মিসেস সেন আমাদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ, এত জরুরি কেন? তিনি পর্দার নায়িকা, পর্দামানবী বলি তাকে। তিনি তিন যুগেরও বেশি কাল ছিলেন এক ধরনের নির্বাসনে, উল্টোকথায় তিনি আমাদেরই নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। যে সিনেমা তাকে অনন্য করেছে, কিংবদন্তীতুল্য মহিমা দিয়েছে, সেই সিনেমা, ক্যামেরা-অ্যাকশনকে তিনি গুডবাই বলেছেন সবল ইচ্ছায়। লাখ ভক্তের কাতর আবেদনেও তিনি অবগুণ্ঠন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেননি। তো এমন একজন দৃঢ়চেতা, কঠোর, ঘাড়বাঁকানো মানবীকে এত বেশি প্রয়োজন কেন আমাদের, আমাদের নারীদের? আর তিনি এ গ্রহ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে এত আয়োজনই বা কেন?
দুই.
মিসেস সেন, মানে সুচিত্রা সেন, মানে রমা সেন! কী দিয়েছেন আমাদের?
খুব স্বার্থমাখা এই প্রশ্ন। উত্তর নিশ্চয়ই আছে। একেকজন একেকরকম করে উত্তর দেবেন, বিশ্লেষণ করবেন। তবে আমার এখন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে মিস্টার কুমার, মানে উত্তম কুমারকে। তাকে কাছে পেলে, জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা যেত সুচিত্রা সেন বাঙালির এত মাখোমাখো আত্মীয় কেন? সুচিত্রা নিয়ে উত্তমের বেদনাটাও নিশ্চয় ফুটে উঠত তখন। কিন্তু হতাশার জায়গা হলো, ভদ্রলোক উত্তম কুমার অনেক আগেই টা টা বলে দিয়েছেন এই ধরণীকে। সুচিত্রা সেনের দুই-একজন নায়ক এখনো সপ্রাণ, তাদের মধ্যে বিশেষ, সবিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ক’জন নায়িকাও আছেন যারা সেসময়ে অন্যরকম দাপট নিয়ে কাজ করেছেন। তারা তাদের মতো করে বলছেন, স্মৃতিচারণ করছেন সুচিত্রাকে নিয়ে। মিডিয়ার ঝাঁকাঝাঁকিতে সেসব সবার জানা। উত্তম কুমার বেঁচে থাকলেই কেবল ঘটনা হতো অন্যরকম।
আমার খুব মিষ্টিভাগ্য যে, খুব কৈশোরে উত্তম কুমার নামের ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যায়। তখনো এদেশের পোড়খাওয়া সব মধ্যবিত্তের ঘরে রঙিন টেলিভিশন প্রবেশ করেনি, আবার সাদাকালোটি ঘরে আনার সাধ্য ছিল না সবার। সীমিত পরিসরের মধ্যেই কী করে যেন টিভির নাগাল ঘটে যায় আমার জীবনে। আর বিগত শতাব্দীর আটের দশকের মাঝামাঝি এক দুপুরে বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখিয়ে দেয় সুচিত্রা সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’। তখন ঢাকাই ফ্যান্টাসি সিনেমার বিপরীতে জগতে এমন নিটোল, ছন্দময় বাংলা ছবি হতে পারে, এটা না দেখলে বোঝাই যেত না। দীপ জ্বেলে যাই-তে সুচিত্রার সঙ্গে নায়ক ছিলেন বসন্ত চৌধুরী। এ ঘটনার খুব কাছাকাছি, সেসময়ে গুলশান-১-এ জ্যোতি নামে একটা সিনেমা হল ছিল। কোনও এক মানবীর হাত ধরে এক বিকেলে আমি সেই হলে গিয়ে দেখি উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের ‘শাপমোচন’। সেই থেকে সুচিত্রাপ্রেম শুরু। তারপর কতবার ঘুরে ফিরে ছোট পর্দায়, বড়পর্দায়, উত্তম-সুচিত্রা। সাদা-কালো, তবু কত আবেদনময়। এখনো স্যাটেলাইন টেলিভিশনের সম্প্রসারণ আর আগ্রাসন সময়ে রিমোটের বাটন আপ-ডাউন করতে করতে সাদা-কালো কোনো দৃশ্য এলেই চোখ আটকে যায়। প্রশান্ত মন খুঁজতে থাকে কিছু একটা। টেলিভিশনের দৌলতে উত্তম-সুচিত্রার প্রায় সব সিনেমাই দেখা হয়ে গেছে কয়েকবার করে। বাদ যায়নি সেসময়ে অন্যদের সিনেমাও। তারপরও পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা, সুচিত্রা-উত্তম ভেসে উঠলেই অন্যরকম মনোযোগ কেড়ে নেয়।
তিন.
কেন? নস্টালজিয়া? না, কেবলি নস্টালজিয়া নয়। অতীতের জন্য হাহাকার মানুষের আজন্ম লালিত এক অনুষঙ্গ। কিন্তু এখানে বিষয়টা এমন নয়। আমি নিজে মানি, এবং প্রতিটি বাঙালিকে বলি পরিশীলিত মানুষ হওয়ার জন্য, বাঙালি হওয়ার জন্য উত্তম-সুচিত্রার সিনেমাগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই মানুষ দুটি পর্দার বাইরে কেমন ছিলেন তা জানার খুব বেশি প্রয়োজন নেই, পর্দায়, রূপালি পর্দায় তারা অপার ব্যক্তিত্বময় মানুষ। নারীকে, প্রেমিকাকে কী করে সম্মান দিতে হয়, নারীর সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, একজন মানুষ কিভাবে ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে, উত্তম কুমার তার চলমান উদাহরণ। আর সুচিত্রা, একটি বারের জন্যও নারীত্বের সম্মান বিসর্জন দেননি। কোনো দৃশ্যে তাকে মনে হয়নি ম্লান। হয়ত, তার সময়ে, তারচেয়ে অনেক প্রতিভাবান অভিনয় শিল্পী ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন অনন্য। ভারত বর্ষের শিক্ষিত-মার্জিত, রুচিশীল বাঙালি নারীরা সুচিত্রাকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর হাঁটেনি নি সুচিত্রা, কিন্তু পর্দায় তিনি ছাড়িয়ে গেছেন তার সব সীমাবদ্ধতাকে। একেকটা চরিত্রে তিনি নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন একদম নতুন করে। তাই নারীরা তাকে মনে রেখেছে তাদের নিজস্ব দায় থেকে, পুরুষরা তাকে মনে রেখছে কাঙ্ক্ষিত মানবী হিসেবে। এই দায়, এই মনে রাখারাখি কতদিন অব্যাহত থাকবে তা হয়ত এখনি হিসাব কষে বলে দেওয়া যাবে না, কিন্তু সভ্যতার নামে, সংস্কৃতির নামে, সৃষ্টিশীলতার নামে, সৌন্দর্যের নামে পৃথিবীময় অনেক কিছু অনেক দিন থেকে যায়। এমনি এমনি তো আর ক্ল্যাসিক শব্দটি ধরে আনা হয়নি মানুষের জন্য। সুচিত্রাকে আমি সেই ক্ল্যাসিক বাঙালি, ধ্রুপদী মানবী বলেই মানি। পর্দায় এবং জীবনের শেষ অঙ্কে তিনি সেই ক্ল্যাসিক মোহময়তাকে বিসর্জন দেননি। তাইতো তার চলে যাওয়ার দৃশ্যটাও ছিল ক্ল্যাসিক।
চার.
এই মানবীকে নিয়ে আমার আপাত শেষ চিন্তা, কথা হলো- সুচিত্রা সেনের জীবন থেকে বাঙালি নারীর অনেক কিছুর শেখার আছে, নেওয়ার আছে। আর বাঙালি পুরুষের চাওয়ার আছে বিস্তর।