তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।
আমার ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো কবিতা সফল হয়নি,
আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি
ভালোবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।
(ভালোবাসার কবিতা লিখব না)
এই অসামান্য পঙ্ক্তিগুলো ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানের; ‘ভালোবাসা’ আর ‘হাহাকার’ যার কাছে একই জীবনের যুগল উৎসারণ। কারণ কবি যুগসন্ধির সাহিত্যিক ফসল। ১৯৭১ বাংলাদেশের জন্য যুগান্তর বা যুগসন্ধি যদি হয়, তাহলে এই সন্ধিকালের আগের ও পরের সময় নিঃসন্দেহে ক্রান্তিকাল। স্বাধীনতা পাওয়ার আগে ক্রান্তিকালের চরিত্র এক ধরনের; পরে তার প্রকৃতি অন্য ধরনের। এই উভয় সময়ের সাহিত্য ক্রান্তিকালের সাহিত্য। কারণ এই সাহিত্য প্রবলভাবে কালাক্রান্ত ও কাল-উৎসারিত। এমন হওয়াই সাহিত্যের ধর্ম। সেদিক থেকে কবিতা আরও বেশি সময়জর্জর। আবুল হাসানের সমস্ত কবিতা একাত্তরের পূর্বাপর কালাধারে লিপ্ত ও দীপ্ত। যদিও তাঁর তিনটি কাব্য ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করো’ ও ‘পৃথক পালঙ্ক’ প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে; যথাক্রমে ১৯৭২,৭৪ ও ৭৫ সালে। সময়, সমাজ ও জীবন—এই তিন মৌল ভিত্তিতে কবি এতটাই তীব্র, দীপ্ত ও আক্রান্ত যে, পূর্বাপর কোনো সময়েই কবি সন্তুষ্ট, তৃপ্ত বা আনন্দিত হতে পারেননি। তাঁর চরম প্রেমের কবিতা সামাজিক সুরে বাঁধা, সমাজের চরম ক্ষতচিহ্ন মাখা, দগদগে ঘায়ে লিপ্ত।
প্রকৃত অর্থে, আবুল হাসান বাহাত্তর থেকে পচাত্তরের দুঃসময়, দুঃশাসন, অবাধ অপরাধ, অস্থিরতা-বিশৃঙ্খলা ও দুর্ভিক্ষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন। মনে প্রেমের স্বপ্ন-সাধ, কিন্তু বাইরে মরণের ফাঁদ। তাই কবি গরলে জর্জর হয়ে ‘স্বর্পচূড়ায়’ আশ্রয় গড়ে তোলেন—
দেখা হলো যদি আমাদের দুর্দিনে
আমি চুম্বনে চাইবো না অমরতা
আমাদের প্রেম হোক বিষে জর্জর
সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।
(যুগলসন্ধি)
কবি দুর্ভিক্ষের দহনে ও মারীর প্রকোপে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হারিয়ে বিপন্ন। তাই বিপন্ন প্রেমের পঙ্ক্তি রচনা করে কবি প্রেমকে বিষ পেয়ালায় ঢেলেছেন ও পান করেছেন। তাঁর প্রেমের কবিতা তাই আলাদা হয়ে যায় অন্যদের কাছ থেকে। কবি বৃক্ষ হয়ে সহ্য করেন ‘অনাবৃষ্টি, ক্ষণমৃত্যু, বৈশাখের বিলোল দহন’। সমাজ থেকে উত্থিত বিষ কবিহৃদয় থেকে কবির কবিতায় প্রবাহিত। এই অবস্থায় কবি ফুলকে ফুটতে নিষেধ করেন—
বাইরে তুমি বিকশিত হয়ো না কুসুম, রুগ্ন ব্যথিত কুসুম
তার চেয়ে গভীর গভীরতরো আড়ালে লুকিয়ে যাও।
(তুমি রুগ্ন ব্যথিত কুসুম)
কবি আসলে বিশুদ্ধ ভালোবাসার প্রত্যাশী; ভয়-দ্বিধা-বাধাহীন প্রেমের প্রার্থী; কিন্তু চরম দুঃসময় এই পথে কাঁটা চারিয়ে দিয়েছে। সমাজ বাস্তবতার চরম অবস্থায়ও কবি প্রেমিককে ভুলতে পারেননি; তার মঙ্গল কামনায় উদগ্রিব ও কুশল জিজ্ঞাসায় উদ্বিগ্ন।
বাইরে বিবস্ত্র যুগ, হাহাকার, বাইরে তমসা
বাইরে বাগানে ওরা বসে আছে গোলাপের নামে সব অবগোলাপের দল!
—মুহূর্তে কোথাও যেন খুলে গেলো খুনের দরোজা;
তুমি ভালো আছ?
(তুমি ভালো আছ)
কালাক্রান্ত কবি না যুগ না প্রেমিকা—কাউকেই সুস্থ অবস্থায় পাননি— অসহায় বিপন্ন ব্যথিত কবিপুরুষ হয়ে অর্ন্তগত দুঃখ সয়েছেন। বাংলাদেশের কবিতায় আবুল হাসান সামগ্রিকভাবে নতুন কণ্ঠস্বর আর তাঁর প্রেমের কবিতাও স্বতন্ত্র মেজাজের। কেননা কবি আনন্দময় প্রেমের মাঝে আত্মগত দুঃখ অনুভব করেন। কবি প্রতিটি ‘নতুন কথা’কে প্রেম হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে এই অভিধায় কবি স্থির থাকেননি; বারবার ভায়োলিনের করুণ-মধুর সুর সৃষ্টি করেন। এই সুরের সৃষ্টি মূলত দেশকালের অন্যায়, বৈষম্য ও বঞ্চনার বাস্তবতা থেকে। এই বাস্তবতা গ্রাস করে নিয়েছে কবির ব্যক্তিগত প্রেম ও প্রেমের সম্পদ। তাই তো কবি প্রেমিকার উঠোনে এসেও অনুভব করেন—
আর আমি পড়ে থাকি একা দ্রবীভূত আত্মার কানন,
আমাকে দেখে না কেউ: না পুষ্প, না ফলশ্রুতি- অদৃশ্য হাওয়ার
স্বেচ্ছাচার ধীরে ধীরে গিলে খায়- নিয়তিও আমাকে অস্থির
বধির বিনাশে রেখে ধাবমান, দ্যাখো ঐ, ঐ ধাবমান!
(ভালোবাসা)
কবি ভালোবাসায় নিবিষ্ট থেকেও খণ্ড খণ্ড হয়ে যান, চঞ্চল ও ধাবমান হতে থাকেন ‘বধির বিনাশে’ রূপান্তর হয়ে। এই দুঃখবোধ আবুল হাসানের কবিতার জমিনে ধানের চারার মতো তরঙ্গিত— সেখান থেকে প্রেমের যে শস্য উৎপন্ন হয়, তা সুস্বাদু বা পুষ্টিকর নয়, বরং নিমফলের মতো। তাই প্রেমিকার প্রতি আস্থার পরিবর্তে প্রশ্নের দোলাচল প্রকাশ করেন—
আমি বকুলবৃক্ষকে বোকা খুনির ঘরের পাশে
কখনো যেমন আর বকুল বলি না, বলি তার আচ্ছাদন
তার হত্যার হরিৎ পটভূমি।
যেমন যৌবন আজ যন্ত্রণায় আমার মনন বোধে, আমাকে খরচ করে
শেষকালে তৃপ্ত হয় আমারই মজ্জায়! … আজ তুমিও কি তাই?
(দ্বৈতদ্বন্দ্ব)
সময়ের অবক্ষয় কবির যৌবন, মনন ও সামর্থ্যকে ক্ষয় ও নিঃশেষ করে ছাড়ে, নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় করে পথে বসায়। ফলে প্রিয়-কাঙ্ক্ষিত নারীকে পর্যন্ত কবি স্পর্শ করতে পারে না। নিয়তি তাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এনে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে। তাই কবি নিরন্তর প্রবহমান অন্তর্গত রোদনকে সাফ জানিয়ে দেয়: ‘আমি আর কাঁদতে পারব না’।
তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা ও নগরায়ণের কুফল হলো মানুষের সংঘ ও সমাজকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের চিরকালীন প্রবণতা হারিয়ে যায় এই নগর সভ্যতা ও নাগরিক সংস্কৃতি প্রবর্তনের মাধ্যমে। আবুল হাসান নগরের নেতিবাচক আবহাওয়ায় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং কবিতায় তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রবল প্রেমের কবিতায় এই বিচ্ছিনতা বোধ আন্দোলিত গোপন ব্যথার মর্মরে—
দু’জনের ঠোঁটে দূরের কুজন, হাওয়া শনশন চুম্বন গড়ে তুলি!
একাকী থেকেও এখন আমরা এসো দু’জনের মুগ্ধতা আনি মুখে
কপালে কাঁপাই ভ্রুযুগল অনুভূতি।
(জোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন)
এই একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা কবিকে প্রেমিকার কাছে থাকতে দিচ্ছে না বা কবি তার সাহচার্য পাচ্ছে না। তবুও কবির মাঝে প্রেমের অনুভব অত্যন্ত তীব্র ও গভীর: ‘আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও/ হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও’। কবি কোনোদিন প্রেমের কবিতা লিখতে চান না প্রিয়তমাকে প্রাণপণ ভালোবাসেন বলে। অন্যদিকে কবি একা ও দূরে থাকলেও, হৃদয়ে হাহাকার বেজে উঠলেও কবির অন্তরে ভালোবাসা সুগভীর, অকৃত্রিম ও দিগন্তবিস্তারি।
আবুল হাসান যেহেতু সময়ের সাহসী কবি, সেহেতু তাঁর মাঝে সময়ের বুদবুদ গুঞ্জরিত। হাসানের কবি হয়ে ওঠার সময়টি নিঃসন্দেহে দুঃসময়। এই দুঃসময়ে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে কবি ব্যর্থতা ও হতাশায় নিমজ্জিত। নিমজ্জমান মানুষের কাছে মৃত্যুচেতনা প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল। তাই মৃত্যু ও প্রেম সমান্তরাল গতিতে ধাবমান হয়েছে তাঁর কবিতায়।
শহরে আজকাল শুনি দুর্ঘটনার কথা আত্মহত্যা গেছে বেড়ে;
সবাই আমরা আজ সভ্যতার সচ্ছল শিকার।
হতে পারে তুমি একটি নির্জন স্ট্রিটে
এক গাছের তলায় প’ড়ে আছো মৃত
… তোমার মৃত্যুর জন্য আমি কি তখন নিজেকেই দায়ী করব,
নাকি সভ্যতাকে?
(তোমার মৃত্যুর জন্য)
কবি প্রেম ও বাস্তবতার দ্বৈরথে ধাবমান হয়ে কালিক ও নাগরিক ব্যাধির বাস্তবতায় বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। তাই প্রেমের জন্য হাহাকার, প্রেমিকার জন্য রোদন, জীবনের বদলে মৃত্যুর হাতছানি কবিকে ছিন্নমূলে পরিণত করেছে। মৃত্যুবোধ তাই রক্ত গোলাপ হয়ে কবির হাতে ফুটে আছে। সব মিলিয়ে আবুল হাসান মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বের রক্তাক্ত হৃদয়ের সাহসী কণ্ঠস্বর। তাঁর কাব্যভাষা ও কাব্যশৈলী নতুন ও স্বকীয়—কেননা তিনি নতুন কালের নতুন জীবনের কবি। প্রেমের নতুন পদাবলীর স্রষ্টা; সঙ্গে সঙ্গে নগর সভ্যতার ব্যথিত প্রেমের শিকার।