নুতন বইয়ের পাতা উল্টাতে-উল্টাতে পড়ার সেই দিনগুলো কি হারিয়ে ফেলেছি? ভুলে গেছি নুতন বইয়ের ঘ্রাণ? হয়তো বা এসব প্রশ্নের উত্তরই ভুলে বসে আছি চুপচাপ। না, দিন বদলের সঙ্গে-সঙ্গে বদল হয়েছে আমাদের চেতনা বোধ। সময় সরে দাঁড়িয়েছে সময়ের শরীর থেকে। শরীরের খোলস এড়িয়ে আমরা হয়তো বা হাঁটছি নতুনের হাত ধরে।
সম্প্রতি ভার্চুয়াল দুনিয়ার দিকে আমাদের বেশি বেশি মনোযোগ থাকার কারণে বই কেনা ও বই পড়ার অভ্যাস কি দিন দিন বিলুপ্ত হবে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়াটা বইয়ের পাঠকের জন্য কতটুকু যৌক্তিক, সেটাও ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে। একটি বইকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে প্রয়োজন, নিয়মিত পাঠক ও পাঠাভ্যাস নিশ্চিত করা। আমরা বইয়ের পাতায় না যতটুকু চোখ রাখি, তারও চেয়ে বেশি মুখ গুঁজে রাখি ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। এটুকু মানতেই হবে যে, সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে গেলে ভার্চুয়াল দুনিয়ার সঙ্গে নিজেদের এগিয়ে রাখতে হবে। তাই বলে, শেকড়কে বিসর্জন দিয়ে নয়। তবে, বইয়ের পাতায় পাঠককে ফিরিয়ে আনতে গেলে কী পড়ছি, কেন পড়ছি—তার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকতে হবে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পাঠককে কতটুকু আকৃষ্ট করবে তা নির্ভর করবে ওই বইয়ের গুণগত মানকের ওপর। মানসম্মত বই পাঠকই হাতে তুলে নেবে, এটাই কাম্য। তাই সংখ্যা নয়, মানের দিকটিও ভাবতে হবে প্রকাশকদের।
একুশে বইমেলাকে মাথায় রেখে সারাবছর ধরে লেখক ও প্রকাশক মহলে জোর প্রস্তুতি লেগে থাকে। বইমেলাতে যে বিষয়টি বেশি খেয়াল করা যায়, সেটি হলো নবীন লেখকদের অসংখ্য প্রকাশনা। এ বিষয়ে নবীন লেখকদের মাথায় রাখা প্রয়োজন—রাতারাতি লেখক বনে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিতে হবে। আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। বই প্রকাশ করার পর বই যদি মুড়ি-চানাচুরের ঠোঙা বানানোর কাজে যোগান দেয়, তবে সেই বইয়ের জন্ম না হওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি। নবীন লেখকদের বই সাধারণত প্রকাশকরা আর্থিক ঝুঁকি বিবেচনা করে প্রকাশ করতে চান না। তাই অনেক নবীন লেখক স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আর্থিক ঝুঁকি নেন। ফল যেটা হয়ে থাকে, সেটা আমাদের সবারই জানা। এক পর্যায়ে বইগুলো হয়তো বা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে অন্ধকারের জঠরে। আর কিছু বই, নিত্য ঝুলে থাকে লেখকের ঝোলায়। এমন লেখক ও লেখার সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে অপুষ্ট ও কঙ্কালসার লেখারও জন্ম হচ্ছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো। অন্যদিকে, বই কেনা ও বই পড়া বিষয় দুটিকে একই রেখায় মিলিয়ে হিসাব কষাটা অনেক সময় ঠিক নাও হতে পারে। কেননা, বই পড়ার খিদে থাকলেও বই কেনার মানসিকতা নাও থাকতে পারে। আবার বই কেনার মানসিকতা থাকলেও বই কিনে দিনের পর দিন ফেলে রাখার প্রবণতাও থাকতে পারে। এখানে যে বিষয়টি দরকার, তা হলো—সুস্থ ধারার পাঠাভ্যাস। চায়না প্রবাদে আছে, যে ব্যক্তি পর পর তিন দিন বইপাঠ থেকে বিরত থাকে, সে তার কথা বলার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। আমাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে ভেতরের সৌন্দর্য প্রকাশ পাবে তখনই, যখন একটি মানসম্মত বই থেকে পাঠক কিছু আহরণ করতে পারবে।
সারাবছরের চেয়ে বইমেলার ভূমিকা এ বিষয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়ার দাবি রাখে। কেননা, একটি দিবস যেমনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় সেই দিবসের তাৎপর্য, তেমনি সারাবছরের চেয়ে বইমেলাতে মানুষকে বই কেনার জন্য আগ্রহী হতে দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শৈশব-কৈশোরে যাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে তাদের জীবন সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য। সুতরাং, বই মানুষের মনুষত্ববোধকে বাঁচিয়ে রাখে বলে বইকে আমাদের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। শুধু সাহিত্যচর্চার জন্য বই কেনা বা পড়া নয়, বই হতে পারে খেটে খাওয়া মানুষের আলোর দিশারী। সব শ্রেণীর জন্য বইমেলার ভূমিকা বিশেষভাবে অনস্বীকার্য। দেশের সার্বিক কল্যাণের পাশাপাশি একটি নীতি নির্ধারণেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে—একুশের বইমেলা। ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের বইমেলা বাণিজ্যিক হিসেবে বিবেচিত হলেও আমাদের দেশের বইমেলা এখনো পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বইমেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। কারণ, আমরা শুধু বিকিকিনির জন্য বইমেলা করি না, আমাদের ভাষাপ্রীতি ও জাতিসত্তার তাগিদেই বইমেলার উদ্ভব। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ১৯৮৪ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন হয়। যদিও মেলাটি ১৯৮৩ সালে হওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য আটকে যায়। এর আগে ১৯৭৪ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়াজনে প্রথম আয়োজন হয়, আন্তর্জাতিক বইমেলা। ১৯৮৪ সালের পর থেকেই একুশের মাসব্যাপী বইমেলা বাইরের দেশগুলোর কাছে প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর বইমেলার সঙ্গে আমাদের বইমেলাকে তুলনামূলক বিবেচনা করলে হয়তো বা কিছু কিছু বিষয়ে ঘাটতি থাকতেই পারে। ভালো-মন্দ থাকবে এটি মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।
সাংস্কৃতিক সংগ্রামের জন্য দরকার বই। সাংস্কৃতিক জাগরণের নমুনা হিসেবে ১৪৫০ সালে ইউরোপে বইয়ের মূদ্রণ একহাজার ছাড়িয়ে নয় লাখে পৌঁছে যায়। নিছক ব্যক্তিক জাগরণ ব্যতিত এই সামগ্রিক জাগরণের উদ্ভব হওয়া বেশ কঠিন। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতিকে তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ধরা যায় এই বইমেলাকে। কেননা, বই হলো সেই মাধ্যম যার দ্বারা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায় একটি ইতিবাচক নতুন ধারণা। ইতিহাসকে জানা বা না জানা পাঠকের বাধ্য বিষয় নাও হতে পারে, তবে ইতিহাসকে বইয়ের পাতায় তুলে আনা উচিত বলে করি। কারণ কৃষ্টিকে শিকড়হীন করে উপড়ে জল-বাতাস দিলে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে—সেটা আমাদের সবারই জানা। সুতরাং বইমেলায় অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি আমাদের সংস্কৃতির ধারাকে বহির্দেশে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সর্বজনস্বীকৃত ভাষাতে বইয়ের মুদ্রণ। তাহলে আমাদের সংস্কৃতি বা কৃষ্টিকে প্রতিবেশী কিংবা দূরের দেশে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। সেই সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলোর কৃষ্টি, সংস্কৃতি কিংবা সাহিত্যচর্চাকে জানার জন্য বাংলাভাষায় বইয়ের মুদ্রণও দরকার। এই অনুবাদ বিষয়ে বাংলা একাডেমিসহ যথাযথ মাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে বিষয়টি অনেক সহজ হবে বলে আশা করি। এছাড়া, শিশুতোষ, রম্যরচনা কিংবা গবেষণাধর্মী বই একুশের বইমেলায় অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে থাকে। সেজন্য এ ধরনের বইয়ের দিকেও প্রয়োজনীয় দৃষ্টি রাখা দরকার।
বইমেলায় প্রতিবছরই নুতন বইয়ের সমাগম ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। তবে নতুনত্বের আড়ালে কখনো কখনো ঢেকে যায় বইয়ের ভিতরের অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলো। বাইরে থেকে চকচকে মনে হলেও কিংবা চোখ ধাঁধানো প্রচ্ছদ দেখা গেলেও অনেক সময় ভেতরের বিষয়বস্তু কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে তা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ, বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর অনেকাংশই সম্পাদনা ছাড়া প্রকাশিত হয়ে থাকে। নামমাত্র কিছু বইয়ের সম্পাদনা হয়ে থাকে। অন্যদিকে, হাতে গোনা কিছু সম্পাদনাশিল্প-প্রতিষ্ঠান বাজারে বিদ্যমান। হয়তো বা প্রকাশকদের আর্থিক বিষয়টি বিবেচনা করে সম্পাদনার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই যদি সম্পাদনা শেষ করেই মেলাতে বই প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় তবে নব্য অথবা অন্যান্য লেখকদের বই প্রকাশে কেন সম্পাদনার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে না? এখানে লেখক যেমনি উপকৃত হবে তেমনি পাঠকও উপকৃত হবে। গঠনশৈলী একটি বই ‘ভুলে ভরা বই’ হিসেবে খ্যাতি পেলে ওই বইয়ের প্রয়োজনীয়তা ফুরোবার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যায় ওই লেখকের প্রয়োজনীয়তাও। ফলে লেখক তার মজবুত অবস্থান থেকে ছিটকে পড়তেই পারে। সেহেতু, নেপথ্যে সম্পাদনাশিল্পকে এড়িয়ে যাওয়াটা লেখক ও প্রকাশকদের জন্য উচিত হবে না বলে মনে করি।
বলা হয়, বই হোক ভালোবাসার উপহার অথবা প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। কথাটির ভেতরে একধরনের দ্যোতনা আগেই তৈরি হয়ে আছে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে বই উপহারের বিকল্প নেই। তাই সামাজিক অথবা ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে। তাই ভলতেয়ার বলেছেন, যদি মানুষ তাদের বাজে খরচের পরিবর্তে বই কেনার পেছনে অর্থ ব্যয় না করে, তাহলে নিজেদের সভ্য বলে কখনো দাবি করতে পারবে না। সমাজ-সংস্কারের পাশাপাশি ব্যক্তি-সংস্কারেও ভূমিকা রাখে একুশে বইমেলা ও বই। মানুষ প্রসন্ন ও পরিচ্ছন্ন বলেই বইমেলাতে বইয়ের খোঁজে আসে। পরিশীলিত ও মার্জিত বই মানুষকে আরও পরিচ্ছন্ন করে তোলে। বদ্ধ মনের জানালা-দরোজা খুলে মনের খোরাক মিটিয়ে মানুষের জীবিকারও যোগান হতে পারে বই। কেননা বইকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পেশাভিত্তিক বিভিন্ন শ্রেণীপেশা। বই মূদ্রণ থেকে মেলা অবধি তৈরি হয় বিভিন্ন কর্মসংস্থান। তবে এ বিষয়ে যথাযথ বিভিন্ন মাধ্যমকেও যত্নবান হতে হবে।
একটা সময় ছিল, যখন প্রায় ঘরে ঘরে বইয়ের ছোটখাটো আলমারি থাকতো। জনসংখ্যা বাড়লেও এই আলমারির সংখ্যা এখনও পর্যাপ্ত নয়। এই সমস্যা উত্তরণে আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সব শ্রেণীকে। ভালোবাসতে হবে বইকে, গড়ে তুলতে হবে সুস্থধারার পাঠাভ্যাস। বর্ষপঞ্জি হিসাব করে বই পড়া নয়, বই পড়ার অভ্যাস হতে হবে অবিরাম।