পরীস্থানে, মানে পরিরাজ্যে ধুম পড়ে গেলো। চারদিক সাজানো-গোছানো হচ্ছে। কারণ পরীদের রানি ঘোষণা দিয়েছে, দেশ-বিদেশের পরীদের নিয়ে মেলা বসবে।
দিন-তারিখ ঠিক হলো। কত নিয়ম, কত সতর্কতা চারিদিকে। কঠোর নজরদারির যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। দিনটি ছিল শুক্রবার। পরীরাজ্যের সেই কাঙ্খিত দিন। সারা দেশ থেকে সকাল থেকেই তাদের আসা শুরু হয়েছে। কতো রকমারি সাজে সেজেছে দূর দূরান্ত থেকে সব পরীরা আসছে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, গোলাপি পোশাক পরে যেন তারা ঝলমল করছে।
এদিকে একটা ঘটনা ঘটলো। সুদূর মিশর থেকে একটা পরি খুব দ্রুত শোঁ শোঁ শব্দ করে উড়ে যাচ্ছিল পরিস্থানের দিকে। সহসা তার মনে হলো যেন ডানার ভাঁজে কিছু একটা বাধলো। একটু খু্ঁজতেই বুঝতে পারলো ওটা একটা ঘুড়ির সুতো। ওর তখন অতো দেখার সময় নেই তাই একটানে ছিঁড়ে ফেললো। ঘুড়িটা পাক খেয়ে নিচে পড়ে গেলো। আসলে ওটা ছিল খোকনের ঘুড়ি। ছেঁড়া ঘুড়ি হাতে নিয়ে খোকন তো চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। খোলা মাঠের এককোণে খোকনকে এমন কাঁদতে দেখে হলদে পরীটা অবাক হলো। বললো, খোকন তুমি কাঁদছ কেন? সে বললো, তুমি আমার ঘুড়ি ছিঁড়ে দিলে কেন? হলদে পরীও তো জানতো না যে ওটা খোকনের। পরী মহা ফ্যাসাদে পড়লো। বললো, তুমি কেঁদো না। আমি তোমাকে পরিস্থান থেকে একটা সুন্দর ঘুড়ি এনে দেবো, কেঁদোনা।
খোকন নাছোড়বান্দা, বললো, আমাকে এক্ষুনি দাও। পরী বেচারা কী আর করবে, বললো, ঠিক আছে, আমার সাথে চলো। বলেই সে খোকনকে ডানার ওপরে তুলে নিয়ে উড়াল দিলো।
উড়ছে তো উড়ছেই। কত শত বন-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত-নদী-সাগর যে পেরিয়ে গেলো তার হিসাব নেই। প্রায় দুপুর হয় হয়, এমন সময় ওরা গিয়ে পৌঁছুলো। ওকে দেখেই পরী রানি মিষ্টি হেসে বললো, কী ব্যাপার হলদে পরী, তোমার এত দেরি হলো কেন? পরী তখন পথের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বললো। শুনে পরী রানি তো হেসেই অস্থির। তারপর খোকনকে নিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকে বললো, ওরে কে কোথায় আছিস, খোকন সোনাকে রাজকুমারের বেশে সাজিয়ে দে। ও আমাদের সম্মানিত মেহমান।
কয়েকজন প্রহরী দ্রুত ছুটে এসে চোখের পলকে তাকে রাজকীয় পোশাকে সাজিয়ে দিলো। কী ঝলমলে জরির পোশাক, খোকনের চোখে যেন ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। সে চুপচাপ দেখতে লাগলো সবকিছু।
এরপর রত্নখচিত একটা ময়ূর আসনে ওকে বসিয়ে দিয়ে পরী রানি ঘোষণা দিলো, আমাদের আজকের এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন খোকন সোনা। সবাই ওকে সম্মান জানাও। অমনি সব পরী কাছে এসে একে একে সবাই তাকে আদর সম্ভাষণ জানালো। খোকনের কাছে সবই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ওকে যে এত আদর সম্মান দেবে পরীরা, তা ও কখনোই ভাবতে পারেনি।
অনেক অনেক আয়োজন। তার মধ্যে একটা আছে ঘুড়ি ওড়ানোর পর্ব। একপাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রঙ-বেরঙের অসংখ্য ঘুড়ি। কী সুন্দর করে সেগুলো বানানো হয়েছে, তা শুধু অবাক হয়েই দেখছে খোকন।
যথারীতি গান-বাজনা নৃত্যসহ বেশ কিছু পর্ব শেষ হলে রানি বললো, পরীগণ, তোমরা সবাই এবার একটা করে ঘুড়ি হাতে নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেবে। যাদের ঘুড়ি ফিরে আসবে মাটিতে, আমাদের সামনে, তারা বিজয়ী হবে না বরং যার ঘুড়িটা আর ফিরে আসবে না, সেই হবে আজকের বিজয়ী। তবে একটা কথা, তোমরা ঘুড়িটা হাতে করে প্রস্তুত থাকবে, আমি রাজকুমার খোকনের হাতে এই বাঁশিটা দিচ্ছি। ওটা বাজানোর সাথে সাথেই তোমরা ঘুড়ি ওড়াবে।
খোকন চুপচাপ শুনলো সবার কথা। তারপর মাকে বললো, মা আমার এই সুন্দর পোশাকগুলো বাক্সে তুলে রাখো। যেন কোনোদিন নষ্ট না হয়। পরীরা যে মাটির মানুষকে এতটা সম্মান করে, এগুলো তারই প্রমাণ বহন করবে আমার জীবনে। আমি কখনো ভুলবো না মা।
যথারীতি রানি একটা বাঁশি দিয়ে, এক-দুই-তিন বলতেই খোকন বাঁশি বাজালো। পরীদের মনোরম সুন্দর ঘুড়িগুলি এঁকেবেঁকে নৃত্যের ভঙ্গিতে উড়ে চললো। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য!
আহা!খোকনের মনের আনন্দ কে আর দেখবে!
ওড়ানো শেষ। এবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই। পিনপতন নিস্তব্ধতা চলছে।
অকস্মাৎ! ধীরে ধীরে ঘুড়িগুলো নিচে নামতে শুরু করলো। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, কত আর গোণা যায়! একে একে নিরানব্বইটা ঘুড়ি উড়ে এসে মাটিতে থামলো। সবাই অপেক্ষা করছে আর একটা ঘুড়ির জন্য। কিন্তু নাহ। এলো না সেটা। আর ওই ঘুড়িটাই ছিল হলদে পরীর। নিয়মানুযায়ী হলদে পরীকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হলো। সব পরীই আনন্দিত মনে হলদে পরীকে স্বাগত জানালো। খোকনও ভীষণ খুশি। এমন খুশি সে জীবনে আর কোনোদিন হয়নি।
পরী রানি হলদে পরীর গলায় মুক্তোর মালা ও মাথায় বিজয় মুকুট পরিয়ে দিলো।
শেষ হলো সব। বিদায়ের পালা এবার। এমন সময় পরী রানি বললো, প্রহরীগণ, তোমরা সব ঘুড়ি সাজিয়ে আমাদের রাজকুমার খোকন সোনাকে দাও। এগুলোই তার জন্য আমাদের উপহার।
তারা ঘুড়িগুলো সুন্দর করে এনে খোকনের হাতে দিলো। কী আনন্দ, কী এক অনাবিল আনন্দ খোকনের মনটাকে ছুঁয়ে দিলো। পরী রানি বললো, খোকন সোনা, তোমাকে একটা ঘুড়িময় মুহূর্ত উপহার দিলাম। এটা তোমার শৈশব-কৈশোরের সবচেয়ে বড় উপহার। ভোলো না কোনোদিন।
খোকন সবিনয়ে বললো, আমি কখনো ভুলবো না পরী রানি জীবনের এই শ্রেষ্ঠ উপহারের কথা। আমি ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। রানি বললো, খোকন সোনা, তুমি একজন খাঁটি ও শুদ্ধ মানুষ হবে এই শুভকামনা করি।
হলদে পরীও বিদায়ের পর খোকনকে তার ডানায় তুলে নিয়ে উড়তে উড়তে এসে ঠিক সেখানে নামিয়ে দিলো, যেখান থেকে সে তাকে নিয়ে গিয়েছিল। সে চোখের আড়ালে গেলেই খোকন বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
এতগুলো রঙিন ঘুড়ি, গায়ে জরির পোশাক, এসব দেখে তো সবাই অবাক। মা বললো, কি রে, তুই এমন বেশে যে! খোকন সব ঘটনার বর্ণনা দিলো। ইতোমধ্যেই অনেকেই সেখানে এসেছে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। বন্ধুরাও জেনে গেলো ওর অপূর্ব, অবিশ্বাস্য ভ্রমণকাহিনি। ওর বন্ধু কাজল বললো, তুই বড্ড ভাগ্যবান রে!
ইফতি বললো, ইস্ আমাদের কপালে যদি এমন কিছু ঘটতো তবে ভীষণ খুশি হতাম।
খোকন চুপচাপ শুনলো সবার কথা। তারপর মাকে বললো, মা আমার এই সুন্দর পোশাকগুলো বাক্সে তুলে রাখো। যেন কোনোদিন নষ্ট না হয়। পরীরা যে মাটির মানুষকে এতটা সম্মান করে, এগুলো তারই প্রমাণ বহন করবে আমার জীবনে। আমি কখনো ভুলবো না মা।
মা খোকার ছোট্ট হৃদয়ের গভীর অনুভূতি বুঝতে পেরে ওগুলো সযত্নে সাজিয়ে রাখলো। খোকনের মনের ভেতর প্রশান্তির মহাসাগর বইছে। ঘুড়িগুলোকে স্পর্শ করে পরী রানির বলা কথাটা কয়েকবার উচ্চারণ করলো, ‘তোমাকে একটা ঘুড়িময় আকাশ দিলাম!’
ওর মনে হলো, যেন মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সে পুরো বিশ্বটাকে জয় করে ফিরেছে!