আমার বন্ধু ভাগ্য ভালো। অনেকেই বিখ্যাত। আবার জগদ্বিখ্যাত কেউ কেউ। সারা পৃথিবী তাদের এক নামে চেনে। তাদেরই একজন চিত্রশিল্পী রুহুল আমিন কাজল। ডেনমার্ক প্রবাসী। ডেনমার্কের রাস্তায় পৃথিবীর দীর্ঘতম স্ট্রিট আলপনা এঁকে গিনিজ বুকে স্থান করে নিয়েছে। দ্বিতীয় জন নারীবন্ধু। অথবা বন্ধুর স্ত্রী। জগৎজুড়ে নারীবাদী লেখক হিসেবে সুনাম-দুর্নাম অর্জন করে এখন আলোচিত নারী চরিত্র। নাম তসলিমা নাসরিন। সম-সাময়িক বন্ধুরা অনেকেই দেশজুড়ে সম্মানিত।
কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ থেকে আরম্ভ করে তরুণ কবি বদরুল হায়দার পর্যন্ত। দীর্ঘ সময় ধরে এদের সঙ্গে সখ্য। পরস্পর আত্মার মানুষ। তাতেই আমি ধন্য। এসব মহান বন্ধুদের নিয়ে শিল্পের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে নিজকে কখনো অসহায় মনে হয়নি। বরং বোধের চৈতন্য পুলকলাগা ভোর উঠে এসেছে। আমি ধন্য হলাম। ছড়াকার, গল্প, লেখক আলম তালুকদার আমার তেমন বন্ধু। যার সান্নিধ্য সবসময় আনন্দের। অসংখ্য ফুসফুস ভরা হাসি নিয়ে ক্রমাগত পথ চলা। ওর ক্ষেত্রেও বলা যায়, দীর্ঘ জীবন ধরে ওর সঙ্গে জীবন বেঁধে কখনো মনে হয়নি আমি অতৃপ্ত। বরং সহস্র প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এই ‘আমি’ নামক মানুষ, রসজ্ঞ আলম তালুকদার আমার সঙ্গে থেকে গেছে।
জন্ম তারিখ ও ঠিকুজি ঘেঁটে দেখি সে আমার দশ মাস দশ দিনের ছোট। ছেলেবেলা থেকে আমি খর্বাকায়, তালুকদার বিশাল লম্বা পুরুষ। দেহ, মাশাল্লা! বাঙালির সাধারণ উচ্চতার চেয়ে প্রায় একফুট বেশি হবে। ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, গোঁফ মিলিয়ে কাজী সাহেবের মামা তো ভাই। আর কণ্ঠস্বর! ভরাট ও দরাজ। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক। স্টেনগান হাতে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুর কাছে জীবনবাজি রাখার প্রত্যয়ী চরিত্রের প্রমাণ দিয়েছে যৌবন শুরু হওয়ার পর পর। আর আমি খর্বাকায়, ছোটখাটো বালক হাওয়ায় যুদ্ধের ময়দানে ওর মতো মৃত্যুঞ্জয়ী হাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। জয়তু তালুকদার।
দীর্ঘ সময় এ অঙ্গনে বিচরণশীল একজন সফল ছড়াকার হিসেবে তালুকদার বিবেচিত হবে।
রবীন্দ্র ঠাকুরের ভাষায় বলা যায়, ‘আমরা দু’জন একটি গাঁয়ে থাকি/ সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।’ জি, আমরা প্রায় এক গাঁয়েরই মানুষ। এক থানায়, এক জেলায়। শুধু আমাকে ঘিরে রেখেছে বনভূমি। ওকে বেঁধেছে গালা নামক চুনিয়ার মতো শান্ত গ্রাম। শুধু মাতৃভূমি আক্রান্ত হলে ওই গ্রামের যৌবনে পা দেওয়া যুবক আমার বন্ধু ঘরে ফেরেনি। শত্রুকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে যমুনার জলে। আমি তাকে সম্মান না দেই! ভালোবাসার শিষ দিয়ে বলি, প্রিয় যোদ্ধা, প্রকৃতি আমাকে তোমার সহযোদ্ধা করেনি, তাই বলে কি তুমিও গ্রহণ করবে না? আমার দীনতাটুকু গ্রহণ করো। হয়তো আলম তালুকদার তা গ্রহণ করেছে। না করেই উপায় কী? জন্মমেধাবী এক তরুণের জীবন নির্মাণ করতে কোনোরূপ বেগ পেতে হয়নি। প্রথাগত শিক্ষায় ও ছিল একটু বেশি এগিয়ে। পরবর্তী সময়ে যা ওর জীবন নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পাস করে সরকারি ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদ থেকে অবসরে গেছে। শুধু জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, অনেক অনেক দিনরাত্রির বিষণ্ন কাতরতা। তো, মহাপরিচালক অনেকেই হতে পারে। আমার অমেধাবী অনেক বন্ধুই আজ এই পথ ধরে হাঁটছে। যথাসময়ে অবসরে যাবে। একসময় মৃত্যু এসে পৃথিবীর দায়-দেনার হিসাবও চাইবে না।
ওই যে আমি প্রথমেই বলেছি, আমার বন্ধুভাগ্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে।
১৯৭৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকায় ছড়া লেখার মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে সখ্য আরও পোক্ত হয়। না তালুকদার মস্ত বড় লেখক হতে চায়নি। শিশু মনস্তত্ব ওর মস্তিষ্কের কোষে কোষে জমা রয়েছে শিশুতোষ পঙ্ক্তিমালার অজেয় শব্দরাজি। যা তাকে মহাসৃষ্টির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ঈশ্বর সম্ভবত ওকে জন্ম-ছড়াকার করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নইলে এত সহজাত ভঙ্গিতে কী করে ছড়া লেখা সম্ভব! যেকোনো বিষয় নিয়ে ও ছড়া বানাতে পারে। জীবনাচরণের প্রতিটি মুহূর্ত যেন নতুন শব্দাবলির হিরণ্ময় খেলা। কখনো বিষয়ের ভাবনায় যেতে হয় না। আপনি নিজেই অনুভব করবেন, এ কথাগুলো আমার বলা উচিত ছিল। তালুকদার অবলীলায় বলে যাচ্ছে। সমকালীন শিশু সাহিত্যিকদের মধ্যে আলম তালুকদারের প্রতি আমার সীমাহীন ভালোলাগা। দীর্ঘ সময় এ অঙ্গনে বিচরণশীল একজন সফল ছড়াকার হিসেবে তালুকদার বিবেচিত হবে।
ওই বললাম, ওর মধ্যে বাস করে একটি শিশুতোষ ভুবন। যেখানে রসের হাড়ি নিয়ে বসে থাকে মোহান্ধ পরিব্রাজকের মতো। সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী ওর বইয়ের সংখ্যা একশত অতিক্রম করেছে। শিশুতোষ গল্পের বইয়ের সংখ্যা কম নয়। আমি যখনই ওর যেকোনো রচনা পাঠ করি, আমাদের টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান সুসাহিত্যিক তারাপদ রায়ের কথা মনে পড়ে। কলকাতা নিবাসী তারাপদ রায় সমগ্র জীবন তার রসজ্ঞ রচনার পটভূমি বেছে নিয়েছেন পূর্ববঙ্গের টাঙ্গাইল নামক একটি জেলার জীবন-যাপন, প্রকৃতি-মানুষ, জনপদ এবং পথরেখার বিশদ হৃদয়গ্রাহী বিবরণ। আলম তালুকদার প্রায় ওই ঘরানার লেখক।
বলি, ভালোবাসি। কানে কানে বলি, তুই যেন এত পান না খাস। আর পাবি কোথায়? বিদায় বন্ধু।
রচনার শৈলীর চমৎকারিত্বের মুন্সিয়ানায় সমানে সমান। ব্যক্তি জীবনে দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার পরও লেখালেখিতেই যেন ওর ধ্যান-জ্ঞান।
ব্যক্তি জীবনে মধ্যরাতে যখনই মুঠোফোনে ওর সঙ্গে বাতচিত হয়েছে, তখনই ও বলেছে, বই পড়ছি। এই বইটি তোরও পড়া উচিত। অমুক দোকানে পাওয়া। অথবা না, না তুই কিনিস না আমি তোকে উপহার দোবো। ও হয়তো জানে না, গভীর রাত পর্যন্ত আমি ওর মুঠোফোনের কলের জন্য অপেক্ষা করি। ওই যে বললাম, শিল্পদেবী শিল্পভুক, গ্রন্থভুক, ছড়াভুক, রসভুক করে ওকে এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। তার কলাকৌশল খুঁড়তে খুঁড়তে এক সময় আবিষ্কার করে জীবন ঘনিষ্ঠ অমর পঙ্ক্তি। আমি ওর পঙ্ক্তির অপেক্ষা করি। ওর এই নিরলস পথ চলায় সেই কবে সহযাত্রী হয়েছি।
আর তার জন্য দেশ-বিদেশে প্রচুর সম্মান প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গসাহিত্যের একজন শিল্পিত খেদমতকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমিও ভালোবাসা-বেদনায় পথ হাঁটি। কখনো কষ্ট, কখনো সুখ বয়ে বেড়াই। বলি, একটু পা চালিয়ে ভাই। বাংলা সাহিত্যের এই অকুতোভয় যোদ্ধা, সর্বজন প্রিয়, বন্ধু আলম তালুকদারের প্রয়াণ ঘটেছে। এই ঢাকা শহরে আমি বন্ধুহীন হয়েছি। মনে মনে ভাবি, শিশু সাহিত্যিক আমার বন্ধু। ওর প্রাণখোলা হাসির সারল্যে অবগাহন করি। বলি, ভালোবাসি। কানে কানে বলি, তুই যেন এত পান না খাস। আর পাবি কোথায়? বিদায় বন্ধু।