পিচ গলা এলিফ্যান্ট রোডের রাস্তায় রেখে আসা একপাটি বাদামি স্যান্ডেলের শোক আমি এখনো বহন করে বেড়াচ্ছি! হায়রে গ্রীষ্মকাল। আজ যখন এখানে সামার এসেছে বলে চারদিকে ফুলঝুরি আনন্দ, তখন মনে পড়ে ঝলসানো দ্বিপ্রহরে কাকের চিৎকার। সেই সব অলস দ্বিপ্রহরে জলে নয়, দিঘিতে নয়, কেবলই কবিতায় সাঁতার কেটেছি। সাঁতার কেটেছি ঠাণ্ডা শানের মেঝেতে শুয়ে, কবিতা বইয়ের পাতা উলটে অথবা রবি ঠাকুরের গান শুনে। কখনো কখনো গনগনে দগ্ধ দুপুরগুলো বড় বিজন বিষণ্ন আর একাকী মনে হতো। রাস্তাগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলতো। দূর থেকে দেখলে মনে হতো—জায়গায় জায়গায় জল জমে চকচক করছে। আসলে তা নয়! তা ছিল মরীচিকা, নিতান্তই দৃষ্টিভ্রম।
কানাডায় না এলে কখনোই অনুভব করতে পারতাম না—গ্রীষ্মকাল এখানে কতটা কাঙ্ক্ষিত, কতটা চাওয়ার। আমি এদেশে প্রথম এসে পৌঁছেছিলাম সাদা বরফে ঢাকা বেঘোর শীতে। সে বছর যেন একটু তাড়াতাড়িই শীত নেমেছিল। ডিসেম্বর আসার আগেই এতটা তুষারপাত হয়েছিল যে, সবুজ-শ্যামল পুবদেশ থেকে আসা একজন আগন্তুকের কাছে তা ছিল প্রচণ্ড এক ধাক্কা! কোথাও কোনো সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। কেবলই সাদা আর সাদা। কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবিনি সবুজ বিহনে প্রকৃতি হতে পারে। সাদা কাফনের জড়ানো বলে মনে হতে থাকে সবকিছু। এরই নাম কি মৃত্যু চরাচর? অসহ্য এক অনুভূতি নিয়ে শুরু হয়েছিল আমার প্রবাসজীবন। দেশে থাকতে যে শীতকাল ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের ঋতু, তা কিনা এখানে এসে হয়ে গেলো সবচেয়ে অপছন্দের। তার ওপরে, মরার ওপরে খাড়ার ঘায়ের মতো সেই প্রথম শীতেই ব্ল্যাক আইসে পিছলে পড়ে গিয়ে, পায়ের বারোটা বাজিয়ে শীতের প্রতি বিরূপ মনোভাব চিরস্থায়ী করে, এখানেই রয়ে গেলাম।
শীত নিয়ে আমার এই কাতরতায় অনেকেই বলেছে, অপেক্ষা করো সামার আসবে, দেখো তখন কত এনজয় করতে পারবে! সামার এনজয় করবো মানে! গরম, এ আবার কী এমন মহার্ঘ্য জিনিসরে বাবা? সারা জীবন ৩৩ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কাটিয়ে আসা গ্রীষ্ম প্রধান দেশের একজন মানুষের কাছে, গরমের এই লাবণ্যময় রূপ কতটা বা কী হতে পারে, তা ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন গ্রীষ্ম এলো, তখন নিজেই নিজেকে বললাম, এটা গরম নয় এটা সামার! এ যেন এতকাল দেখে আসা দুর্বিনীত গরমের আহ্লাদী ভার্সন। তাই এখানকার গরম মানে আমার কাছে ‘সামার’। তখন শীতের বাড়তি পোশাক ফেলে দিয়ে সবাই কেমন হালকা হয়ে যায়! সংক্ষিপ্ত পোশাকে ঘুরে বেড়ানোর সময় এটা, মাত্র তো এই তিনটে মাস। একটা ফুরফুরে মেজাজ। ফুল প্রজাপতি আর সবুজ রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সকলে যেন এক একটি রংধনু।
সামার এসে নানা রঙের ফুলে ছেয়ে দিল পুরো দেশটা। রাতারাতি প্রকৃতি যেন ফুলে ফুলে আপ্লুত হয়ে সাজিয়ে তুললো চারদিক। অবশ্যই এর পেছনে রয়েছে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরিচর্যা। রাস্তাঘাট, পার্ক, বাড়ির আঙিনা কোথাও বাকি নেই এই ফুলের জলসা। তারই মাঝে দেখতে পাই, গ্রীষ্মকালে ঢাকার রাস্তায় সারি সারি ফুটে থাকা আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া, হলুদ-কমলায় রাধাচূড়া আর টকটকে শিমুলের অপূর্ব রূপ। শেরেবাংলা নগরের ক্রিসেন্ট লেকের দুপাড় ধরে কৃষ্ণচূড়ার মেলা বসেছে। ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলে রাধাচূড়ার সমাহার। বেগুনি জারুল ফুটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। কেনরে মন তোর এত মনে পড়া? আরে মনে হবেই বা না কেন, জীবনের বারোঅনাই তো কাটিয়ে এলাম সেখানে…!
সামারে টরন্টোতে প্রায় দিনই বৃষ্টি হয়। দুপুরের পর মেঘলামুখো আকাশ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ভেঙে পড়ে মাটিতে। আমার কাছে ঘন কালো মেঘ মানেই বাংলাদেশের কালবৈশাখী ঝড়ের সংকেত। কৃষ্ণ তাহলে রাধাকে খুঁজতে এদেশেও আসে! তখন আকাশটাকে খুব চেনা, পরিচিতর মতো দেখায়। কিন্তু প্রকৃতির এই মুখভার বেশিক্ষণ থাকে না। বাদলের পরপরই রোদ উঠে পড়ে কিংবা স্নিগ্ধ সজীব সন্ধ্যা নামে। এখানে গরমের সন্ধ্যা হয় নটা, সাড়ে নটায়। দীর্ঘদিবসকে কাজে লাগাতে গ্রীষ্মকাল আসার আগেই, প্রতিবছর মার্চে ঘড়ির কাঁটাকে একঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে ডে-লাইট সেভ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আবার তা পিছিয়ে দেওয়া হয় নভেম্বরে।
কানাডায় অফিশিয়াল গ্রীষ্ম শুরু হয় জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে। হয়তো তখনো জমিয়ে গরম আসেনি, শীতের ছোঁয়া টানা সূক্ষ্ম হাওয়া প্রায়ই কাবু করে। বাইরে বেরুলে একটি হালকা শীতের জ্যাকেট বা সোয়েটার সঙ্গে রাখতেই হয়। কিন্তু তারই মাঝে নিয়ম করে সবকিছু পালন করার এই দেশে, গ্রীষ্মের আগমনের তারিখ ঘোষণা হয়ে গেল রেডিও, টেলিভিশন আর ইন্টারনেটে—আজ জুন মাসের ২১ তারিখ, শুরু হল সকলের কাঙ্ক্ষিত সামারের প্রথম দিন! সঙ্গে সঙ্গে সবার মন ভালো হয়ে গেলো। নড়ে-চড়ে বসলো সবাই। গায়ের বাড়তি পোশাক ছুড়ে ফেলে ভারমুক্ত হওয়ার আগ্রহে চঞ্চল হয়ে উঠলো। গতকালও যে বাতাসকে শীতের ছোঁয়া নিয়ে জবুথবু করে দেওয়ার চক্রান্তে মেতে আছে বলে মনে হয়েছে, আজ তাকেই যেন একেবারে নতুন করে দুষ্টু এবং রোমান্টিক বলে মনে হতে থাকে। অথচ আবহাওয়ার উত্তাপ চরিত্র হয়তো তখনো একই রয়েছে। সামারের প্রতি এই দুর্দমনীয় প্রলুব্ধতা সব বয়সী নারী-পুরুষ-শিশুকে মাতিয়ে দিয়ে যায়। বাহির তখন ডাক দেয়, আয় ওরে আয়! পুবের মতো এখানে ছয় ঋতু নয়, চারটি—গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠজুড়ে গ্রীষ্মকাল। সে কারণে বৈশাখ উপলক্ষে মেলার অন্ত নেই বাংলাদেশে। বৈশাখীমেলা এসব এদেশেও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মতো এপ্রিলের ১৪ তারিখে পহেলা বৈশাখের ছুটি না থাকলেও, ওই তারিখের কাছাকাছি উইক-এন্ডেই জমে ওঠে বাংলা নববর্ষের মেলা। দেশ ছাড়িয়ে এই মেলা এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উদ্যাপিত হচ্ছে। যেখানে বাঙালি রয়েছে। ছায়ানটের ভোরবেলার নববর্ষবরণ, গ্রামে গঞ্জের নাগরদোলার আড়ং অথবা চারুকলার মুখোশ মিছিল না হলেও, এখানেও মিছিল গান আর রঙিন বৈশাখীমেলা হয়, বাঙালির অন্তর ভরে ওঠে আনন্দ উল্লাসে। তবে সে সময় এদেশের বাঙালি কেবল বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে, গ্রীষ্মকে নয়। কারণ তখনো এখানে বসন্তকাল, তাপমাত্রা ৫-১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। গরম তখনও অনেকটা দূরে। একবার বৈশাখের প্রথম দিন বাসে উঠে, বাস চালককে খাঁটি বাংলা ভাষায় ‘শুভ নববর্ষ’ বলে শুভেচ্ছা জানাতেই সে তো অবাক! পরে মানে বুঝিয়ে দেওয়ায় দারুণ খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কোন দেশের নববর্ষ? বললাম, বাংলাদেশের। কানাডা মাল্টিকালচারের দেশ, এরা জেনে গেছে এখানে এখন নানা জাতির নানা সময়ে নতুন বছরের উৎসব হয়ে থাকে। তবে নববর্ষের ছুটি বলতে ওই জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের পহেলা জানুয়ারিতে বরাদ্দ। আর সব যার যার তার তার।
সাউথ আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা ফল, শাক-সবজি সারাবছর একইভাবে পাওয়া যায় বলে নতুন কোনো ফল বা সবজি খাবার উত্তেজনা নেই।
শীত ফুরালে প্রথম সামারে দুই অনাবাসী, আমি ও আমার বন্ধু হেলেনা গোমেজ খুব বেড়াতে শুরু করলাম। সেও তখন এদেশে আমার মতোই নতুন। পরিচয় হয়েছে নবাগত অভিবাসীদের জন্য পরিচালিত ইংরেজি শেখার স্কুল ইএসএল-এ। বাড়ি কিশোরগঞ্জ, কথাবার্তায় আঞ্চলিকতার টান ভরপুর। খুব মিশুক এবং গানপ্রিয়। আমরা প্রায়ই যাই একটি আইরিশ পাবে, নাম—ম্যাকক্যারথি’স আইরিশ পাব। ওটি ছিল জেরাডের পুবদিকে। বেশ পুরানো একটি পাব। ওখানে যাবার আরেকটি কারণ সামারে প্রতি সোমবার সন্ধ্যা আটটায় থেকে শুরু হতো আইরিশ গান-বাজনার আসর। একেবারে লাইভ। পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান বাজিয়ে পিটার তার দলবল নিয়ে আইরিশ গানের সুর বাজাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিটার, বেহালা, বাঁশি, ব্যাঞ্জো, কন্সার্টিনা, বাওরন বাজিয়ে আইরিশ লোকসংগীতের সুর শুনিয়ে যেত একটার পর একটা। এ কারণে সেই পাবে প্রতি সোমবারের নিয়মিত অতিথি আমরা। বিয়ারের চুমুক দিয়ে শুনতে শুনতে চলে যেতাম খুব চেনা কিছু গানের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানগুলোর মনে পড়ে যেত। যদিও জানতাম ওই গানগুলো স্কটিশ সুরে বাঁধা। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এগুলো আইরিশ সুরেরও কাছাকাছি, একই সুর বললেও ক্ষতি কী! পরে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম, স্কটিশ ও আইরিশ সংগীতে অনেক মিলমিশ রয়েছে, বাদ্যযন্ত্র ও সুরেও রয়েছে দারুণ মিল। একদিন পিটারকে বললাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও সুরের কথা। সেতো মহা অবাক! তাকে আরো জানালাম, এ কিন্তু যে সে কবি নয়, একেবারে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কবি, বুঝেছ মশাই? এবারে সে ধরে বসল আমাকে সেসব গান গেয়ে শোনাতে। আমি যতই পিছলে যেতে চাই, পিটার আর তার দল ততই ধরে বসে। হেলেনাও ওদের দলে। সেও বারবার অনুরোধ করে গানগুলো গেয়ে শোনাতে। অবশেষে একদিন গাইলাম। গানের কথা হয়তো কিছুই তারা বুঝল না। কিন্তু সুর শুনে তো মহা অবাক! সবাই মাথা নেড়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করে, তাই তো, তোমাদের কবি দেখছি অত আগেই এত আন্তর্জাতিক ছিলেন! বারবার করে কবির নাম, সময়, পরিচয় সব জেনে নিলো। ওই ছোট্ট পাবে যারা রবীন্দ্রনাথের নাম কোনো দিনও শোনেনি, তারাও সেদিন আগ্রহ নিয়ে জেনেছিল তার নাম। এ যাত্রায় কবিগুরুর গান হলো খেয়া পারের তরণী।
গ্রীষ্মের বিকেল থেকে রাত অবধি ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়াই। আমি আর হেলেনা যে যার কাজ থেকে বেরিয়ে যেদিন যতটা মন চায় ঘোরাঘুরি করি। আমাদের দুজনার আস্তানা আবার দুদিকে। প্রায়ই মেইন স্ট্রিটের একটি নির্দিষ্ট কফি শপে মিলিত হয়ে বের হয়ে যাই। কখনো কখনো উইন্ড শপিং করি। রাস্তাঘাট চিনি। এদিক সেদিক চলে যাই। প্রায় রাত করে ঘরে ফিরি। একদিন বেশ রাতে আমরা ফেরার জন্য স্ট্রিটকার অর্থাৎ ট্রাম ধরলাম। সেদিন গানের একটা অনুভব জড়িয়ে ছিল খুব করে। হেলেনা একের পর এক যে গান মনে আসছে গেয়ে চলছে। স্ট্রিটকারে একেবারেই ভিড় নেই। অত রাতে না থাকারই কথা। প্রায় শুন্য ট্রামে সে গলা ছেড়ে গান ধরল, বাংলা সিনেমা ‘সারেং বৌ’এর জনপ্রিয় সেই গান- ওরে নীল দরিয়া আমার দে রে দে ছাড়িয়া…’। এটি সে প্রায়ই গায়। সদ্য সদ্য আমরা তখন দেশ ছেড়েছি এবং দুজনেই মা হারিয়েছি। এই গানের ঢেউ আমাদের মধ্যে একটা কষ্টভাব তৈরি করলো। ট্রামে কেউ নেই। একেবারে শেষে আমরা দুজন। এরপর সে রবীন্দ্রনাথকে ধরলো, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে…’। হেলেনা রবীন্দ্রসংগীতও পল্লীগীতি স্টাইলে গেয়ে থাকে। দেশ ছেড়ে এখানে এসে কাজকর্ম, জীবন যুদ্ধ সবই করছে। পরবর্তী সময়ে বিয়েও করেছে একজন আইরিশ বংশোদ্ভূত সাদা কানাডিয়ানকে। কিন্তু যখনই সে কোনো বাংলা গান ধরে, তা এক সময় কী করে যেন পল্লীগীতির দিকে মোড় নিয়ে নেয়। ওর মধ্যে মাটির গানের প্রভাব রয়ে গেছে। সেই সব ভাটিয়ালি সুর, যার মাঝে আছে স্রোতের টানে বয়ে চলা পাল তোলা নৌকার অলস ভাব, যা এখনো হেলেনাকে ধরে আছে। নিরন্তর সাঁতারের মাঝ দিয়ে দেশ থেকে পরদেশে চলে এসেও মাটির গানের সেই সুরকে সে ছাড়তে পারে না। সেদিন সে যে গানই গাচ্ছিল সবই এক সময় ভাটিয়ালি গানের সুর ও আঞ্চলিক উচ্চারণে ভরপুর হয়ে উঠছিল। যদিও সে বেশ দরদ দিয়ে গেয়ে যাচ্ছিল। ড্রাইভার হঠাৎ বলে উঠল, গান গাইলে নেমে গিয়ে গাও বাপু…! কাকে বললো? যাত্রী শুন্য ট্রামে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। বুঝলাম এটা আমাদের উদ্দেশে বলা হয়েছে। হেলেনা ও আমি তো অবাক! ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশে কারও স্বাধীনতায় যে এভাবে হস্তক্ষেপ করা হলো তা আমাদের মর্মাহত করলো। বাকি পথটুকু চুপ করে থেকে সাবওয়ে স্টেশনে নেমে পড়লাম। গরমের রাতে ঘরে ফিরতে ফিরতে আমরা দুজনই এই সিদ্ধান্তে আসি যে, স্ট্রিটকারের ড্রাইভারটি নিঃসন্দেহে একজন বর্ণবাদী। রেসিস্ট। তা না হলে এসব গানের মহিমা সে বুঝতো!
এখানে লোড শেডিংয়ের বালাই নেই বলে মাঝে মাঝে ভুলেই যাই যে, বাংলাদেশের নিষ্ঠুর গরমে প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকার লোড শেডিং আর প্রচণ্ড গরমে আধা সিদ্ধ হতে হতে বারান্দায় বসে, এবাড়ির দেয়াল বা ওবাড়ির কার্নিশের ফাঁক দিয়ে ঢাকার আকাশ দেখতে চেষ্টা করা। তারপর একসময় হঠাৎ করে আলো ফিরে আসায় মানুষের উল্লাস ধ্বনি সবকিছু ছাপিয়ে জানান দিয়ে যায়, অন্ধকার নয় আলোই কাম্য।
গ্রীষ্ম এলে বাংলাদেশে মৌসুমী ফল উপচেপড়ে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, আনারসে জোয়ার লেগে যায়। তার সঙ্গে মাছি বাবাজির ভন ভন দৌরাত্ম্যের কথা নাই বা বললাম। সে এখানেও আছে, ওড়াউড়িও করে। তবে পরিমাণে কম। এখানে সারা বছর নানা দেশ থেকে ফল আসে, তাই মৌসুমি ফলের আয়োজন নেই। সাউথ আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা ফল, শাক-সবজি সারাবছর একইভাবে পাওয়া যায় বলে নতুন কোনো ফল বা সবজি খাবার উত্তেজনা নেই। যেমন দেখেছি আমাদের ছেলেবেলায় গরমকালে ঝাঁকা ভরে নতুন আম আসতে। মা ডেকে ডেকে বলতেন, আয়রে খেয়ে যা, বছরের ফল…। তখন সব মায়েরাই বলতেন। এখনো কি বলেন?
সামার এসেছে বলে কত বেড়ানোর আয়োজন। স্কুল ছুটি। বেরিয়ে পড়ো দূর-দূরান্তে, দেশে-বিদেশে, পাহাড়ে-সমুদ্রে, বনে-জঙ্গলে, পথে-প্রন্তরে। এছাড়া তো সারাটা গরমকাল ধরে রয়েছে হাজারো রকমের উৎসব। ক্যারাবিয়ান কার্নিভেল ‘ক্যারাবানা’, খাবারের বৈচিত্র নিয়ে ‘টেস্ট অব ড্যানফোর্থ’, বিশাল কোনো মাঠে অথবা লেক অন্টারিওর সৈকতে ‘ফ্রি আউটডোর মুভি শো’, গে প্যারেড ও উৎসব ‘ওয়ার্ল্ড প্রাইড’, গান পাগলদের জন্য ‘জ্যায ফেস্টিভেল’, নাটক প্রিয়দের জন্য ‘শেকসপিয়ার ইন হাইপার্ক’। এছাড়া ‘সাউথ এশিয়ান ফেস্টিভেল’, ‘চায়না টাউন ফেস্টিভেল’, ইতালি, গ্রিক, ইউক্রেন, পোলিশ কেউই বাদ যায় না। উৎসবের জোয়ারে ভাসতে থাকা তিনটে মাস যেন এক ফুঁ-তে শেষ হয়ে যায়।
সেসব সামারে ঘুরে বেড়ানোর পর নতুন করে জেনেছিলাম, আমার সব ঠিকানা সব মুক্তি আত্মার গভীরে লেখা আছে, জেগে আছে। সেখানে শীত নয়, গ্রীষ্ম নয়, বর্ষা নয় কেবলই জেগে থাকে একটি ঋতু যার নাম, ভালোবাসা।
সকালে দুপুরে রাতে এখানকার মানুষ ভিড় জমায় কফি শপে। রেস্টুরেন্টের পেটিওতে বসে বিয়ার বা ভদকায় চুমুক দিয়ে গরমকালে আড্ডা দেওয়াটা এখানকার জনপ্রিয় ও মধুরতম আনন্দের একটি। এছাড়া ছুটির দিনে নিজের বাড়ির ব্যালকোনি বা ব্যাক-ইয়ার্ডে চিলড বিয়ারের সঙ্গে বার্বিকিউ মুরগির লোভনীয় স্বাদ নিতে নিতে, মনে হতেই পারে জীবনটা খুব একটা একঘেয়ে বা আনন্দহীন নয়। এসময় সবার চোখে মুখে রোদের ঝিলিক, চোখের তারায় বিদ্যুৎ। উজাড় করে চেটেপুটে তুলে নেয় গ্রীষ্মের সুখ। পার্কে পার্কে, সৈকতে সৈকতে মানুষের উন্মুক্ত উপচেপড়া, পাল্লা দিয়ে সামারের সন্ধানে ছুটে চলা। এ সবই শেষ করতে হয় তিনটে মাসের ভেতরে।
দেশে থাকতে শীতকাল এলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়া, বনভোজনে যাওয়া—এসব প্ল্যানগুলো করা হতো। এখানে ঠিক তার উলটো। সামার এলো—তাই চলো চলো বেরিয়ে পড়ি। হয় দূর কোনো কটেজে কিংবা পিকনিকে। এখন এই গরমে পিকনিকের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে অনেকে। বনভোজনের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। আর বাংলাদেশে শীতকাল মানে পিকনিক সিজন। কত বিপরীত, কত আলাদা!
এখানে তো মাঠে গিয়ে চুলো বানিয়ে চড়ুইভাতি হয় না। খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়ে চলে যায় দূরান্তে, কোনো লেক বা পার্কে। ওটাই পিকনিক। এই তো গত বছর সামারে আমাদের রিডিং গ্রুপ ‘বই-কফি-আড্ডা’র পক্ষ থেকে, সবাই মিলে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম এডোয়ার্ডস গার্ডেনস, মানে টরন্টোর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। সেখানে সারাদিন ফুল, জল, পাখি, সবুজ আর আকাশের নীলে ডুবে থাকলাম। কাঠের সাঁকো পার হয়ে রাজহাঁসের জলসাঁতার, ছোট্ট পাথুরে নদীর কলকল ধ্বনি আর ঝাউবনের শনশন শব্দ মিলেমিশে অন্য এক অর্থ তৈরি করলো। তারপর, উন্মুক্ত আকাশের নিচে গান, কবিতা ও কথোপকথনের বর্ণালি স্রোতে ভেসে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর একটি স্বর্গীয় গাছের নিচে সারাদিন ছায়ার সাথে কুড়ালাম পুষ্পবৃষ্টি ধারা। আমরা যে ছায়াময় গাছের নিচে চাদর বিছিয়ে ছিলাম। সেখানে সারাদিন ঝিরঝির করে কুচিকুচি ফুল ঝরল গায়ে মাথায়। এক স্বর্গীয় অনুভবে সাদা সাদা ফুলের বিছানা পাতা হলো যেন। মাথা তুলে গাছের দিকে তাকাতেই ফুলের বৃষ্টিতে ভিজে গেল শরীর। হালকা বাতাসে মৃদু সুবাস ছড়িয়ে অবিরাম ঝরে পড়া ‘চায়নিজ হেভেন’ ফুলের কথা এ জীবনে ভুলবো না কখনোই।
জীবনের শেষ পরিক্রমায় পৌঁছে রেশমী আমাকে দেখতে চেয়েছিল। ডেকে বলেছিল, আপু একবার আসো, আর তো কোনোদিনও বলব না! তাই দুবছর আগের সামারে ছুটে গিয়েছিলাম লন্ডনে। অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল সে। তার সঙ্গে দেখা করে বারবার মনে হয়েছে, এই যে চারদিকে এত আলো, এত আনন্দ, প্রিয়তম পুত্র, সংসার সবকিছু ফেলে মাত্র পঁত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সে কেন চলে যেতে হবে মেয়েটাকে? এর কোনো মানে হয়! হরেক রকমের রঙিন ফুলে সাজানো লন্ডন। আবহাওয়াও মনের মতো। সামার এসেছে বলে জীবনের আনন্দ উপচে পড়ছে চারদিকে। সেখানে একজন মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে অন্য রকমের এক যাত্রায়! অথচ বেঁচে থাকার জন্য তার কী প্রবল আকুতি। গ্রীষ্মের রঙ দিয়ে সে তার রঙহীন জীবনকে সাজাতে চেয়েছে, অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় অসংখ্য টবে নানা রঙের ফুল গাছ লাগিয়ে। ফুল ফুটেছে তাতে। খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে দেখালো সেসব। জানতাম এবার ফিরে গেলে আর কোনোদিনও দেখা হবে না, এটাই আমাদের শেষ দেখা। হয়তো তারও শেষ সামার। এত সুন্দর প্রকৃতি, বারবার ফিরে আসবে, শুধু রেশমীই আর থাকবে না। সে বছরের সামার আমাকে চিনিয়েছিল অপার বেদনার সঙ্গে জীবনের চূড়ান্ত ও নিষ্ঠুরতম চেহারাটি।
এই উজ্জ্বল সামার, উষ্ণ সামার, আলোকিত ঝলমলে সামার, সবকিছু ছেড়ে সে চলে গেল চির শীতের দেশে।
‘আকাঙ্ক্ষার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের অভ্রে ও আবীরে
আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের ভিতরের নীলে।স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর।’
[স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল/ পুর্ণেন্দু পত্রী]
তৃষিত মন নিয়ে বিভিন্ন সামারে ঘুরে বেড়িয়েছি ইউরোপ আমেরিকার পথে পথে। উড়োজাহাজ, রেলগাড়ি, বাসে চেপে কত না জনপদ দেখতে দেখতে গিয়েছি। কত না দেশের, কত না মানুষের, কত না ভাষার কাছাকাছি হয়েছি। আবারো চলে গেছি সব ফেলে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, কোথায় আমার প্রকৃত ঠিকানা? পৃথিবীর কোন মাটি প্রকৃত আমার? কিসেই বা মুক্তি? সেসব সামারে ঘুরে বেড়ানোর পর নতুন করে জেনেছিলাম, আমার সব ঠিকানা সব মুক্তি আত্মার গভীরে লেখা আছে, জেগে আছে। সেখানে শীত নয়, গ্রীষ্ম নয়, বর্ষা নয় কেবলই জেগে থাকে একটি ঋতু যার নাম, ভালোবাসা।