পিপুল পাতা তুলতে এসেছে নিশান। সকাল থেকে গাঙ্গে আজ নলা মাছ গাবিয়েছে। ঘরের কাজ, মাঠের কাজ ফেলে, কমিয়ে যে যতোটা পেরেছে মাছ ধরেছে।
নিশান এক কোচরের বেশী ধরতে পারেনি। বাবা গেছে ধলাখালীর হাটে। নইলে চান্দারী ভরে যেতো। তে-কোন জাল আর কোচ দিয়ে বাবা এতো অতো মাছ ধরতে পারে। মা বাসন ভর্তি করে ভাজে। গুনা তারে গেঁথে সুটকি দেয়।
আজ শুধু চড়চড়ি। পিপুল পাতা দিয়ে। ঝাল ঝাল করে। বাবার খুব পছন্দ।
হাটবার বলে অন্য ভিটের চাচীদের সংগে সকাল সকাল গাংগ থেকে গোশল করে এসেছে মা। রোদে একটু রং ধরলো কি নদীতে ঢল নামলো ভিন গায়ের নৌকার ধলাখালী হাট বারে এমনি হয়। বেজায় বড়ো হাট। সাত গ্রামের লোক ছোটে সকাল থেকে। যে যে দিক থেকেই আসুক যেতে আসতে ময়ুর মুখীর মোড় পেরুতেই হবে।
মা মাছ কুটতে বসেই নিশানকে বলল পিপুল পাতার কথা। রতনদের ছাই গাদার পাশে লতানো জংগল। কালচে সবুজ, পান পাতা গড়নের পাতা তুলতে তুলতে নিশান তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। ইস সূর্য যেন, মাথার ওপর থেকে গড়াবেন আজ। সারা দিনের বেচা কেনা সেরে বাবার ফিরতে ফিরতে সন্ধে। কখন যে বেলা পড়বে?
এবারে আখের ফলন খুব ভালো হয়েছে। কোষা বোঝাই করে আখ নিয়ে গেছে বাবা। বলে গেছে, সামনে শীত, ছিট কাপড়ের রংগিন সার্ট নিয়ে আসবে ফেরার সময়। সেই সার্ট পরে এবার মাঘ মাসে সে যাবে নানীর বাড়ী ভেজানো রসের পিঠা খেতে।
কথাটা মাকে বলতে মা মিষ্টি হেসেছে। রোদ উঠেছে নারকেল গাছের মাথায়। দাওয়ায় একটি দিক এরই মধ্যে ভরে গেছে ধোঁয়া ধোঁয়া আঁধারে। পা ছড়িয়ে বসে মা পলতে পাকাচ্ছে বাতির জন্য। ঘরের পেছনে বাতাবী লেবুর ঝোপের তলায় দাদার কবর। মগরেবের আজানের আগে আগে মা দুটো প্রদীপ জ্বালে। একটা থাকে ঘরে। আর একটা দাদার ওখানে।
তার আগে নিশানকে আর একটি কাজ করতে হয়। উত্তর ভিটের চাচীর দো-আখা থেকে পাট খড়িতে করে আগুন আনতে হয়। সে সময় চাচীও দু একটি কাজ দেয়। যেমন ছোটো খুকী বড়ো বিরক্ত করছে, ওকে একটু নিয়ে যা। কিংবা দুটো পেয়াজ দিয়ে যা তোর মার কাছ থেকে।
শেষ বেলায় খেয়ে রাতে খাবার গরজ সাধারণত থাকে না। এশার নামাজের পর পরই নীরব হয়ে আসে পাড়া। হাটের দিন একটু অন্য রকম। বাবা চাচারা না ফেরা অব্দি নিশানের বয়সী ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছুটোছুটি করে। মা চাচীরা গোল হয়ে বসে। পুথি পড়া শোনে চাচী-চাচার কাছে। বাচ্চারা ঘুমায়। ছাড়াবাড়ীর জংলা ভিটে থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক।
এরই কোনো সময় ঘাটে কোষা লাগার শব্দ শোনা যায়। মা লণ্ঠন হাতে পথ দেখাতে যায়। পিছু পিছু আসে নিশানরা। হাটুরে বাবা চাচাদের পকেটে থাকে ঢাকা শহরের লবেনচুশ। সুবাসী বিস্কুট বা পাতলা কাগজে পেঁচানো, চাক চাক করে কাটা পাউরুটি।
আজ সন্ধের পর সময় যেনো থেমে রইলো। নবী দাদা তারা দেখে রাতের প্রহর বলতে পারেন। ঝড় তুফানের দিন বাতাস শুকে বলতে পারেন মওসুমি হাল। উঠোনে হাটাহাটি করছিলেন তিনি। এতো দেরি তো হওয়ার কথা নয় হাটুরেদের।
নালার এক বাঁশের সাকো পার হয়ে এ সময় এলো জমির চাচা। বেচা কেনার কিছু ছিলোনা বলে হাটে যায়নি। নিশানকে সামনে পেয়ে বলল, কিরে তর বাজানও ফিরে নাই। নিশান বললো, না। আইজ হাটে কী হইচে চাচা।
জমির চাচা বললো, কিছু বুঝবার পারতাছি না।
তিন ভিটের চাচীরা, মা, নবী দাদা ঘিরে দাড়ালো জমির চাচাকে। সন্ধে থেকে জমির চাচা নদীর ধারে। একটি নৌকাও ফিরতে না দেখে অবাক হয়েছিলো। গত কিছু দিন থেকে তো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিলো নানা রকম খারাপ খবর। মুক্তিযুদ্ধের হাট বাজারে গণ্ডোগোলের। মানুষ মারার।
ময়ূর মুখীর বাঁক ঘুরে ফিরতি নৌকো যাও কিছু গেছে, সেগুলো এতো জোরে চলে গেছে, মনে হয়েছে পেছনে বাঘ ভালুক তাড়া করছে। একজন হাটুরে শুধু পাড় ঘেঁষে যাবার সময় চেঁচিয়ে বলে গেছিলো, ভাইরা সাবধান। বাতাস বড়ো গরম। ধলাখালীর হাটে দুষমুনগো জাহাজ লাগছে।
মাইনষের খুনে ভাইসা গেছে জামিন। নওগুলা ডুবছে উথাল পাথাল পদ্মার ঢেউয়ে। হেরা ডুবাইছে ইচ্ছা কইরা। আপনেরা জান মালনিয়া সাবধান হনগো মিয়া ভাইওরা।
জমির চাচারা খবরটা পাড়ায় ঢুকতে দেয়নি। গাংগের পাড়ে থেকে আরও ফিরতি নৌকোর অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা করেছে আরও খবরের জন্য।
রাজধানী ঢাকা থেকে লঞ্চের লোকের মুখে মুখে কতো রকম খবরই তো আসছিলো। খবরগুলো মিথ্যে নয় গ্রামের মানুষ একবার তার প্রমাণ পেয়েছিলো। সেই চৈত্র মাসে পিলপিল করে শহরের লোক ফিরছিলো গ্রামে। তাদের সংগে জিনিষপত্র ছিল না। ছিল শুধু ভয়।
শহুরে মানুষের পায়ে কাদা, এলোমেলো পোশাক, চোখ ভরা ক্লান্তি, এ যেনো ভাবাই যায় না। নিশান বরাবরই দেখেছে তারা যখনই গ্রামে আসে, কাপড় চোপর থাকে ঝকঝকে। ঘোরা ফেরায় আমীর আমীর ভাব। সেই তাদের একি চেহারা।কতো জনম যেনো খায়নি। ঘুমোয়নি।
নিশানদের মতো কিশোররাই তখন ওদের দেখাশোনা করেছে। শুনেছে ভয়ংকর, অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। দেশে যুদ্ধ লেগেছে। অবাঙালিরা এক রাতে কামান দেগে, বন্দুক ছুড়ে ঢাকা শহরকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে ওরা ছিল বাঙালিদের পড়শী সেজে। চেষ্টা করেছিল দেশি মানুষের ভাষা, সাহস, সংস্কৃতি সব একসঙ্গে কেড়ে নিতে। না পেরে ধ্বংস করে দিতে চাইছে পুরো জাতটাকে।
রাজধানী থেকে, জেলা শহর থেকে সব লোক পালাচ্ছে গ্রামের দিকে। ওরা নাকি নদীকে খুব ভয় করে। পাগড়ির প্যাঁচের মতো নদী নালা পেরিয়ে গাও গঞ্জে কখনো আসবে না।
নিশান ভেবেছিলো হবেও বা। বুড়িগঙ্গা সে কখনো দেখেনি। বাবার সঙ্গে আরুল বিলের ওপারের হাটে গিয়ে ইছামতী ধলেশ্বরী দেখেছে। জমির চাচার সঙ্গে ইলশে মাছ ধরতে গিয়ে দেখেছে পদ্মা। বর্ষায় ওরা নাকি ভয়ংকর রূপ ধরে। এপারে ওপারে নজর চলে না। শুধু পানি আর পানি। চার চারটা বড়ো নদীর পরও আছে খাল, বিল, নালা। উড়ে না এলে শয়তানেরও সাধ্য নেই চট করে গ্রামে চলে আসা।
শহর থেকে পালানো সেই মানুষেরা থাকেনি খুব বেশী দিন। ফিরে গেছিলো কিংবা সরে গেছিলো আর কোথাও।
ময়ূরমুখী গ্রামের লোক ভেবেছিল তারা নিরাপদ। যুদ্ধের কোনো ধাক্কা তাদের জন্য আসবে না। যুদ্ধের তারা কি জানে। বাপ দাদার আমল থেকে চাষ আবাদ নিয়ে আছে। লড়াই করার জন্য মানুষের মধ্যেই আলাদা একটি শ্রেণী আছে। দেশের জন্য, দশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য তারা যুদ্ধ করে, প্রাণ দেয়, জয়ী হয়।
ধারণা ভাঙলো শহরের মানুষের ফিরে যাওয়ার মাস কয়েকের মধ্যে। গ্রামের উঠতি বয়সের যে ছেলেরা হাইস্কুলে পড়তো, বাজারে দোকানদারি করতো, কিংবা কাজ করতো ক্ষেত খামারে, রাতারাতি তারা যেন কোথায় চলে গেলো। নবী দাদার পুঁথির সেই রূপনগরীর মতো ছেলেরা সব বনে চলে গেছে চারমুখো দেওয়ের জন্য। ফিরে যখন এলো তখন তাদের ঘাড়ে তীর ধনুক। মুখে শপথ। দেওকে তারা বধ করবে।
ময়ূরমুখী থেকে যারা গেলো তারা যদিও ফিরলো না, কিন্তু রাতের ছায়ায় আপন শরীর মিশিয়ে গ্রামে এলো আর একদল ছেলে। বনের গভীরে তারা শিবির তৈরী করেছে।
সবুজ সতেজ লতাগুলোয় কতো যে ফল ধরে। কি সোয়াদ সেগুলো খেতে।
মাঝেমাঝে তারা আসতো। গায়ের মাতব্বর মেম্বরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতো। চলে যেতো। একদিন তাদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। খালি গা। লুংগি পরা। কোমরে বাধা গামছা। নিশান বলেছিলো, আমারে লইবেন আপনেগো লগে।
সে হেসে বলেছিলো, তুমি কি করো খোকা।
নিশান বলেছিলো, আগে ইস্কুলে পড়তাম। অখন বাজানের লগে আউখ ক্ষাতে কাম করি।
সে বলেছিলো, তাই করো।
নিশান অবাক গলায় প্রশ্ন করেছিলো, ক্যান?
সে জবাব দিয়েছিলো, সবাই একসঙ্গে যুদ্ধে এলে চলবে কী করে। আমরা ক্যাম্পে আটা রুটি আর আখের গুড় খাই। তুমি আমাদের জন্য গুড় তৈরী করো।
গাজী বাড়ির তালাগ ধরে, বাঁশ ঝাড়ের তলা দিয়ে চলে গেছিলো সে। কথাটা পছন্দ হয়নি নিশানের। সে ক্লাশ ফাইভে পড়ে। মুক্তি যুদ্ধে তার মতো কতো ছেলেই নাকি গেছে। সরাসরি বাবাকেই এক বিকেলে সে বললো মনের কথা। শুনে বাবা প্রথম দিকে জবাব দেয়নি। আবার বলতে একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে জবাব দিয়েছিলো, যুদ্ধে যাইবার চাও যাইবা। দরকার মনে করলে বাপ ব্যাটায় একলগে যামু। অখন একটু তামুক সাজো দেখিন বাজান।
সেই বাবা জান দিলো ধলাখালীর হাটে। লাশ এলো তিন দিন পর। শরীর ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। শুধু বাবা নয়, দক্ষিণ-ভিটির মামু, পূর্ব পাড়ার নুরুর ফুপা, দুনির বাবা, সবার এক অবস্থা। একসঙ্গে অনেক লোক ছেড়ে গেলো গ্রামের মায়া।
লাশ এসেছিলো শেষ বেলায়। ঘরে ঘরে কান্না। উঠোনে উঠোনে কাফন দাফনের ব্যস্ততা। গ্রামের সব চেয়ে বুড়ো মানুষটিও একসঙ্গে এতো লোকের মাতন দেখেনি। বোবা গাছপালার ডাল চুইয়ে চুইয়েও যেনো ঝরছিলো চোখের পানি।
পুরো গ্রাম বলতে গেলে জেগে রইলো সারা রাত। সকালে পিলে চমকানো এক খবর। কান্নাটান্না বন্ধ করো। এসব এখন বিলাপ। শিগগীর তৈরী হও অথবা পালাও। দুষমনদের সৈন্য ঘোরা ফেরা করছে আশপাশের গ্রামের কাছাকাছি।
গ্রামের সবাই যেনো কথা বলতে ভুলে গেলো। পালাবে কোথায়? ধলাখালীর হাট হয়েছে গোরস্তান। বিলের ওপারের গাঁ-গুলোতে গেলো রাতে দেখা গেছে আগুন আর ধোয়া। তবু দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গেলো কেউ কেউ। কেউ পিতল কাসার বাসন কোসন পুঁতে ফেললো মাটির তলায়। কেউ ধার দিতে লেগে গেলো দা, বটি, সাবল, সরকি।
নিশান তাকিয়ে আছে বেড়ার খাঁজে গোজা বাবার বড়ো গুলতিটার দিকে। বাবার সখ ছিল শীতের সময় পাখি শিকারে যাওয়া। মাটির গুলির ঝালা নিয়ে সে যেতো পিছু পিছু। মাথায় নতুন গামছা বেঁধে, কাছা মেরে লুংগি পরে বাবা বিলে নামতো। হাতের সই ছিলো দারুন। নিশানের কাঁধের ছালা ভরে যেতো বক, ঘুঘু, ডাহুক, বন পায়রায়। বাড়ী ফিরে সেগুলোর ছেড়া ছেলার কাজ বাবাই করতো। পরদিন সেসবের একটি বড়ো ভাগ নতুন মাটির হাড়িতে করে নিশান দিয়ে আসতো বুজীর বাড়ী। দুলাভাই শিকারের মাংস খেতে খুব ভালো বাসতেন।
নিশানের বুক থেকে উঠে আসে গরম নিঃশ্বাস। কি যে হলো দিনের হাল। দুলাভাইয়েরও কোন খবর নেই। ওদের গ্রাম সীমান্তঘেঁষে। ওরা নাকি ওপার চলে গেছে।
মা এলো কাসার বাটিতে করে মুড়ি নিয়ে। নিশান বললো, মাও আমি যুদ্ধে যামু। বাটি নামিয়ে দিয়ে মা চোখ মুছছিলো। কাল থেকে কেঁদে কেঁদে মার চোখ লাল। টকটকে চোখ নিয়ে মা শুধু তাকিয়ে রইলো। নিশান ডান হাতের মুঠিতে বুকে চাপড় মেরে, গলায় আর একটু জোর দিয়ে বললো, যুদ্ধে যামু। এই তুফান আলীর পোলা নিশান আলী যুদ্ধে যাইবো। বাপের পক্ষী শিকারের গুলাই দিয়া দুষমুন শিকার করবো।
মা দুপা সরে এসে ওকে বুকের কাছে নিয়ে বললো, তুই বাজান যুদ্ধে গেলে আমি বাচুম কারে লইয়া? একে একে হগগলেই তো ছাইড়া গেলো আমারে।
নিশান জবাব দিলো, আমি ছাইড়া যামু না। এই যুদ্ধে যাওন মাইনে মাঠে ময়দানে গিয়া লড়াই দেওন নারে মা। ঘর থনই যুদ্ধ করুম। খালি আমি না। তুমিও।
মা যেন নিশ্চিন্ত হলো। দাওয়া থেকে নেমেই আবার কেঁদে উঠলো নতুন করে। নিশান চমকালো, আবার কোন মুসিবত এলো? না কিছুনা। অবসর সময় বাবা দাওয়ার একদিকে ছোট কেবিন ঘর তৈরি করছিল। তার পড়ার সুবিধার জন্য। বাবার খুব আশা ছিলো সে লেখা পড়া জানা জ্ঞানী মানুষ হবে। গোলমালে ঘরের কাজ আর এগোয়নি। কত শেষ না করা কাজই না যাওয়ার আগে ফেলে যেতে হয় মানুষকে।
নিশানের মনে হলো গত চারদিনে সে যেনো অনেক বড়ো হয়ে গেছে। অনেক বেশি বুঝতে পারছে।
মুড়ির কিছু খেয়ে, বাকিটা মুরগীর খোয়াড়ের কাছে ফেলে দিয়ে সে এলো পঞ্চবটির জঙ্গলে। ক্যাম্প করা ভাইরা এবার দলে নিলো।
কাজ-শেখালো। কাজ দিলো। কালো কাসুন্দির ঝোপের আড়ালে থেকে খালের দিকে চোখ রাখতে হবে। ওখান থেকে বড়ো নদীর বাঁক দেখা যায়। দৃষ্টির সবটুকু আলো জ্বালিয়ে দিয়ে, সে পথ পাহাবা দেয় নিশান। ভুলে যায় বাবার কথা। চাচাদের কথা। মনকে জাগিয়ে রাখে একটা ধাতব রাক্ষসের জন্য। কবে সেটা খালে ঢুকবে।
বিকেল হলেই বাতাসে ভাসে বন তুলসীর সুবাস। খুব সামান্য সময়ের জন্য আনমনা হয়ে যায় সে। এমনি ছায়া ছায়া বিকেলে নদীর ধারে কপাটি খেলতো স্কুল থেকে ফিরে। একবার দম দেবার মুখে রতন বললো, ঐ নিশান তর বুজীর নাও যায়রে।
বুজীকে নিয়ে খালের পানিতে সত্যি যাচ্ছিলো এক মালাই নৌকো। দুলাভাই দাঁড়িয়ে বাইরে। বুজীর ঝকঝকে চোখ দেখা যাচ্ছিলো গলুই-এর কাছে, খাটো ঘোমটার ভেতর।
খেলা মাথায় উঠলো। পাড় ধরে নৌকোর সঙ্গে দৌড়াতে সুরু করলো সে। দুলাভাই চেঁচিয়ে বললো; নাও ভিড়ামু। উঠবা নায়ে।
ছুটতে ছুটতেই নিশান জবাব দিলো, না না। আপনেগো মায়ের আগে আমি বাড়ীতে পৌছা মাওরে খবর দিমু।
যে গাং বর্ষায় বুজীকে নিয়ে আসতো, শুকনোর সময় সেই যোগাতো রসালো ফল। নামে গাং আসলে শাখা নদী। ভূগোলের স্যার বলেছিলেন গোটা বিক্রমপুরের সবচেয়ে বড়ো নদী ছিলো ইছামতী। রাজা বাদশাহদের বড়ো বড়া নৌকোর বহর ভাসতো তার বুকে। সে নদী মরে গিয়ে জন্ম হয়েছে ধলেশ্বরীর। আর এই ক্ষীণ শরীর মধুমতীর। শীতে এ নদী একেবারে শুকিয়ে যায়। পুরা বালির ওপর কারা যেনো বুনে দিয়ে যায় বাংগি, তরমুজ। সবুজ সতেজ লতাগুলোয় কতো যে ফল ধরে। কি সোয়াদ সেগুলো খেতে।
বন্ধুর মতো, আপন জনের মতো সেই নদী আজ সে পাহারা দিচ্ছে। কখনো নিজেকে মনে হয় পুঁথির সেই শাহজাদার মতো। রাজ্যের শেষ সীমায় সে অপেক্ষা করে থাকতো রোজ মানুষ খেকো এক সমুদ্র দানবের জন্য। পানির রাক্ষসটাকে সে হত্যা করেছিলো। কেটে দিয়েছিলো লাল চোখ শয়তানের হাতীর খুঁড়ের মতো আটটি শুঁড়কে।
ঝিকঝিক, থিকথিক শব্দ বাতাসে। সজাগ হলো নিশান। রতন ছিলো পাকুড় গাছের মগডালে। চেঁচিয়ে বললো, ঐ আয়া পড়ছে। বাইসুত কি আলীসান জাহাজের। শিগগীর ক্যাম্পে খবর দে। আনু ভাইরে। গোবিন্দ দাদারে।
সন্ধের দিকে দোতলা লঞ্চ ঢুকে গেলো গাংগে। পাড়ের দিকে এলোনা। থমকে রইলো মাঝ নদীতে। খোল ভর্তি খাকী পোষাকের মানুষ। ছাদের উপর সাজানো হলো কামান। গ্রামের দিকে তাক করা। সবার মাঝে জ্বলছে একটা লাল আলো। পুঁথির সেই সমুদ্র দানবের চোখের মতো। এটা আরও সাংঘাতিক। ঘুরে ঘুরে আলো ফেলছে চারদিকে।
একটু বেলা করে গাঁয়ের ছেলেরা, ক্যাম্পের যুবকর ফিরে এলো। এলো না শুধু নিশান। গাংয়ের কোথাও সে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে থাক।
গোপন বৈঠকে ঠিক হলো রাতের অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া হবে এটাকে। সবার আগে একজনকে গ্রেনেড ছুড়ে অন্ধ করে দিতে হবে সার্চ লাইটের আগুনে চোখ। কে যাবে। নিশান এগিয়ে এলো।
কমান্ডার ভাই ঘাড় নেড়ে বললেন, আমিও তোর কথাই ভাবছিলাম। সব রকম সাঁতার তুই খুব ভাল জানিস। তুই আলোটা নষ্ট করে দিলেই, দুপার থেকে আমরা আক্রমণ চালাতে পারবো।
সন্ধে রাতে নিশান এলো ভাত খেতে। মা বললো, বাজান শরীরটা আইজ জুইত লাগতাছেনা। পাহারাদারী থন আইজ একটু জলদি ঘরে ফিরিস।
নিশান ঘাড় দুলিয়ে ছোট্ট জবাব দিলো, আইচ্ছা। রাত নিঝুম হলে, থমথমে হলে নিশান বেরুলো। রেকি করা জায়গা থেকে খুব সাবধানে নামলো খালের পানিতে। গ্রেনেড ধরা হাতটাকে মাথার ওপর দিকে রেখে লঞ্চের দিকে এগুলো আরও সাবধানে।
সার্চ লাইটটা যেনো ইবলিশের জ্যান্ত চোখ। ক্লান্তি নেই। ভুল নেই। ব্যর্থতা নেই। তা হোক। নিশান মনে মনে ভাবলো, দরকার হলে সারা রাত, সারা জীবন সে সুযোগের অপেক্ষা করবে। তবু ওটাকে শেষ করা চাই। নইলে পাশের গাঁয়ের মতো তাদের গ্রামটাও পুড়ে ছারখার হবে। দলেদলে মানুষ মরবে বেয়োনেটের খোচায়। শিশুদের শূন্যে ছুড়ে দিয়ে চলবে বন্দুকের কিরিচে গেঁথে ফেলার প্রতিযোগিতা। যেনো হাসি ঠাট্টার খেলা একটা। এমনি করে বাচ্চাদের জীবন নিয়ে খেলে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যগুলো। আর মেয়েদের নাকি জোর করে ধরে নিয়ে যায় জাহাজে।
নিশান মাথা ঝাকানি দিলো। তাদের গ্রামেও তেমনি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। হেলমেট পরা লোকগুলো জাহাজের ছাদে ঘোরাফেরা করছে। কমাণ্ডার আন্দাজ করছেন রাতে নামার প্ল্যান ওদের নেই। ভোর ভোরে ঘিরে ফেলবে গোটা গ্রাম। রাতের আঁধারে গ্রামবাসীরা যাতে পালাতে না পারে তার জন্য নদীর বাঁকে পাহারা দিয়ে আছে আরও পাঁচ ছটা লঞ্চ। হয়তো সেগুলোও যোগ দেবে সকালের তাণ্ডব কাণ্ড-কারখানায়। তার আগে এটার ব্যবস্থা করতে হবে। শয়তানের চোখের মতো, দানবের চোখের মতো দগদগে লাল আলোটার খতম তারাবী পড়াতে হবে। শূন্যে তোলা হাতের মুঠিতে গ্রেনেডের গোলা। অন্য হাতে সাবধানে সাঁতার কাটা।
শয়তানের জাহাজ দাঁড় করানো মাঝ নদীতে সার্চ লাইট খোয়ার বিরাম নেই। সেই সঙ্গে পিলে চমকানো ফাঁকা গুলির আওয়াজ। জাহান্নামের বাসিন্দাগুলোর চোখে কি নিশি রাতেও ঘুম থাকে না। না থাক। নিশানের চোখের উপর এখন কোনো সার্চ লাইট নাই। আছে বাবার আধখোলা লাল একটা চোখ, বাকী চোখটি উড়ে গেছিলো গোলার ঘায়ে। জমির চাচা খোলা চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়েছিলো। মুর্দার চোখ নাকি খোলা অবস্থায় কবরে যেতে নেই। কিন্তু নিশান স্পষ্ট দেখছে বাবা তাকিয়ে আছে। সাদা জমিনের ওপর ছোপ ছোপ রক্তের ফোটা। নানা ছোপ ছোপ নয়, জমাট বাধা রক্তের চাপ। টকটকে লাল।
মাঝরাতে সমস্ত গ্রাম কেঁপে উঠলো ভয়ঙ্কর বিকট আওয়াজে। দানোর ঘুরন্ত চোখ আচমকা নিভলো। কয়েক মুহূর্তে আকাশ মাটি নদী মিশে গেলো একদম অন্ধকারে। তারপর দশ দিক ভরে এলো গর্জন আর গর্জনে।
ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে জোনাকীর আলোর শব্দে জ্বললো আর এক ধরনের তেজি নীল আলো। ঝাঁকে ঝাঁকে অবিরাম। লঞ্চ ডুবলো। সকাল হলো। বড় নদীর বাঁকে অপেক্ষা করছিলো যে দুটো সাজোয়া লঞ্চ, রাতের গোলাগুলির শব্দে তারা আর সাহস পেলো না গ্রামে ঢোকার। ঘুরিয়ে নিলো গতিমুখ।
একটু বেলা করে গাঁয়ের ছেলেরা, ক্যাম্পের যুবকর ফিরে এলো। এলো না শুধু নিশান। গাংগের কোথাও সে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে থাক।