কৃত ও অবহট্ট ভাষায় অনেক বই রচনা করেলেও বাংলা ভাষায় তার রচিত কোন পদ নেই। বরং তার রচিত পদের মৈথিল শব্দ বাঙালি প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে পরিবর্তিন করেছে, সেই পদের রস আস্বাদন করেছে। এই পরিবর্তনে বিদ্যাপতির রচনার বিশুদ্ধি ক্ষুন্ন হয়েছে, কিন্তু তার মহিমা ক্ষুন্ন হয়নি। মৈথিল শব্দের পরিবর্তনে যে মিশ্র বাংলা ভাষা—তাই পরবর্তীকালে ব্রজবুলি নামে পরিচিতি পায়। মিথিলার রাজবংশের এই কবিকে বিভিন্ন সময়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন মিথিলার রাজা কীর্তি সিংহ, শিব সিংহ, দেবী সিংহ এবং রানী লছমি দেবী। ফলে বিদ্যাপতি মিথিলার হয়েও একান্তভাবে হয়ে ওঠেন বাঙালির কবি। বিদ্যাপতি ঠিক কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অথবা তার মৃত্যুর সঠিক তারিখও কারো জানা নেই। ধারণা করা হয় তিনি আনুমানিক ১৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিহারের দ্বারভাঙ্গার বিসফি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। আর বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন এই বিবেচনা থেকে পণ্ডিতদের ধারণা বিদ্যাপতি অবশ্যই চৈতন্য-পূর্ববর্তী কবি ছিলেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে একই নামে একাধিক পদকর্তার পদ রচনার বিষয়টি খুবই প্রকট ছিল। ফলে নাম বিভ্রাটে প্রকৃত পদ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন গবেষকদের কাছে। বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতাদের অন্যতম চণ্ডীদাসের ক্ষেত্রে এ সমস্যা যেমন প্রকট, বিদ্যাপতির ক্ষেত্রে অতোটা নয়।
বিদ্যাপতির নামে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বহু পদ পাওয়া গেলেও গবেষক খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও বিমানবিহারী মজুমদার ৯৩৩টি পদকে নিঃসন্দিগ্ধভাবে বিদ্যাপতির রচনা বলে চিহ্নিত করেন। তার অনেক অসমাপ্ত পদ বৈষ্ণব পদাবলির আরেক বিখ্যাত পদকর্তা গোবিন্দদাস পূর্ণ করেছেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি বিদ্যাপতিকে গুরু হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েই তা করেছেন। বৈষ্ণব-অবৈষ্ণব সবাই বিদ্যাপতির পদের রস আস্বাদন করেছেন। আজ হয়তো তিনি বহুল পঠিত নন, তার অর্থ কি বিদ্যাপতি এবং তার কবিতার হারিয়ে যাওয়া? আমার তেমন মনে হয়নি। কারণ রাধা— তথা একটি নারী চরিত্রের যে বিবর্তন ও উত্তরণের চিত্রকল্প তিনি নির্মাণ করেছেন, তা আজো তুলনারহিত। বিদ্যাপতির অসামান্য প্রতিভার তুলনা কি হয়? তার পদের পঙ্ক্তিগুলো এখনো পাঠেই বোঝা যায়, এ শুধু আমাদেরই জন্য। তিনি সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি পরিণত ছিলেন। আর তাই এই সময়ে এসেও বিদ্যাপতির পদগুলো মনে হয় এই সময়েরই কবিতা—আমাদের কবিতা।
বিদ্যাপতি যেমন আমার প্রিয় কবি, তেমনি তার কবিতাও। এক্ষেত্রে প্রিয় কবিতার কথা যদি বলি, তাহলে বিদ্যাপতির নিচের পদটিকেই আমি সামনে রাখতে চাই।
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর॥
ঝম্পি ঘন গর্জন্তি সন্ততি
ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া॥কুলিশ শত শত পাত-মোদিত
ময়ুর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া॥তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া॥
বাংলা সাহিত্যে প্রিয়ার সান্নিধ্যে আকুল, বর্ষণ মুখর দিনের এমন আকুলতা ভরা, সখির কাছের নিজের মর্মবেদনার এমন আন্তরিক চিত্র আমি আর পাইনি। দৃশ্যের পর দৃশ্যের বর্ণনার মাধ্যমে যে আকুলতা বিদ্যাপতি আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে তুলে এনেছেন, আমার কাছে আজো এর তুলনা নেই। তাই আমার প্রিয় কবি—বিদ্যাপতি, তার রচিত ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’ আমার প্রিয় কবিতা।