চরিত্র
পুরুষ: বয়স তেতাল্লিশ, চাকরিজীবী
নারী: বয়স ছত্রিশ, গৃহিণী
কন্যা: বয়স তেরো, স্কুলছাত্রী
বস: বয়স তেপ্পান্ন
সহকর্মী: বয়স একচল্লিশ
প্রথম অঙ্ক
এক॥
[রাত। লোডশেডিং। জানালায় দুজন নরনারী। জানালার বাইরে চৈত্রের সোনালি জ্যোৎস্না।]
পুরুষ
তোমাকে যে ভালোবাসি কথা নয় শেষ
কথার শুরুটা হল মাত্র
প্রেম কি পুরনো হয়? প্রেমের অনন্ত অনুভব
চিরকাল চিরঞ্জীব থাকে
পুরনো হয় না ক্ষুধাতৃষ্ণা
প্রতিবার নতুন প্রবল
নারী
প্রেম কি মহৎ নয় ক্ষুধাতৃষ্ণা থেকে
জৈবিক উপমা ছাড়া আর ভাষা নাই?
পুরুষ
নির্জীবের প্রেম হয় নাকি
শুনেছ কখনো?
জীবন রয়েছে যার জীব বলি তারে
জীবনের মাপে প্রেমের চাহিদা বলি
চোখের মাপেই দেখি আমি
আকাশের আয়তন
আকাশের মাঠজুড়ে
বিদ্রোহী মেঘের পোস্টার ছেঁড়ার শব্দ
তাকেই বিজুলি বলি
আতঙ্কের সমার্থক বলে গেছে কেউ
কারো কাছে পথরেখা নতুন নিয়ম
আমিও জীবন এক সমাজে বিনম্র
সুখে দুঃখে থাকি
নারী
কতকাল আমি দেখি না বাংলার রূপ
চলো না আগামীকাল ছুটির দিবস
কাটাই পল্লীর পরিবেশে
আমাদের উত্তর প্রজন্ম
নাগরিক বিরক্তিতে স্বদেশকে চেনে
মাটি আর মানুষের কথা
বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসে যদি
পুরুষ: [আবেগে ঘনিষ্ঠ হয়ে আরেকটু এগিয়ে আসে।]
সকালে সিদ্ধান্ত নেব। এখন রাত্রিটা আজকের
চৈত্রের জ্যোৎস্নায় শুধু আলোকিত হোক।
তাপ ওঠা চুলের গোড়ায় আঙুল চালাও তুমি
আমার মস্তিষ্ক থেকে ভাষাগুলো অনূদিত হবে
চোখের ভেতর দিয়ে করোটিতে করলে প্রবেশ
দেখবে গম্বুজ অনুভূতিগুলো উড়ছে রঙিন
কবুতর হয়ে
খুলির ভিতর থেকে সিঁড়িবেয়ে নিচে নেমে যাও
পৌঁছে যাবে হৃদয়ের কাছাকাছি
যেভাবে কিশোর হয়ে যাই তুমি কাছে এলে
ছবি গান কবিতা কাহিনি
জীবনের ছবি একে একে
তুলে ধরি চোখের সামনে
প্রগলভ স্বভাবের বালক যেমন
তোমার চোখের আলো বয়স পোড়াতে ভালোবাসে
ক্রমাগত যেতে থাকি শৈশবের দিকে
দূরে গেলে যেভাবে বয়স এসে হানা দেয়
জীবনের বিশালতা মাদুরের মতো ছড়াতে ছড়াতে
শূন্যতাই প্রদর্শন করে
[পুরুষের মাথার চুলে আঙুল চালাতে থাকে নারী। পরে তার মাথা পুরুষ নিজের কোলে তুলে নেয়।]
নারী
আমার মাথার চুল
শত উপমায় সাজিয়েছো তবু উপমায় কেন ভুল
সন্দেহ প্রবল স্বপ্নের রঙেরা কেন
মুহূর্তে পাল্টায় যেন
কল্পনা স্বপ্নের ঠিক বিপরীতে হৃদয়ের পিছে
রঙ তার মাঝামাঝি
শিল্পের শেকড় বরাবর মাটির অনেক নিচে
চুলের শরীরে তুমি জাদুকর দেখিয়েছো বাজি
ম্যাজিক তাসের মতো শরীরের পাটভেঙে
বেরিয়ে আসছে ছায়াঘ্রাণ
সৌন্দর্যের শরীর পৃথক হাতে করে চলে
অবচেতনে তাজমহল নির্মিত ধূসর মায়া
বিরহের সীমাহীন রাত্রির নিখোঁজ
সকাল সন্ধান
পুরুষ
সবটুকু অহংকার সমর্পণ করবার পরে
স্বভাবে অদল বদল আর গ্রহণ বর্জন
শেষ করে কখনোবা হয়ে উঠি
গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ
মাথা আর কশেরুকা লক্ষ্যস্থল কাঁধের সবুজ
ককেশাস শৈলশ্রেণী
পাপক্লিষ্ট হারুত-মারুত মানবীর কাঁধে দেবত্বের ভার
অর্পণ করেও যার কাঁধ ছোঁয়া ভালোবাসা নাই
দণ্ডিত জীবন তার যে পর্বতে যে কোনো গুহায়
সৌভাগ্যবান সে আমি, পর্বতমালার গাঢ়
রৌদ্রফেরানো সবুজ দেয়ালের গায়ে উঠে যাই
রঙিন লতার মতো।
[পাশে রাখা মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। পুরুষ ফোন রিসিভ করে। কিছুক্ষণ কথা হয়। নারী উৎকণ্ঠিত; কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কথা শেষ হলে… ]
নারী
বাতিল হয়েছে বুঝি কালকের ছুটি
তোমার কাজের চাপ মানুষে মানুষ নয় যেন
[পুরুষ আবার জানালার কাছে ফিরে আসে। নারীর পাশে বসে।]
পুরুষ
তোমার পরম কোলে মাথা রেখে শুয়ে
সমাজ সভ্যতা রাষ্ট্র ধর্ম অর্থ শিল্প
বিজ্ঞান সাহিত্য সবকিছু
আঙুলের ইশারায় বলতে পেরেছি
—সব দূরে যাও
যেন ভীত শিশু মায়ের কোলে যে মুখ
লুকিয়ে বলতে পারে
‘ওকে চলে যেতে বলো’
দুই॥
[পরের দিন সন্ধ্যা। উত্তর আকাশে মেঘের চমক। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। গুমোট গরম। পুরুষের প্রবেশ।]
পুরুষ
শাফটের অমোঘ ঘূর্ণন
অর্থকরী ফসলের জমি
বসন্ত বাতাসে নাই আর
পাতাদের হাসাহাসি
বাতাসে সিমেন্ট বালু
ঝড়ো হাওয়া সুড়সুড়ি দিলে
আমের ডালেরা কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদে
প্রতীক্ষা বারোটি মাস
কেবল একটি মাস
রাঙাতে পারিনি লালরঙে
হতাশ গম্বুজ ডাকে
চৈতালি বৃষ্টির সুরকার
নারী
দুঃসাহসী মশারাই মশারিতে ঢোকে
প্রবল তাদের ঝুঁকি
হাতের তালুতে পিষ্ট
বৈদ্যুৎ র্যাকেটে দগ্ধ
মৃত্যুর দুয়ারে গিয়ে
আহার যোগাতে পারে তারা
পুরুষ
দূরে ঠেলে দেবে? দাও
সমস্ত শরীরে টিকেট লাগিয়ে দাও
ডাকের মাশুল
দু’ঠোঁটের চুম্বনের-স্মারক টিকেট
সারাটা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে
লাগবে মাশুল কত টাকা
দাও ঠিক ততখানি
যাতে আরেক তোমাকে সারা পৃথিবী খুঁজেও পাই
পাব, হয়তো পাব না
আমার দুর্গের মধ্যে
ঢুকতে পারে না কেউ
চেয়েছিলে সেই দুর্গ করতে দখল
পেরেছো হয়তো
দ্বাররক্ষক সশস্ত্র তোমাকে দিয়েছে অনুমতি
পরিচয় যদি দিতে পারো হৃদয় উন্মুক্ত করে
দ্বিতীয় অঙ্ক
এক॥
[বিছানায় শুয়ে আছে অসুস্থ পুরুষ। অনেকক্ষণ ধরে কাশি। কফ বের করে আনার চেষ্টা। দীর্ঘ সময় ধরে কাশি দিয়ে থুতুর দিকে চেয়ে থাকে। সেখানে একটুও কফ নাই। ইনহেলার ঝাঁকুনি দিয়ে বোঝে ভেতরের ওষুধ শেষ। স্ত্রী ও কন্যা বসা পাশে। সহকর্মীর প্রবেশ। কন্যা উঠে যায় পাশের রুমে। পুরুষ উঠে বসে। সহকর্মী তার পাশে গিয়ে বসে।]
পুরুষ
গহীন চুলের সংকলনে
তার নিচে আছে নাকি মানুষের মেধা
গোলাপি রোদের বুক চিড়ে
দাঁড়ালে কিশোর ছায়া
বিয়াল্লিশ পঞ্জিকার চোখ
চশমাশাসিত দৃষ্টি
যা দেখি বুঝি না চশমায়
চোখ বুজে বয়সী চোখের
গোপন ভাষায় লেখা
পড়ে দেখি অনেক অমিল
আয়ু মিশে থাকা বায়বীয় ভাষাচিহ্ন
অভিজ্ঞতা মননে পাঠ
চৈত্রের বাতাসে ওড়ে মারী মহামারী
কাজল দিঘির তলা খটখটে হাসে
মানুষের হাতে দেখি নানান রকম
দুর্বলেরা দায়িত্ব প্রবল এদেশে পালন করে
সম্পন্নের চোখে দেখি বাদুড়ের ক্ষুধা
সহকর্মী
বুঝি না জগৎ কেন অমানুষে ভরা
তোমার অসুখ শুনে বসের চেহারা
মুহূর্তেই কালো হয়। নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত
কীভাবে কলমে আসে এত তাড়াতাড়ি
ছুটি বাতিল নয়তো চাকরি ছাঁটাই
তোমার সিদ্ধান্ত আমি স্বাগত জানাই
জীবনের চেয়ে বড় নয় চাকরি বিধান মানা
আমাদের মধ্য থেকে কাউকে হয়তো
উঁচুতে উঠতে হবে
পতাকার দণ্ডহাতে
দূর থেকে যাতে আমাদের চেনা যায়
আপাতত নিকটের সিঁড়িতেই ওঠো
চূড়ায় দাঁড়াবে
ঝড় আসুক ভয় কী!
পতাকার বিজয়ীর হাসি
দেখা যাবে দূর থেকে
বজ্রপাত হয় হোক
আরো অনেকের উত্থানের অপেক্ষায়
তোমার বিজয়মূর্তি থাকবে দাঁড়িয়ে
পুরুষ
হেলপার মেশিনচালক
সুপারভাইজার প্রোডাকশনম্যানেজার
ম্যানেজিং ডিরেক্টর
সিঁড়িগুলো পেরুনো কঠিন
গুরুর ধরতে হয় হাত
ইচ্ছা করলেই সহজে যায় না ওঠা
অনেক দেখেছি সিঁড়ি
হেলপার মেশিনচালক
অত্যাচারী ফোরম্যান অথবা তুমুল
রক্তখোর মেশিনমালিক
শ্রমিকের পথ কতটা কঠিন
সাতাশ বছরে অনেকেই
পড়েছে হোঁটচ খেয়ে নিজের সিঁড়িতে
উঠেছে হয়ত কেউ
এক দুই সিঁড়ি
আমিও গেলাম পড়ে
ঘামে ভেজা সিঁড়ি ছাদ থেকে
ভাঙ্গা পায়ে প্রায় দিনমজুরির পথে
ছুটি নাই
নিদেন নিয়োগপত্র
প্রমোশন নাই
ঘাটশ্রমিকের কাছের মানুষ এক
ডানাকাটা ভিখু
অথবা পায়ের দগদগে কোনো পাঁচী
গুমোট ফ্যাক্টরি থেকে
মুক্ত বাতাসের ঘাটে
বাতাস যেদিক খুশি বুক ভরে যায়
নিশ্বাস ত্যাগের ইচ্ছাখুশি
এতটাই স্বাধীন জীবন
মাথার ওপর চালা নাই
গতি নাই বিধিও অজানা।
নারী
তখনো আকাশ ঘন কালো
সীমাহীন সম্ভাবনা
রঙিন তারারা ছিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
তার পরে ভোর, বস্তুর দীঘল ছায়া
ঘাট থেকে মিনিটে মিনিটে
ছেড়ে যায় নাও
কোনোটা পৌঁছে না বিশুদ্ধ রঙের দেশে
ফিরতি খ্যাপের যাত্রী নিয়া
ফিরা আসে
মাঝিদের আয় বুঝে ব্যয়
ব্যয়ের হিসাবে তার আয়ের আকাঙ্ক্ষা
[সহকর্মী বেরিয়ে যায়। কন্যার প্রবেশ। কন্যার মাথায় হাত রাখে পুরুষ।]
পুরুষ
হে প্রেম আমার শিশুবেলা,
দরোজার পর্দাধরে দাঁড়িয়ে রয়েছো
কোনা কামড়ায় নিকটে আসতে পায় ভয়
দু’পায়ে দুপাটি উল্টা জুতা পরা
হে প্রেম লাজুক কৈশোর,
ওড়না জড়ানো বয়স আমার বেলা
নিরন্তর কল্পনায় ক্লান্ত দু’চোখের ভারী পাতা
নজর নামিয়ে রাখে
সজাগশ্রবণে শোনে ব্যাকরণ পাঠ
নির্বাচিত বিষয়ে সবার আগে তোলে মাথা
কণ্ঠস্বর নিচুতে অনেক
চাঞ্চল্য ফুরালে দাঁত দিয়ে কাটে নখ
হে প্রেম আমার, তারুণ্যের অনাগত
ফুল ফোটার উপমা চিরন্তন বলি
পাপড়ি ছড়িয়ে দল
বৃতি সরিয়ে রেণুকা
রঙের সমান ঘ্রাণ-বাতাসে ছড়াবে একমাথা
কালো শেকড়ের জাল
হে প্রেম আমার প্রৌঢ়তা,
চিকন পারের শাড়িপরা মোটা ফ্রেমের চশমা
ভারী শরীরে ট্রে-হাতে নিকটে দাঁড়াবে
পরাবাস্তব একটা সালাম পাবার অভিপ্রায়ে
[বাবার অসুখ যেন আরোগ্য হওয়ার নয় বুঝতে পারে কন্যা। ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে ওঠে।
পুরুষ
আমি চলে গেলে
না, তেমন কিছুই হবে না
আহ্নিক বার্ষিক গতি, স্থবির হবে না পৃথিবীর
চন্দ্র-সূর্যের গ্রহণ লাগবে না জানি আমি
দ্রুত হাজির হবে না কোনো ধূমকেতু
ঝরে পড়বে না উল্কাপিণ্ড
এমনকি জমবে না মেঘ এক টুকরা আকাশে
ইতিহাসে ঘটবে না কোনো বিবর্তন
টলে উঠবে না কোনো রাজসিংহাসন
যুদ্ধ হবে না কোথাও, পতন হবে না
কোনো সেনানিবাসের
অর্থনীতি ফেলবে না অমোঘ প্রভাব
নামবে না ধস কোনো শেয়ার বাজারে
দ্রব্যমূল্য লাফাবে না পারদের মতো
অশুদ্ধ হবে না মহাগ্রন্থ
যোগীর ধ্যায়ান আর সুফির জিকির
মুহূর্তের জন্য থামবে না
বিরোধীদলেরা ডাকবে না হরতাল
কেউ কোনো গোলপোস্টে আত্মঘাতী করবে না গোল
উইকেট পড়বে না-রবে সবকিছু ঠিকঠাক
অন্যমনস্কতা ফাঁক দিয়ে ফ্রিজে ঢুকবে ইঁদুর
দুর্গন্ধ ছড়াবে পচে
সোফার ফোমের ফাঁকে নির্মাণ করবে
তেলাপোকা অভিজাত প্লেটোর নগর রাষ্ট্র
পোকায় কাটবে রবীন্দ্ররচনাবলী
ছত্রাক জমবে ধীরে ক্যাসেটের চুম্বক ফিতায়
আর সিলভার ডিস্কে
টি-টেবিলে নিচে জমে যাবে
অপঠিত পেপারেরা
চিঠির বাকসো দিনে দিনে
স্ফীত হবে গর্ভবতী যেন
পিঁপড়া কাটবে তার, টিভি সেট অন্ধ হয়ে যাবে
চাবি হারালে শাবল আসে, তেমনি আসবে এই ঘরে
অণুপরিমাণ অপরাধ সুদে-আসলে বাড়বে
আমার নামের সাথে যোগ হবে রূঢ় বিশেষণ
আর সব ঠিকটাক আগের মতন
না, তেমন কিছুই হবে না।
পুরুষ
মৃত্যুর ভাবনা ছাড়া বাঁচে না মানুষ
মৃত্যু বন্ধুর মতন অথবা শত্রুর
প্রতিদিন করছি স্মরণ
শরীরের বটগাছে এসে ডানা ঝাঁপটায় বসে
বিশাল ডানায় ঘিরে
অতিচেনা বৃক্ষের স্বজন
বাসা বাঁধে এখানে সেখানে
দেখা দেয় নানা রূপে
মাটির ঢেলায় উচ্টা খাওয়া থেকে শুরু
বুকে পেটে কণ্ঠনালী
উনিশের সাথে এক যোগ হলে ভয়
ভয় হয়ে দেখা দিতে শুরু
কৈশোরে লাফিয়ে পার হওয়া
ব্যথা-বেদনার প্রতিহিংসা
বয়সের চিকন ডালায়
এসে বসে
ঘাড় ভেঙে মাথা নিচু
মুকুট নামিয়ে ফেলে রাজার ব্যক্তিত্ব
শিশুদের টোফাটাফি খেলে
বিড়ালের পাতে ভাত—সেও খুঁটে খায়
অধীত বিদ্যার ভার
বাজারদরের মতো
করে ওঠানামা
বিকট জন্তুর ছায়া রূপকথা ছিঁড়ে
দাপিয়ে বেড়ায় চোখে
বিশ্বাস অটল আর অবিশ্বাসী মন
আস্থাভূমি তার এওয়াজ বদল করে
উদ্বৃত্ত চুলের ছোঁয়া কানে আনে ভয়
বিশাল ডানার কালো এই বুঝি এল
বালিশে হেলান দিয়ে সারারাত জেগে থাকে ঘুম
সভ্যতার শব্দেঘেরা দিবসের আলো
ক্ষণিকের স্বস্তি খোঁজে সুড়ঙ্গ ভেতর
নিকটের স্বজনেরা বিরক্তিকারণ
দূরতর আত্মীয়ের দেখা চায় মন
মূল্যবান পণ্যগুলো সস্তা বলে ভ্রম
অজ্ঞাত প্রাণীর বিষ্ঠা উপশম যেন
দুয়ারের বাইরে দুয়ার জানালা-জানালা থেকে
খুলে যায় অকস্মাৎ দপ করে নিভে গেলে বাতি
সকলের রোমরাজি খাড়া বিদ্যুৎ প্রবাহ যেন
প্রবলে বিকট আসে
মৃত্যুভয়ে কাতর মানুষ
মৃত্যুতে আশ্রয় চায়।
তৃতীয় অঙ্ক
এক॥
[পুরুষের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে। বিরহে আকুল স্ত্রী টলোমলো পা নিয়েই যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে চায়। পুরনো সোফায় বসে। কন্যার প্রবেশ। খাট, সোফা আর আলমিরার মাঝে নিচে একটি বিড়াল ঘুমাচ্ছে। ]
নারী
ঘরের ভেতর ঠাসা দামি আসবাব
দাঁড়াবার ফাঁক নাই
আহা মূল্যবান বাড়ি
সেখানে জীবন নাই
চিপায় বিড়াল এক নীরবে ঘুমায়
পাঁজরে জীবন তার ওঠানামা করে
কন্যা
পিতার বৃত্তের চেয়ে কিছুটা বুহৎ
পরিধি গড়তে চাই
লাউয়ের খোলের চেয়ে বড়
পাড়বাঁধা কুয়ার থেকেও
জয় করতে করতে
আত্মউৎসর্গ করা লক্ষ সৈনিকের
দুর্ভেদ্য দুর্গের ধারণার চেয়ে বড়
উত্তর প্রজন্ম চাইবে কি
আমার পরিধিজুড়ে থাক
স্মৃতিধন্য দেয়ালের পবিত্রতা
প্রত্নতাত্ত্বিকের জালিয়াতি
ভূমিকম্প ঢেউ ধরে
ইঁদুরের রূপ ধরে থাকে
নাহলে মুক্তির পথ
ভূমিকম্পে সৃষ্টি হয়।
নারী
মাথার খুলিতে বাড়ে পাকুড়ের চারা
মেরুদণ্ডে ঋজুপথে নামছে শেকড়
চোখের ভেতর ভগ্ন প্রাসাদের ভৌতিক বাড়ির ছায়া
থমথমে নির্জনতা পাশ ফিরে শোয়
আবাসন নেই আর
বিছানার সবুজ চাদর বিছিয়ে রেখেছে কাঁটা
গনগনে আগুন বালিশে দীর্ঘ-দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
ফণা তোলে স্টিলের চামচ
খাবার টেবিলে
পুস্তকের অক্ষরেরা সাঁৎ করে লাথি মারে চোখে
নিজেকে সরিয়ে রাখে চিরচেনা সোফা
পড়ার টেবিল আজ কোপ মারে ঘাড়ে
শব্দ করে ফেটে পড়ে হোল্ডারের বাল্ব
আবাসন নাই আর রাজপথ নির্বাসনে দেয়
দরিদ্র গলির নাই সায়
দায়ভার গ্রহণ করার
দখিনা বাতাস তার নোনাজলে ভেজা ভারী লেপ
ফুসফুসে দড়িটানা কামারের পুরনো হাপড়
ছাতা যেন পিঁপড়ায় কাটা এক রাতের আকাশ
বল্লমের ধার নিয়ে ঝরে আমপাতা
কলমের ঘূর্ণ্যমান বল জামাট বরফঢাকা
আঙুলের ছাপ নিয়ে ঘুমায় এখন
কাঁঠাল পাতারা যেন জালটাকা রূপ
অচল মানুষ এক তবুও ভ্রমণ
এভাবে মানুষ করে কাল পর্যটন?
২॥
[নারী ঘরের কাজ করছিল। দরোজায় কড়া নাড়া। কপাট খুলতেই অফিসের বস প্রবেশ করেন।]
নারী
বঞ্চনার অভিজ্ঞতা ছাড়া
আর অনুভূতি নাই
ঘরে ঘরে হাহাকার
পাতা ছুঁয়ে যায়
ধনুক রাশির নিমগাছ
অতীতের ধর্ম, যুদ্ধ
দারিদ্র্য দুর্ভিক্ষ আজ
ভেঙে পড়া সাম্রাজ্যের মতো
ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে গত
কে পারে এড়াতে তারে
খণ্ডিত চিন্তার মানুষেরা
পায় না অখণ্ড ক্ষমতার
বোধ চিনে নিতে
কন্যা
মানুষ অথবা তার কষ্ট
কোনটি প্রাচীন
আগে কষ্ট পরে সে মানুষ
নাই দুঃখবিলাস এতটা
প্রথমে মানুষ
মানুষ না থাকে যদি
দুঃখ তাহলে কার
অমানুষ বেদনাবিহীন
[কন্যা বেরিয়ে যায় পাশের রুমে।]
বস
মানুষ মূলত এক রক্তের লাটিম
সর্বদাই ঘূর্ণ্যমান আদিম পাহাড়
পাহাড়ে আগুন জ্বলে
আগুনের শক্তি কত সকলের জানা
সভ্যতা চেয়েছে শুধু শ্রমের ঠিকানা
নারী
কাল রাতে স্বপ্ন দেখি একমুঠো চাল
ছড়িয়ে দিয়েছি ছাদে
হাজারটা পাখি এসে খুঁটে খুঁটে খায়
তোমাকে জড়িয়ে পৃথিবীর
সব কবির উপমা
সত্য বলে মনে হয়
হাটে হাড়িভাঙা যুগ আজ অবসিত
আমার ডান পা কাটা গেল
গতিশীল ট্রেনের চাকায়
নাকফুল ফেলে দিয়ে
নীরব হয়েছে আজ
দাগহীন শাদা থান
জনাকীর্ণ বাড়ির দুয়ারে
এলে চোখে পড়ে তাকে
ভয়ে জড়সড় সকলের ভিড়েও একা
ইদানিং রাত জাগে দেখছি সবাই
সুইচবোর্ডের লাল চোখ
তীব্র চেয়ে থাকে
মর্ম আজ মর্গ হয়ে আছে
আমার কন্যাকে দেখি
মুখ তার আবছায়া অশ্রুর কুয়াশা
২॥
[মা আর মেয়ে বসে আছে।]
কন্যা
ছিঁড়ে গেলো ক্যালেন্ডার পাতা
কী যেন হারানো আজ জলরঙে চোখ
বেদনার সানাইয়ের সুর
তেলরঙে ভাসে
ক্লান্তিতে শীতল আমি বিন্দু বিন্দু ঘাম
ব্যর্থ মাকড়শা পতনচিত্রের ছবি
ছিঁড়ে গেল ক্যালেন্ডার পাতা
কন্যা
আরো বড় হতে ইচ্ছা করে
জাম্বোজেট সব কটি মহাদেশ থেকে
সাত শ যাত্রী একত্রে আসন পাবে
সাত শ ভাষায় কথা
সাত শ সুরের গান
সাত শ কবিতা
গুনগুনিয়ে উঠবে
আরো বড় হতে ইচ্ছা করে
ট্রান্সএশিয়ার রেলওয়ে
আন্তঃমহাদেশী ট্রেন বসফরাস প্রণালী থেকে
সিঙ্গাপুর, তার চেয়ে দূরে
সত্যবাদীর মতন মিথ্যা ঝেড়ে
আদিম অস্ট্রাল অনুসন্ধানের পথে
অনায়াসে ছুটে যাবে
খরগোশ কচ্ছপকে শেখাতে পারে না গতি
শেকল পারে না দিতে
মানুষের বিবেকের সুর
কেবল বাজতে পারে একঘেয়ে ঝনঝন স্বরে
আরো বড় হতে ইচ্ছা করে
শেকলের শব্দ বাজে যদি এক কানে
অন্য কান বিপরীত দ্রাঘিমায়
বসেও নিজের সুর খুঁজে যেন পায়
আরো বড় হতে ইচ্ছা করে
নোঙরের শেকলে শেওলা জমতে না পারে
নদীগুলো জোড়া লেগে সৃষ্টি করে
অচেনা সুরের রাজপথ
আরো বড় হতে ইচ্ছা করে
হাজার রাতের এক গল্পে অনেক মানুষ ঠেলে
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি
একক আঁচলে শুধু পড়বে না বাঁধা
আরো বড় হতে ইচ্ছা করে
[নারী বেরিয়ে যায়। কন্যা কেঁদে ওঠে।]
কন্যা
মা, তুমিও চলে গেলে
আমাকে অনাথ করে
দেখেছি পিতাকে আমি
দুহিতার চোখে
দেখেছি পিতাকে আমি
নারীর দৃষ্টিতে
মুক্তিপথ রেখেছেন তিনি
আদিম সমাজ নাই আর
ঘাট থেকে যত যাত্রী নামে
দেখে মনে হয় এত বাহন তো নাই
তবু স্টেশনের প্লাটফর্ম
নীরবে নির্জন হয়
পাগল বাতাসে ওড়ে
ছেঁড়া কাগজের মিহি ডানা
সবাই সবার পথে যায়
খুঁজে নিতে হয় নিজ পথ
সম্ভাবনা হারিয়েছ তুমি
জগৎসংসার বিপুল পরিধি তার
গৃহ সংসারের এই এক গৃহকোণ
অন্যতম কোণমাত্র
সেখানে রাজত্ব নিয়ে
দিদ্বিজয়ী কেবা কবে হয়
পরজীবী সুখী প্রাণী
বিপ্লবের…