২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ক্রিস্টমাসের ছুটির আবহ ছিল শৈত্য প্রবাহের মতো সর্বত্র বিরাজিত।
বিজয়ের উল্লাস ও শীতের কনকনে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ঘন-কুয়াশায় মাখামাখি বিকেল। ইতিহাস ও ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী সংগঠন কবিতা পরিষদের উদ্যোগে মহাসমারোহে পালিত হলোকবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের ৮০তম জন্মদিন। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ জাদুঘরের প্রধান ফটকের সম্মুখ ভাগ আটকে দিয়ে দৃষ্টিনন্দন একটি কাব্যিক মঞ্চ রচিত হয়েছিল কবিতা পরিষদের সম্পাদক ও কবি তারিক সুজাতের পরিকল্পনায়।
বাংলা কবিতার শিল্পীরা বিভিন্ন শাখার উল্লেখযোগ্য লেখক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রথিতযশা ব্যক্তিদের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন সেই জন্মোৎসবে। এর ক’দিন আগেই সন্তানদের প্রবাসজীবন সচক্ষে দেখে-শুনে, ঘুরে-বেড়িয়ে কবি রফিক আজাদ ও আমি দেশে ফিরেছি।
সেদিনের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ কবি সৈয়দ শামসুল হক, তার সঙ্গে রফিক আজাদ, কবি রবিউল হুসাইন ও কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. সামাদসহ মঞ্চ আলোকিত করে বসেছেন সবাই। ধূসর মেঘলা অপরাহ্ন, জমিয়ে শীত জেঁকে বসে আছে আমাদের ঘিরে।
অর্ডিয়েন্সের প্রথম সারিতে আমার একপাশে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, আজ তার প্রেমিক স্বামীর জন্মোৎসব, তিনিও নক্ষত্র আলোয় সমুজ্জ্বল ভীষণ। অন্য পাশে কবি কামাল চৌধুরী, কবি মোহাম্মদ সাদিক, নবীন প্রবীণ সবাই সেদিন এক কাতারে আমরা উৎযাপন করছি আমাদেরই অগ্রজ, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান একজন সব্যসাচী কবি ও লেখকের জন্মদিন। আহা, জন্মদিন, যা মৃত্যুরই নামান্তর। তবু সেদিন আমরা কবিতাপ্রেমী সবাই যেন খণ্ড-খণ্ড আলোর ফোয়ারা জ্বেলে প্রত্নতাত্ত্বিক চত্বরসহ শাহবাগের পথ-সড়ক জীবন্ত করে তুলেছিলাম।
জন্মদিন মানেই সমুখে ঘোর অন্ধকার, যদিও নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে যেতে নেই মানা, তবু প্রতিটি জন্মদিন ভরে ওঠে অতীতের কিছু উজ্জ্বল রঙে ও রূপায়ণে। অন্তহীন এক যাত্রাপথের কথা ফিসফিস করে কেউ বলে যায় কানে কানে। অতীতের যা কিছু, সব যেন মুহূর্তেই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে সর্বনামের লাবণ্যে। কবি ও কবিতার কৃতি সম্ভাষণে কবি নতুন করে জেগে ওঠেন তার জন্মদিনে।
খোলা উঠানের গাছের তলায় পুষ্পবেদীতে বসে ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল হক ভাই, বিষণ্ন ফ্রেমের মধ্যে বন্দি কবি।
রফিক আজাদের শরীর ভালো ছিল না সেদিন, তবু চমৎকার বক্তব্য রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার শারীরিক নানা অসুস্থতা সত্ত্বেও হক ভাইয়ের কবিতা পড়ার জন্যে আমি আরও কিছুকাল বেঁচে থাকতে চাই। আহা, কবির আকাঙ্ক্ষা তো এমনই নিরাভরণ হওয়ার কথা। বেঁচে থাকার আসক্তি কেবল কবিতায় নয়, অসামান্য জীবনটাতেও। সুধী সমাবেশে, জনসমুখে সেটি ছিল রফিক আজাদের সর্বশেষ ভাষণ।
অনুরূপভাবে ২০১৬ সালে ১৬ মার্চ রফিক আজাদের প্রয়াণের পরে কবি ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রফিক আজাদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন করে সৈয়দ শামসুল হক সর্বশেষ ভাষণটি দিয়েছিলেন দেশবাসীর উদ্দেশে। কবি সৈয়দ শামসুল হক, যাকে আমরা হকভাই বলে সম্বোধন করতাম সব সময়ে। বিশেষভাবে তিনি ছিলেন আমার ও রফিক আজাদের অভিভাবকতুল্য অগ্রজ কবিদের মধ্যে অন্যতম একশুভাকাঙ্ক্ষী, সুহৃদ।
সেদিন তিনি মর্মস্পর্শী অনন্য এক লিখিত ভাষণ দিয়েছিলেন তার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে।‘দৃষ্টিভূমিতে দীর্ঘ ছায়া’ নামের ভাষণটি মুদ্রিত ফর্মে বিতরণ করা হয়েছিল উপস্থিত দর্শকদের হাতে। পুরো ভাষণটি হকভাই সেদিন তার জীবন আলেখ্য হিসেবে অত্যন্ত নির্মোহ ও দরাজকণ্ঠে পাঠ করেছিলেন ঘণ্টাখানেক সময়ব্যেপে। পিনপতন নীরবতায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি সবাই। সেদিন তার উচ্চারণে ছিল কিছু ব্রহ্ম বাক্য, আরও ছিল জগত-জীবন-শিল্প-দর্শন নিয়ে নতুন চিন্তা-চেতনা এবং প্রজ্ঞার প্রক্ষেপণ।
শিল্পের পথ ও পাঠ নিয়েও চিরন্তন ও অনিঃশেষ কিছু বার্তা রেখে গেছেন সেখানে তিনি, নির্মোহচিত্তে যা বার বার পাঠেও শেষ হয় না, পুনরায় তা নতুনভাবে পাঠে অনুপ্রাণিত ও জাগ্রত করে পাঠককে। এভাবেই একজন কবি বা শিল্পী চিরকালের হয়ে ওঠেন। একথা সবাই জানি, পৃথিবীর ৮০টি রঙিন বসন্ত তিনি কাটিয়েছেন, মানুষের হৃদয়ের গোপন-অগোপন ভালোবাসায় স্নাত হয়ে, বিপুল গৌরবে।
সব্যসাচী কবি,লেখক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, অনুবাদক শিল্পের বিভিন্ন শাখায় তার নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হয়ে আছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মতোই যিনি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেতে-খামারে কাজ করেছেন। তিনি অক্ষরকৃষক কবি সৈয়দ শামসুল হক।
২৭ ডিসেম্বর তার ৮৪তম জন্মদিন। ২০১৮ সালে কবির গুলশানের বাড়িতে আনোয়ারা সৈয়দ হক, তাদের পুত্র-কন্যা দ্বিতীয় সৈয়দ হক ও বিদিতা সৈয়দ হককে নিয়ে স্বউদ্যোগে পালন করেছিলেন কবির ভিন্নমাত্রার এক জন্মোৎসব। খোলা উঠানের গাছের তলায় পুষ্পবেদীতে বসে ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল হক ভাই, বিষণ্ন ফ্রেমের মধ্যে বন্দি কবি।
তার প্রয়াণের পরে এটি ছিল কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে আনোয়ারা ভাবির একাকী আয়োজন। ভাবীকে নিয়েই উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, ছিলেন কবি রবিউল হুসাইন, দুজনের কেউ আজ আর নেই আমাদের মধ্যে। এসেছিলেন হাসনাত আবদুল হাই, কবি মাহবুব তালুকদার, নাট্যকার আতাউর রহমান, কবি জাহিদুল হক, ড. সামাদ, তারিক সুজাত, আসলাম সানী, রহিমা আখতার কল্পনা, লিলি হকসহ অনেকেই। কবিপুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক চমৎকার সঞ্চালনায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন অনুষ্ঠানের এক ভিন্ন মহিমা।
শীতকালের চিতই, ভাপা পিঠে, জিলেপির সঙ্গে চা কফি দিয়ে সবাইকে ভাবি আপ্যায়ন করেছিলেন। একবারও মনে হয়নি হক ভাই নেই। অবিনশ্বর কবি না থেকে কি পারেন? আনোয়ারা ভাবি সারাক্ষণ বিষণ্নতায় ছিলেন অবনতমুখী। হক ভাই এমন একটি মাসে জন্মেছিলেন যে, বিজয়ের মাস হিসেবে প্রতিটি মুহূর্তই সতত আনন্দে-ব্যাকুল।
‘আমার পরিচয়’ কবিতাটির মধ্যে দিয়ে বাঙালি তার জাতিসত্তার মূল উৎসের সূত্রখুঁজে পেয়েছে। এই কবিতাটিও মহৎ শিল্পের উদাহরণ।
জন্মেছিলেন তিনি মহান বিজয়ের এই মাসের সাতাশ তারিখে, সেদিন রমজানেও ছিল সাতাশ, চলে গেলেন, সেও সাতাশ। যে জীবন তিনি কাটিয়েছেন এই পৃথিবীতে যতদিন ছিলেন বয়সের সাতাশেই বর্তমান ছিলেন সর্বতোভাবে, হৃদয়ে ও মননে। ‘পরানের গহীন ভিতরে’ অনুক্ষণ অনুভব করেছেন এক অলৌকিক রুমালের ওড়াউড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন অনুভব করেছেন, নিরুদ্দেশ যাত্রার এক সুন্দরীকে, কাব্যযাত্রা পথে যিনি তার জীবনদেবতা। তার উদ্দেশে বলেছেন,
আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে,
হে সুন্দরী
বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।
নিরাভরণ কলমীদামের মতো একটি নরম ভাষায় কথা বলে যে জেলার মাটি ও মানুষেরা, বৃহত্তর সেই রংপুরের কুড়িগ্রাম জেলার ভাষিক প্রতিনিধি ছিলেন হক ভাই। এমন একটি স্বাদু ভাষায় তিনিও খুঁজেছেন সেই সুন্দরীকে, দূর থেকে যে সতত রুমাল নেড়ে প্রেরণায় ডাকে, কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ঐশ্বর্যময় কালজয়ী পঙ্ক্তিমালা। শ্রুতিভাষ্যে ‘পরাণের গহীন ভেতর’ থেকে উঠে আসে সেই মর্মরিত ধ্বনি:
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।
একটি আঞ্চলিক ভাষাকে ছুঁয়ে-ছেনে তাকে সাহিত্যিক ভাষার অপূর্ব রসমূর্তি দান করেছেন এই কবি। মায়ের মুখ থেকে বুলি কেড়ে নিয়ে, মা ও মাটির প্রতি, ভাষার প্রতি এই যে তার উন্মুখ ভালোবাসা, তা আমাদের সবার জন্যে অনুকরণীয় এক পথ-উন্মোচনরেখা। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, অনুবাদ, গান—প্রত্যেক শাখায় তিনি অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত তার কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এ ভাব-ভাষা ও প্রকরণে মা ও মাটির স্বাধীনতার প্রশ্নে তৎকালীন ঘটনা পরম্পরা জনচিত্তের ভালোবাসা ও ঘৃণার যে সুতীব্র ভাষাচিত্র নির্মাণ করেছেন, শৈল্পিক বিবেচনায় তা তুলনারহিত।
বলা যায়, মহৎ সাহিত্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলাদেশের কাব্য নাটকের ইতিহাসে অন্যতম সংযোজন। হয়ে উঠেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অমর অভিজ্ঞান। একইভাবে রংপুরের ভাষায় রচিত ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। সৈয়দ হক তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ, মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতির ইতি ও নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরেছেন সুকৌশলে, নুরলদীনের সারাজীবন—এ,
যখন আমার দেশ ঢেকে যায়
দালালেরই আলখাল্লায়
নুরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়…
জাগো বাহে কুনঠে সবায়।
তার নাটক ‘নারীগণ’, ‘যুদ্ধ এবং যোদ্ধা’, ‘ঈর্ষা’য় সমকালীন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।
সৈয়দ হকের কবিতার দীপ্তি সতত অমলিন, আমি তার বিমুগ্ধ পাঠক। তার কবিতায় রয়েছে জীবনের গভীর অনুধ্যান- অনুপ্রেরণা। যা পাঠ করলে নতুন কবিতা লিখতে কবিকে উৎসাহিত করে। তিনি ছিলেন যত না জনচিত্তের, তার চেয়ে অধিকতর কবিদের কবি হিসেবে প্রণম্য প্রথম।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পরে বৈশাখে রচিত ‘পঙ্ক্তিমালা’, ‘পরাণের গহীনভেতর’, ‘নাভিমূলে ভস্মাধার’, ‘বৃষ্টি ও জলের কবিতা’ পাঠকমহলে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে এক আলাদা কণ্ঠস্বরের জাতক হিসেবে। বিশেষভাবে ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটির মধ্যে দিয়ে বাঙালি তার জাতিসত্তার মূল উৎসের সূত্রখুঁজে পেয়েছে। এই কবিতাটিও মহৎ শিল্পের উদাহরণ। এর কয়েকটি চরণ উল্লেখ করছি।
জন্মেছি বাংলা
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদী থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
লক্ষণীয় যে, কবির প্রয়াণের পরেই সর্বত্র বিশেষভাবে স্কুল কলেজে আবৃত্তির মাধ্যমে কবিতাটি অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়। ভাষাশিল্পী হিসেবে গদ্যে শুরু হলেও উপসংহার টেনেছেন ‘কবিতায়’।
কবিতার সৃষ্টি রহস্যেও ভাবিত ছিলেন তিনি, নিরন্তর খনন করেছেন নিজের অন্তরাত্মা। আপন শিল্প-সম্ভার খুঁড়ে পরিমাপ করেছেন আধার ও আধেয়ের সম্পর্ক। সেই সূত্রেই কাব্যতত্ত্ব ব্যাখ্যায় শিল্পের স্বরূপ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। অসাধারণ কাব্যময় গদ্যে রচিত হয়েছে দুটি গ্রন্থ,’মার্জিনে মন্তব্য’এবং ‘গল্পের কলকব্জা’।
মার্জিনে মন্তব্যের এক জায়গায় বলেছেন তিনি, ‘শিল্পের গাড়ি নিছক প্রেরণার চাকায় চলে না। তিনি গায়ক হোন, লেখক হোন কি চিত্রকর, তার ভেতরে নিদ্রাহীন দুই পুরুষ–প্রতিভাবান শিল্পী আর নিপুণ মিস্তিরি। মিস্তিরির দিকটা বুদ্ধিনির্ভর, আর শিল্পীর দিক দৃষ্টিনির্ভর। দৃষ্টি আর বুদ্ধি, এ দু’য়ের রসায়নে হয় একটি ছবির জন্ম, কি একটি কবিতার। দৃষ্টি দিয়ে যা আয়ত্ত করলাম বুদ্ধি দিয়ে তা পৌঁছে দিলাম।’ এই ভাষাশিল্পী মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।
সৈয়দ হকের ক্যান্সার ধরা পড়লো ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে। হাসপাতালে ভর্তি হলেন সেই সময়ে। মৃত্যু অথবা নিরাময়ের জন্যে চিন্তিত না হয়ে তিনি জীবনের শেষ দিনলিপি লিখতে উৎসাহিত করলেন আনোয়ারা সৈয়দ হককে। নতুন করে বলে গেলেন জীবনের আদ্যোপান্ত। একুশে পদক প্রাপ্ত তার পার্শ্বসহচরীও আসন্ন মৃত্যুর ভয়াবহ অন্ধকারময় জমাট সময়কে পাত্তা না দিয়ে শিল্পীর নির্মোহতায় কবির হয়ে নোট নিলেন, লিখে গেলেন কবির রোজনামচা, নাম দিলেন ‘বাসিত জীবন’। ধারণা করি, গভীর অনুধ্যানে আনোয়ারা সৈয়দ হক গ্রন্থটিকে রচনা করেছেন দু’জনের ভালোবাসার এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞান হিসেবে।
কিভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সব্যসাচী কবি লেখক সৈয়দ শামসুল হক? পিতা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিও ডাক্তার। মা হালিমা খাতুন গৃহিণী। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠ। মাতৃগর্ভ থেকে স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মেছিলেন বলে নানা রকম অসুখে ভুগেছেন প্রায়। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। এরপর ভর্তি হয়েছেন কুড়িগ্রাম ইংলিশ হাইস্কুলে।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সৈয়দ হক। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু তিনি বাবার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে বছরখানেকের বেশি সময় একটি সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সনে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়। ভাষাশিল্পী হিসেবে গদ্যে শুরু হলেও উপসংহার টেনেছেন ‘কবিতায়’।