সকালবেলা ঘুম ভেঙে সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাসে ভাটা পড়েছে। তার জায়গায় স্থান নিয়েছে ফেসবুক। হাতের কাছের সেলফোনটা এখন শুধু কথাবার্তা বলারই মাধ্যম নয়, একইসঙ্গে নানা কাজের কাজিও। প্রতিদিনের মতো ঘুম ভাঙার পর আলসেমিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে (১৬.০৮.২০১৬) ফেসবুক খুলি। নিউজফিডে প্রথমেই ভেসে ওঠে কবি কামরুল বাহার আরিফের পোস্ট। চোখে তখনো ঘুম লেগে আছে। চমকে উঠি পোস্টটা দেখে। আজ কি পহেলা এপ্রিল? ধুম মনে মনের মধ্যে উঁকি মারে। চোখ কচলে নিয়ে আবার চোখ রাখি। একে একে রাজশাহীর অনেকেরই নিজের নিজের ফেসবুক ওয়ালে ভেসে উঠতে থাকে কবি ওয়ালী কিরণের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তার একক মুখের সঙ্গে সঙ্গে অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগত স্থিরচিত্রও উঁকি দিতে থাকে। বিশ্বাস হয় না ওয়ালী কিরণ নেই। ইসলাম রফিককে সেলফোনে কল দেই। জানতে চাই, সত্যি কিরণ ভাই নেই? ওপাশ থেকে সায় মেলে। বুকের ভেতরটা মোচড়াতে থাকে। কষ্ট আমার বুকে চেপে বসে থাকে। ওয়ালী কিরণ নেই, দেহ ছেড়ে চলে গেছেন উৎস ভূমির কবি।
অনেক দিন যোগাযোগ নেই, ছিল না। শেষ দেখা গত বছর টাঙ্গাইলের কবি সম্মেলনে। আগের মতোই আছেন, আমার দেখা সদা হাস্যচ্ছ্বল প্রাণবন্ত কবি ওয়ালী কিরণ।
কিরণ ভাইকে নিয়ে স্মরণকথা লিখবো, কখনোই মনে আসেনি। তার কবিতা নিয়ে কিছু লিখলে তিনি খুশি হতেন। হয়তো কখনো আশাও করে থাকতে পারেন। কিন্তু কেন যেন কখনোই তাকে নিয়ে, তার কবিতা নিয়ে আমার কিছু লেখা হয়ে ওঠেনি। আমার সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৫/৯৬ সালে। তখন গাইবান্ধা জেলায় চাকরি করতেন। ইসলাম রফিকেরও কর্মস্থল ছিল গাইবান্ধা। রফিক ভাইয়ের মাধ্যমেই পরিচয়। গাইবান্ধা থেকেই তখন প্রকাশ হতো তাঁর সম্পাদিত কাগজ ‘ক্রম’। তরুণ, নবীন আমি কলেজের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করি। বগুড়া শহরের সাহিত্য আড্ডাগুলোয় যাই। পেছনের সারিতে বসে থাকি। গোগ্রাসে গিলি অন্যদের কথা। এখনো যেমন, তখনো তেমনি কোথাও পাত্তা না থাকলেও ভালোবাসার ঘাটতি হয়নি কখনো। কেউ না কেউ, কারও না কারও ভালোবাসায়-স্নেহে প্রতিনিয়ত আমি সিক্ত হয়েছি। লেখা শুরুর সেই প্রাথমিক পর্যায়ে, একদিন সন্ধ্যায় ইসলাম রফিক বললেন, ‘কয়েকটা কবিতা দিয়ো তো’। কী করবেন? জানতে চাইলে উত্তরে জানালেন, ‘ক্রম’ বেরুবে, ওয়ালি কিরণকে দেব। পরের সপ্তাহে গাইবান্ধা যাওয়ার সময়ে ইসলাম রফিক আমার চার-পাঁচটা লেখা নিয়ে গেলেন। তখন গাইবান্ধা থেকে বৃহস্পতিবার করে বগুড়া আসতেন রফিক ভাই। শনিবার সকালে আবার চলে যেতেন। মাঝে মাঝে অবশ্য অন্যান্য দিনেও হুট করে চলে আসতেন। লেখা নিয়ে যাওয়ার পরের সপ্তাহে, এসে আমাকে বললেন, গাইবান্ধায় আমাদের আড্ডায় সবাই মিলে তোমার লেখা পড়েছি, কিরণ ভাই পছন্দ করেছে তোমার লেখা। মনে হয় ‘ক্রম’-এ যাবে। তারপর অপেক্ষা, যথাসময়ে একদিন বেরুলো ‘ক্রম’। রফিক ভাই হাতে করে নিয়ে এলেন, ঝকঝকে কাগজ, হলদে রঙের মলাট। পাতা উল্টে দেখি, আমার চারটে লেখা, দুই পাতা জুড়ে। বগুড়ার বাইরে সেই আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হওয়া। পত্রিকার সঙ্গে কিরণ ভাইয়ের একটি চিঠিও ছিল। চিঠির উত্তরের সূত্র ধরে আমাদের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। আর এই যোগাযোগের সেতু হয়ে উঠলেন রফিক ভাই।
কিরণ ভাই বগুড়া এলেন, সামনাসামনি পরিচয় হলো। অনেক বার বলার পরও, আমাকে কখনোই ‘তুমি’ সম্বোধন করেননি। নাম ধরে ডাকতেন, কিন্তু সম্বোধন ছিল আপনি। প্রথম দেখায় আপন হয়ে উঠলাম তার। সে দেখাতেই প্রস্তাব করলেন, চলেন, সবাই মিলে উত্তরবঙ্গ ঘুরে দেখি। রফিক ভাই, জয়ন্ত দেব উৎসাহের সঙ্গে প্রস্তাবে সায় দিলেন। বগুড়া থেকে আমি আর জয়ন্ত দেব। গাইবান্ধা থেকে ওয়ালি কিরন, ইসলাম রফিক, চিনু কবির, মামুন মিজান (অকাল প্রয়াত কবি), শামীম মাহবুব, আব্দুল কাদের।
উৎস ভূমির সন্ধানে আমাদের ভ্রমণ শুরু হলো। কয়েক মাস পরপরই আমরা বেরিয়ে পড়তাম নানাদিকে। দেখা হলো দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির, রামসাগর, রাজবাড়ী, দেখা হলো পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, দেখা হলো জয়পুরহাট জেলা, পুরো নওগাঁ জেলা ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। এই ঘুরে দেখার মাঝেই গাঢ় হতে-হতে সম্পর্ক কোথায় যেন, শূন্যতাও তৈরি হতে থাকল। চিনু কবির চলে গেলেন রংপুর, গাইবান্ধা থেকে ওয়ালী কিরণ বদলি হয়ে গেলেন, ইসলাম রফিক চলে এলেন বগুড়ায়, শামীম মাহবুব ঢাকায়। ধীরে ধীরে ভেঙে গলে আমাদের ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’। কিন্তু যে সোনালি বিকেলগুলো আমরা কাটিয়েছি, তার স্মৃতি অমলিন।
কবিতার মানুষ ওয়ালি কিরণ, অভিমানী কিছুটা জেদিও। অবসর জীবনে ফিরে আসেন রাজশাহী। কিন্তু আমরা সঙ্গে সেই বিচ্ছিন্নতা, বহুদিন ব্যবহারের অভাবে যে সেতুতে ঘাস জমে উঠেছিল, তাকে আর সচল করা সম্ভব হয়নি। চিঠির যুগ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করি মুঠোফোনের যুগে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর ফিরে আসেনি। ২০১৪ সালে বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার গ্রহণ করতে এসেও কিরণ ভাই, আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়েছেন। টাঙ্গাইলে দেখা হলেও, সেদিনগুলো স্মরণ করেছেন। ‘গুরু’ ছিল, তার প্রিয় সম্বোধন। অনেককেই তিনি গুরু বলতেন, তাকেও অনেকে ওই সম্বোধনে অভিহিত করতেন। সব সম্বোধনের ঊর্ধ্বে উঠে কিরণ ভাই, আজ শরীরী অবস্থানে অতীত হয়ে গেলেন। হয়ে রইলেন শুধু স্মৃতি। উৎস ভূমির সন্ধানে আমাদের সকল ভ্রমণকে স্বীকার করে নিয়েই উৎস ভূমির কবি, ফিরে গেলেন উৎসের কাছে। স্মৃতি হাতড়াতে ভালো লাগে না, কষ্ট বাড়ে। প্রিয়জন চলে গেলে কষ্টের সরোবরে ভেসে তবু আমাদের বারে বারে স্মৃতি হাতড়াতে হয়। কিরণ ভাই, প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে ভালো রাখুন।