তুষার গায়েন যে একজন কবি, তা এই সময়ে কবিতার সব পাঠকই সম্যক অবগত। তিনি তার কাব্যসৃষ্টিতে একজন ধ্যানী ও সুস্থির চিন্তার অধিকারী। আমার সমবয়সী ও সমসাময়িক হওয়ায় তার সৃজন-কর্ম আমার নিয়মিত নজরে এসেছে। তার প্রখর মেধার ছাপ আমাকে তার কবিতা পড়তে বাধ্য করেছে। সম্ভবত প্রথম ‘একবিংশ’তে তার কবিতা আমার নজর কেড়েছিল। ‘একবিংশ’ সম্পাদক কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন অনেক তরুণকে তার কাগজে লিখে নতুন কবিতা সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সবসময়। কিন্তু কেন জানি না, এই কবি বা লেখকরা ‘একবিংশ’র সঙ্গে নিজেদের দীর্ঘ সম্পর্কে রাখেননি। তাই কিছুদিন পর পর নতুন তরুণ কবির দল ‘একবিংশ’র পৃষ্ঠা ভরাতেন। এর ফলে, লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে ‘একবিংশ’র লেখকদের অধিকাংশই এই কাগজের সঙ্গে থিতু হননি।
তবে, কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন পত্রিকা প্ৰকাশের শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘একবিংশ’ হবে অপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু টগবগে সৃষ্টিশীল তরুণ কবিদের পাটাতন। তাই হয়তো সবসময় নতুন কবিদের তিনি সন্ধান করেছেন এবং তাদের আত্মপ্রকাশের জায়গা করে দিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, দাউদ আল হাফিজ, কামরুল হাসান, রণক মুহম্মদ রফিক, তুষার গায়েন, খলিল মজিদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়মিত লিখেছেন।
ফলে তুষার গায়েনের কবিতা আমি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে পড়তাম বটে, কিন্তু একসঙ্গে তার কাব্য অনুধাবনের সুযোগ কমই ছিল।
কোনো নির্দিষ্ট ম্যানিফেস্টো না থাকলেও ‘একবিংশ’ সম্পাদনায় তার স্পষ্ট চিন্তাদর্শন ছিল হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তা। বাঙালি সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ করে স্বদেশ ও ঐতিহ্যের নিবিড় বন্ধনে, উত্তর ঔপনিবেশিক চিন্তার স্বচ্ছতায় কবিতায় নোঙর করা। তার পত্রিকায় নব্বই দশকের শুরু থেকে নিয়মিতভাবে উত্তর আধুনিক তথা অধুনান্তিক দেশি ও বিদেশি তাত্ত্বিকদের প্রবন্ধ, আলোচনা-সমালোচনা এবং ভিন্নভাষী কবিদের কবিতার অনুবাদও নিয়মিত ছাপা হতো।তুষার গায়েন সম্ভবত ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ‘একবিংশ’-র প্রায় সব সংখ্যায় কবিতার পাশাপাশি কবিতা বিষয়ক গদ্য, আলোচনা-সমালোচনা নিয়মিত লিখেছেন।
২০০৫ সালে তিনি কানাডায় চলে যাওয়ার পর ২/৩ বছর নিজস্ব পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সাময়িক বিচ্ছদের পর ‘একবিংশ’-র ২৫ বছর পূর্তি সংখ্যায় আবারও লিখেছেন। তিনি জীবনবাদী অধুনান্তিক ধারায় অবস্থান করেছেন সবসময়। ‘একবিংশ’ পত্রিকার সম্পাদক কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মৃত্যু হয় ২০১৩ সালে। তার মৃত্যুর পর নতুন কলেবরে ‘একবিংশ’ বের হতে শুরু করে বটে, তবে তার সঙ্গে তুষারের সংযোগ মনে হয় তেমন গড়ে ওঠেনি।
দুই.
বিশ শতকের শেষের দিকে যারা বাংলায় দার্শনিক চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে কবিতার কথা ও ফর্মকে নতুন বাঁকে নতুন পথে এগিয়ে নেওয়ার যে প্রয়াস শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে তুষার গায়েন অবশ্যই বিশেষ একটা অবস্থান সংরক্ষণ করেন। কিন্তু ওই সময়ে লিটল ম্যাগাজিন বা সাহিত্যের কাগজে লেখা পড়ে একে-অন্যকে চেনা হতো বটে, যোগাযোগ গড়ে ওঠা বেশ কঠিন ছিল, অন্তত সেকালে আমার কিছুটা অন্তর্মুখী ধরনের জীবনযাপনও আমাকে হয়তো এমনটি ভাবতে বাধ্য করেছে। সেকালে পুস্তক প্রকাশ করাটাও কঠিন ছিল—কবিরাও বেশ সময় নিয়েই পুস্তক প্রকাশ করতো, ফলে তুষার গায়েনের কবিতা আমি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে পড়তাম বটে, কিন্তু একসঙ্গে তার কাব্য অনুধাবনের সুযোগ কমই ছিল।
ওডেসা ছিল এমনই একটি শহর, যেকোনো দিক দিয়ে হেঁটে গেলে সমুদ্রে গিয়ে শেষ হয় সেই পদযাত্রা। আর সবার হোক বা না হোক, কবির চোখের সামনে ভেসে উঠবে আদিগন্ত নীল সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশি আর বালিময় সৈকত।
তবু, এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, তুষার গায়েন একটি সম্ভাবনা নিয়ে ক্রমশ সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তারপরে তো ভোলগা ও গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেলো। আমিও পেশাগত ব্যস্ততায় বেশ কিছুদিন বুঁদ হয়ে দূরে ছিলাম সাহিত্যের সৃজনজগৎ ও ইত্যাকার সংযোগ থেকে। আমরা যখন ‘লিরিক’ লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে একটি নতুন চিন্তা দর্শনচর্চার মধ্য দিয়ে কবিতায় নতুন মাত্রা সংযোজনের প্রচেষ্টায় লিপ্ত, সেই একই সময়ে সমান্তরালভাবে তুষার গায়েনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং চর্চা করে চলেছেন নতুন কাব্যচিন্তা ও কাব্যদর্শনের।
সম্প্রতি সেই নিরন্তর নিরলস খোঁজের ফল এক গভীর অভিসন্দর্ভ আমরা পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হতে দেখি ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ শিরোনামে। তুষার গায়েন খুব সচেতন এবং ভীষণ অভিমানী একজন কবি। তার অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতা, বইয়ের ছত্রে-ছত্রে তার সে অনুধ্যান বিদ্যমান। আজ আমরা কেবল তার একটি অসাধারণ কবিতার দিকে দৃকপাত করবো।
তিন.
আমাদের শৈশব-কৈশোরে চিরায়ত রুশ সাহিত্য পাঠ করার একটা ব্যাপার ছিল। কবি তুষার গায়েনও তার শৈশবে সেকালে সবাই যেমন পড়তো, তেমনি চিরায়ত রুশ সাহিত্য পাঠ করার অভ্যাসে আলেক্সান্দার বেলায়েভের ‘উভচর মানুষ’ নামের এই অসাধারণ সায়েন্স ফিকশনটি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে তুষার গায়েন সরকারি মেধাবৃত্তি অর্জন করে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যান, কৃষ্ণ সমুদ্রের তীরে বন্দর নগরী ওডেসায় শুরু করেন তার স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা। ওডেসা ছিল এমনই একটি শহর, যেকোনো দিক দিয়ে হেঁটে গেলে সমুদ্রে গিয়ে শেষ হয় সেই পদযাত্রা। আর সবার হোক বা না হোক, কবির চোখের সামনে ভেসে উঠবে আদিগন্ত নীল সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশি আর বালিময় সৈকত। কবির মনের মধ্যে তখন খেলা করে উঠতে বাধ্য শৈশবস্মৃতির সেই ‘উভচর মানুষ—ইকথিয়ান্ডার’।
কী আছে সেখানে, মেরুদেশের অন্তিম সূর্য
প্রতিরোজ অস্ত যায় বিকালের জলে
যেন সমুদ্রের নাভি থেকে রূপান্তরিত মাছ
অকস্মাৎ লুপ্তবোধে শূন্যে উড়ে যায়বালতাজার, ডেকো না তুমি, তোমার সন্তান গেছে
ফেনাময় শঙ্খ-উচ্ছ্বাসে, নিরবধি মাছের সংসার
কী তিমি, কী অক্টোপাস, আড়াআড়ি সূর্যালোক
জাহাজের জেটি থেকে শব্দ ক্ষীয়মাণ…ইকথিয়ান্ডার,
কতটা মানুষ আর কতটা মৎস্য হলে
চেতনায় পাওয়া যায় এই পৃথিবীকে
জলে-স্থলে থরথর অভিন্ন আবাস!
(তুষার গায়েন: ইকথিয়ান্ডার, নীলভবহ্রদ)
কবিতাটি পাঠ করে আমি চমকে উঠেছিলাম। আরে! আমার শৈশব যেন হঠাৎ ঝলকে ওঠে স্মৃতির ভেতর! নিশ্চয় সোভিয়েত ইউনিয়নে যাপনকালে কবি যখনই সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলেন, অনুভবে শৈশবের পড়া সেই বালতাজার, ইকথিয়ান্ডার, ডাক্তার সালভাতর যেন জীবন্ত হয়ে কবির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। পড়াশোনা শেষে যখন কবিতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তন করলেন তখন, অর্থাৎ আজ থেকে সেই ২৮ বছর আগে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তুষার কল্পনায় ফিরে যান সেই কৃষ্ণ সাগরের তীরে, সেই ওডেসা শহরের পদযাত্রায়। আর এদিকে জন্ম নেয় একটি নতুন কবিতা—‘ইকথিয়ান্ডার’। কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীলভবহ্রদ’-এ।
ইকথিয়ান্ডারের মতো যারা আজ জলে-স্থলে বসবাস করতে বাধ্য হই, যেমন তাল মিলিয়ে চলছি নিয়ত অসুস্থ সমাজের সঙ্গে, আমাদেরও চেতনায় কি কিছু বোধ জন্ম লয়?
প্রসঙ্গত বলতে হয়, সুয়ারেক এম্ফিবিয়া নামে একটি বিজ্ঞানকল্প উপন্যাস লিখেছিলেন রুশ ঔপন্যাসিক আলেকজান্দর বেলায়েভ সেই ১৯২৭ সালে, যা ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটি পরবর্তী সময়ে বাংলায় ননী ভৌমিকের অনুবাদে ‘উভচর মানুষ’ নামে বহুল পঠিত হয়েছিল। এই কাহিনিতে পিতা বালতাজার তার শিশু সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে ডা. সালভাতরের কাছে নিয়ে যান। সালভাতর অঙ্গ সংযোজনে বিশেষজ্ঞ একজন খ্যাতিমান শল্য চিকিৎসক ছিলেন। সালভাতর দেখলেন, এই বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে তাকে একটি বিশেষ অঙ্গ সংযোজন বা সংস্থাপন করতে হবে। অসুস্থ শিশুকে বাঁচাতে তখন চিকিৎসক সালভাতর বাধ্য হন তার অঙ্গে হাঙ্গরের ফুলকা সংযোজন করে দিতে। এর পরিণতি হলো, সেই থেকে শিশুটিকে অনেকটা সময় জলের মধ্যে কাটাতে হয়, আবার কিছুক্ষণ ডাঙায়ও থাকতে হয়, অনেকটা ব্যাঙ বা এম্ফিবিয়া’র মতো। এই ‘উভচর মানুষ’ শিশুটির নাম ডা. সালভাতর রেখেছিলেন ইকথিয়ান্ডার। বালতাজারকে তিনি জানিয়েছিলেন, তার ছেলে বেঁচে নেই। পরে অবশ্য বালতাজার একদিন সে সন্তানকে ‘উভচর মানুষ’ হিসেবে আবিষ্কার করেছিল। এই যে ইকথিয়ান্ডার—সে এখন মানুষ ও মৎস্যকে একই সময়ে অবলোকন করতে পারছে।
কবিতার গভীর অন্তর্লোকে সেই ফিকশনের চরিত্রগুলোর বর্ণনা যে নতুন ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়, তাতে সত্যিই বিস্ময় মানি! কখনো কখনো এই কবিতা পাঠের পরে মনে হয় আমিই সেই ইকথিয়ান্ডার। আমি জল ও ডাঙার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি, শ্বাস লই বটে—তবে, সেই জল-স্থলের নানা অসামঞ্জস্যের ভেতর ধুঁকে ধুঁকে টেনে নিচ্ছি প্রতিটি প্রশ্বাস। কখনো সাগর ঊর্মির ফেনায় ভাসতে হয়, কখনো ডুবে ডুবে দেখতে হয় হাঙর তিমি অক্টোপাসের নানা কিসিমের জীবন-সংসার। আজ আমিও কি জানি না কোনখানে কতটুকু বায়ু, কোথায় কতটা জলে তেলে-জলে একাকার হয়! কবির চেতনা যেন সেই ইকথিয়ান্ডারের মতো দেখে বুঝে নেয়, অনুধাবনে মগ্ন হয়, কিন্তু অসহায় তড়পানি ছাড়া কবি আর কীই-বা করতে পারে?
তাই কবি তুষার গায়েন বালতাজারকে বলছেন—
বালতাজার, ডেকো না তুমি, তোমার সন্তান গেছে
ফেনাময় শঙ্খ-উচ্ছাসে, নিরবধি মাছের সংসার
কী তিমি, কী অক্টোপাস, আড়াআড়ি সূর্যালোক
জাহাজের জেটি থেকে শব্দ ক্ষীয়মাণ…
আমরা তারপরেই পাই এই কবিতার মোচড় দেওয়া সেই দুর্দান্ত চরণ—
…ইকথিয়ান্ডার,
কতটা মানুষ আর কতটা মৎস্য হলে
চেতনায় পাওয়া যায় এই পৃথিবীকে
জলে-স্থলে থরথর অভিন্ন আবাস!
আমাদের ইকথিয়ান্ডারের মতো যারা আজ জলে-স্থলে বসবাস করতে বাধ্য হই, যেমন তাল মিলিয়ে চলছি নিয়ত অসুস্থ সমাজের সঙ্গে, আমাদেরও চেতনায় কি কিছু বোধ জন্ম লয়?