প্যাকেটজাত বক্তব্যের সময় নিজেকে বিশ্বক নাগরিক দাবি করা মানুষটির ভেতরও সূক্ষ্ণ আঞ্চলিকপ্রীতি থাকে। থাকতে হয়। কারণ দিন শেষে ওটাই তো শেষ আশ্রয়স্থল। ওটুকুই আসল পরিচয়। নাগরিক হিসেবে আমার অঞ্চলপ্রীতি স্পষ্ট। আমি ইউরোপের একটি দেশে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম শুধু খলবলিয়ে কথা বলতে পারবো না কারণে। যান্ত্রিক নগরেও নিজ জেলা-উপজেলার কাউকে দেখলে বুকের ভেতর শীতলতা অনুভূত হয়। একইরকম শীতলতা ছুঁয়েছিল যেদিন জানলাম, সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর আমাদের গোপালগঞ্জের মানুষ।
বাঙালি হিসেবে যেমন আমার গর্বের জায়গা আছে, তেমনি আমার গর্বের অংশ জন্মভূমি গোপালগঞ্জও। গোপালগঞ্জকে আমি বলি গুণীজন জন্মের উর্বর ভূমি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রখ্যাত আলেম আল্লামা সামছুল হক ফরিদপুরী, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, হরিচাঁদ ঠাকুর, বাউল সাধক ও লোককবি ফটিক গোঁসাই, কবি বিনয় মজুমদার, সাংবাদিক নির্মল সেন থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত অসংখ্য গুণীজনের শেকড় ওই গোপালগঞ্জে।
এন্ড্রু কিশোরও ওই গোপালগঞ্জেরই মানুষ। যদিও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। তবে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের চিথলীয়া গ্রামে অবস্থিত পৈত্রিক ভিটার প্রতি ছিল তার বিশেষ টান। মাঝে-মধ্যেই ছুটে যেতেন সেখানে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এ সময় তিনি তার পৈত্রিক ভিটায় একটি ‘প্রার্থনা কুঞ্জ’ করতে চেয়েছিলেন। এই এন্ড্রু কিশোরের চাচাতো ভাই পূর্ণদান বাড়ৈর দেওয়া তথ্যে সংবাদও প্রকাশ করেছে কয়েকটি গণমাধ্যম।
পূর্ণদান বাড়ৈ বলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর আমার কাকাতো ভাই। তার পিতার নাম ক্ষিতিশ বাড়ৈ। এন্ড্রু কিশোররা তিন ভাই-বোন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন সবার ছোট। তার বড় ভাইয়ের নাম স্বপন বাড়ৈ। বোন শিখা বাড়ৈ। আমার কাকা ক্ষিতিশ বাড়ৈর কর্মস্থল ছিল রাজশাহী। তিনি ওখানে চিকিৎসা পেশায় জড়িত ছিলেন। ওখানেই এন্ড্রু কিশোরের জন্ম। তবে তার বাবার জন্ম কোটালীপাড়ায়। তিনি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রতিবছরই কোটালীপাড়ায় বেড়াতে আসতেন।’
গুণী এই শিল্পীর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে বলিউডের গানে নিয়মিত কণ্ঠ দেওয়ারও পরামর্শ দেন। এমনকি বিশেষ অনুরোধও করেন আর ডি বর্মণ। সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেন মায়ের ভাষা, দেশমাতৃকার টানে। মায়ের ভাষায় তিনি আমৃত্যু গানের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন।
এন্ড্রু কিশোরের ইচ্ছেটি অপূর্ণ রয়ে গেলো। তবে গোপালগঞ্জের মানুষের কাছে তার বিশেষ স্থান শক্তভাবেই রয়ে যাবে অনন্তকাল। এন্ড্রু কিশোর ছিলেন পরিশ্রমী শিল্পী। ক্যারিয়ার শুরুর দিকে রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে গান রেকর্ডিং করে ফিরে যেতেন এন্ড্রু কিশোর। পরে সংগীত জগতে থিতু হতে রাজশাহী ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। রাজশাহী সিটি কলেজে পড়ার সময়ই পূজা-পার্বণে গান গেয়ে পরিচিত পেলেও ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বেতারের এক আয়োজনে গাইতে ঢাকায় এসে তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়।
এন্ড্রু কিশোরের গান শুনে বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন প্রযোজক তাকে সুরকার আলম খানের কাছে নিয়ে যান। আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের গানে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় তার। একে একে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙের ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, চোখ দুটো খেয়ো না’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে মন যেখানে হৃদয় সেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’-এর মতো কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের।
বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদানের জন্য তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। আরও কণ্ঠ দিয়েছেন বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রের গানে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের পুরুষ কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে এন্ড্রু কিশোরই প্রথম বলিউডের সিনেমায় গান গেয়েছিলেন। তার গাওয়া সেই গান ছিল উপমহাদেশের অন্যতম সঙ্গীতজ্ঞ আর ডি বর্মণের সুরে, ‘শত্রু’ সিনেমায়।
ওই সিনেমার গানে আরও কণ্ঠ দেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে। বলিউডের সিনেমায় পা রেখেই বলিষ্ঠ, সুমধুর কণ্ঠের জোরে তার মায়ের প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের গানে ভাগ বসান। কিশোর কুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গান করে সুনাম কুড়ান এন্ড্রু কিশোর। আর ডি বর্মনের সুরে তার গাওয়া ‘এর টুপি ওর মাথায়’ গানটির হিন্দি ভার্সন ‘ইসকি টুপি উসকি সার’ গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
আর ডি বর্মণ আদর করে এন্ড্রুকে ‘ঢাকাইয়া’ বলে ডাকতেন। শুধু তাই নয়, গুণী এই শিল্পীর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে বলিউডের গানে নিয়মিত কণ্ঠ দেওয়ারও পরামর্শ দেন। এমনকি বিশেষ অনুরোধও করেন আর ডি বর্মণ। সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেন মায়ের ভাষা, দেশমাতৃকার টানে। মায়ের ভাষায় তিনি আমৃত্যু গানের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন।
দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভোগার পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা চলাবস্থায়ই হুট করে ফিরে আসেন দেশের টানে। দেশমাতৃকার বুকে। তার ইচ্ছে ছিল এ দেশের মাটিতেই যেন তার মৃত্যু হয়। এজন্যই নিজের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সোমবার সন্ধ্যায় সমস্ত মায়া ত্যাগ করে দয়ালের ডাকে সাড়া দেন এই কিংবদন্তী শিল্পী।