তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা লন্ডনে। ১৯৯২ সালের জুলাই মাসের এক দুপুরে। আমি তখন নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে গিয়েছি। আমার ভ্রমণসূচির মাঝে অন্যতম ছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করা। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-গানটি যখন প্রভাতফেরিতে গাইতাম, তখন একটিই স্বপ্ন ছিল, এই গানটির রচয়িতার সঙ্গে আমার দেখা হবে কবে! আদৌ দেখা হবে কি!
তিনি আবদুল গাফফার চৌধুরী। আমাদের সবার খুব প্রিয়, শ্রদ্ধেয় গাফফার ভাই। মনে পড়ছে, আমি তখন বিলাতের বাংলা কাগজগুলোতে দু’হাতে লিখছি। সেই সুবাদে আমার একটু পরিচিতি তৈরি হয়েছে যুক্তরাজ্যে। আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছি,এই সংবাদ বিলাতের সাংবাদিক বন্ধুরা তাদের কাগজগুলোতে ফলাও করে ছেপেছেন। আমি লন্ডন পৌঁছার কয়েকদিনের মধ্যেই সাপ্তাহিক সুরমার তৎকালীন সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন আমাকে জানিয়ে দিলেন-আমাকে নিয়ে তাঁরা আড্ডা দিতে চান। সেই আড্ডায় মধ্যমণি থাকবেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
আমার সে আনন্দ কে দেখে! যথাসময়ে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো ‘সাপ্তাহিক নতুন দিন’ অফিসে আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে। আমি যখন গিয়ে হাজির হলাম, তখন দেখলাম, তিনি আমার আগেই এসে হাজির। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সেই সময়ের ‘সাপ্তাহিক নতুন দিন’-এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দ নাহাস পাশা। আমি তাঁর পা ছুঁতে চাইলাম। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়েই আমাকে বারণ করলেন ‘আরে আমি তো মনে করেছিলাম ফকির একেবারে বুজুর্গ মানুষ! এখন দেখি তুর্কি-তরুণ’—শুরু করলেন গাফফার ভাই। প্রায় দেড় ঘণ্টা চললো আমাদের আড্ডাপূর্ব কথাবার্তা। এরপর শুরু হলো মূল মত-বিনিময়পর্ব।
বাসন ভাই ছাড়াও, বিলাতের বিশিষ্ট সাংবাদিক- সৈয়দ নাহাস পাশা, নবাব উদ্দিন, বেলাল আহমেদ, এমদাদুল হক চৌধুরী, রহমত আলী, রেণু লুৎফা-সহ অনেকেই সেদিন ছিলেন এই আড্ডায়। ছিলেন বিশিষ্ট সংগঠক আনসার আহমদ উল্লাহ, মিয়া আকতার হোসেন ছানুসহ অনেকে। আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তাসাদ্দুক আহমদ।
পুরো অনুষ্ঠানেই আমরা কথা শুনছিলাম গাফফার ভাই ও তাসাদ্দুক ভাইয়ের। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার কথা বিনিময়। আমি তখন (১৯৯২) ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’-যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহকারী সচিব। আমরা ওই বছরই ঢাকায় গণআদালত পর্যবেক্ষণের জন্য মার্কিন আইনজীবী মি. টমাস কিটিংকে পাঠিয়েছি। সেই সুবাদে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিষয়ই একসময় আমাদের আড্ডার মূল থিম হয়ে ওঠে। কথা হয়-অভিবাসী প্রজন্ম ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও। শহীদ জননী কি ঠিক পথে হাঁটছেন? স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার হবে কি ? যদি হয়,কিভাবে হবে? এমন অনেক আগাম কথাই সেদিন জানতে পেরেছিলাম গাফফার ভাইয়ের মুখ থেকে। যা আমাকে, আমার চিন্তা-চেতনাকে ঋদ্ধ করেছে পরবর্তী সময়ে।
এরপর গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার আড্ডা হয়েছে বেশ কয়েকবার। নিউইয়র্কে কবি শামসুর রাহমানসহ দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছি-বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের আয়োজনে। গাফফার ভাই, অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন আমার কবিতা নিয়ে।
যে কথাটি না বললেই নয়-তা হলো আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ বাতিঘর। আমরা যা দেখিনি-তা তিনি দেখেছেন। আমরা যা বলতে পারিনি, তা তিনি বলেছেন আমাদের পক্ষে।
হ্যাঁ-তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন ছিল-তিনি এত শক্ত হাতের গল্পকার,ঔপন্যাসিক হয়েও কেন বেশি লেখেননি!বলেছেন-জীবিকার জন্যই আমি অনেক কিছু বাদ দিয়ে কলাম-প্রবন্ধে ব্যস্ত থেকেছি। জানতে চেয়েছি-আপনি কি জানেন, একুশের গান লেখার পর আপনার আর কিছু না লিখলেও চলতো!তিনি শুধুই হেসেছেন। বলেছেন,তা তো খুব সামান্যই। আবদুল গাফফার চৌধুরী কথা বলেন যুক্তি দিয়ে। ইতিহাস দিয়ে। অনেকে তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর যুক্তি তারা খণ্ডন করতে পারেন না।
সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে আমার কয়েকঘণ্টার আড্ডা হয়েছে এই নিউইয়র্কেই। ৩ জুলাই ২০১৫ বিকেলে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে ‘বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেন তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন। সেখানেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমেরিকা তালেবান সৃষ্টি করে বিপদে পড়েছে। আর ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে ভেঙে টুকরো করার পাশাপাশি ইসলামি মতবাদকেও বিভক্ত করেছে পাকিস্তানকে দিয়ে।’ তিনি বলেছেন, ‘পরবর্তীকালে সৌদি ও ইরানের অর্থায়নে এ অঞ্চলে ওহাবি মতবাদ মাওলানা মওদুদীকে দিয়ে জামায়াতের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এই পাকিস্তানই ৫০ হাজার কাদিয়ানি হত্যার দায়ে মাওলানা মওদুদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যদিও ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি। তিনি বলেন, এভাবে মুসলমানে মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করেছে ওহাবি ইজম। আমি তো মনে করি, শেখ হাসিনার শত ভুলত্রুটি থাকলেও আজকে সিম্বল অব সেক্যুলারিজমের জনক হচ্ছেন তিনি। তিনি শক্ত হাতে এ সব দমন না করলে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যেত।’
আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, ‘যত দিন আমাদের মনে তিনটি প্রাচীর থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ নিরাপদ। বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু। এই তিনটি প্রাচীর থাকলেই তালেবানরা বাংলাদেশকে দখল বা ধ্বংস করতে পারবে না।’
এই অনুষ্ঠানেই তিনি বলেছেন-‘আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ চেয়েছিলাম। যে দেশে সব মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা থাকবে। আমাদের অতীত ইতিহাস বলে আমরা দাস জাতি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একবার স্বৈরাচারী আইয়ুবশাহী এসে বলেছিলেন বাঙালিরা হচ্ছে দাসের জাতি, বুটের তলায় স্পৃষ্ট জাতি। সেই সময় এই স্বৈরশাসকের কেউ বিরোধিতা করেনি। একজন বিরোধিতা করে বলেছিলেন, বাঙালি সংগ্রামের জাতি আর পাঞ্জাবিরা হচ্ছে দাসের জাতি। এই কথাটি বলেছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির জনকের কারণেই এই জাতিকে চিনেছে বিশ্ববাসী।’
প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের আশার প্রদীপ আছে। সাহসের কেন্দ্র আছে। সেদিকে তাকাতে হবে।’ একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের অনেক ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তারপরেও বাংলাদেশ শেখ হাসিনার মতো ইস্পাতরূপী নেত্রী পেয়েছে। যিনি কিনা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন যে বিরোধী দল রয়েছে, এটাকে গণতান্ত্রিক বিরোধী দল বলা যায় না, এটা হচ্ছে প্রয়োজনের বিরোধী দল। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে না এলে কে কী করতে পারে? হিসেবে যে বিএনপি ভুল করেছে, তা তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।’ তিনি বিএনপির শাসনামল ও আওয়ামী লীগের শাসনামলের তুলনা করে বলেন, ‘ওরা হাওয়া ভবনে বসে রোবট সরকার চালাত। ফলেই দেশ ধ্বংস হওয়ার উপক্রম ছিল। এখন একটি রক্ত-মাংসের সরকার দেশে আছে। এই পার্থক্য অনেক বিরাট।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ায় আমাদের শির উঁচু হয়েছে। তা না হলে এতদিন আমাদের দেশে ড্রোন হামলা হতো। মাদ্রাসা-মসজিদগুলো তালেবানরা দখল করে নিত। আমাদের সৌভাগ্য হচ্ছে আমরা আগে বাঙালি তারপরে মুসলমান। যে কারণেই বাংলাদেশ ধ্বংস হবে না, বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের এখন প্রধান সমস্যা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজদের চীনের মতো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। এদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আমরা সোশ্যাল রেভ্যুলুশন চাই। সামাজিক বিপ্লব ছাড়া একটি জাতি দীর্ঘ মেয়াদে দাঁড়াতে পারে না। এই কাজটি অগ্রসরমান প্রজন্ম করবে- এই বিশ্বাস আমি রেখে যাচ্ছি। এরা ধর্মীয় সব গোঁড়ামির বিরুদ্ধে শক্ত হাতে দাঁড়াবেই।’
প্রায় ৪৫ মিনিটের এই সিরিজ ভাষণে প্রবীণ সাংবাদিক ছিলেন খুবই আশাবাদী। তিনি সব অপসভ্যতা, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। অনুষ্ঠানে একমাত্র বক্তা ছিলেন তিনি। হলভর্তি সুধীজন দাঁড়িয়ে সম্মান জানান এই বিশিষ্ট বাঙালি সন্তানকে। তাঁকে আজীবন সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তৎকালীন স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
গত ১২ জুলাই ২০১৫ নিউইয়র্কে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেও আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে তিনি আবারও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ”আপনাদের অনেকে জানেন, ১৯২৬ সালে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ঢাকায়। মূলত এ আন্দোলন ছিল মুসলিম সমাজকে প্রগতিমুখী করার জন্য একটি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি ইত্যাদি নানা বিদ্যার দিগন্তে বিচরণ উৎসাহী এবং মুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ উদ্দীপ্ত সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেন (অর্থনীতি ও বাণিজ্য), অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন (পদার্থ বিদ্যা), বিএ ক্লাসের ছাত্র আবুল ফজল, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ (বাংলা) প্রমুখ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কাজী আবদুল ওদুদকে বলা হতো এ প্রতিষ্ঠানের মস্তক, আবুল হুসেনকে হস্ত এবং কাজী মোতাহার হোসেনকে হৃদয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মুসলমান বাঙালিকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়। প্রসঙ্গত বলা দরকার, রাজা রামমোহন রায়কে ‘মহামানব’ বলার অপরাধে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়। কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রাণভয়ে কলকাতা চলে যান। আপনারা জানেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল তৎকালীন মোল্লারা। বলা হয়েছিল ইংরেজি শিক্ষা হারাম। স্যার সৈয়দ আহমদকেও তারা পছন্দ করেনি ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে কাজ করেছিলেন বলে। অথচ এরাই পরে কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি তকমা দেওয়ার কোশেশ করেছে। এখন মৌলবাদীরা নজরুলের গান গায় নিজেদের প্রয়োজনে।”
তিনি বলেন, ‘ইসলামে অনেক ইমাম এসেছেন। তাদের একে অন্যের সঙ্গে ভিন্নমত ছিল। সুন্নিহ ও শিয়া মুসলমান বিষয়েও অনেক কথা আছে। কিন্তু মানব সমাজ এগিয়ে গেছে। এগোতেই হয়। আজকের সমাজ সমকামীদের অধিকার দিয়েছে। গে রাইটস এখন একটি স্বীকৃত বিষয়। এসব নিয়ে এই প্রজন্মকে ভাবতে হবে। পরখ করতে হবে আলো ও আঁধারের পথ। আমাদের একজন কামাল আতাতুর্ক দরকার। যিনি অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করেছিলেন। তুরস্কে যেভাবে সভ্যতার বিবর্তন হয়েছিল, আজ তা জানতে হবে- বুঝতে হবে এই প্রজন্মকে। বিশ্বে আজ নতুন নতুন মৌলবাদ তৈরি হচ্ছে। এটা কারা করছে? কাদের স্বার্থে করছে? বিশ্বব্যাপী আজ মুসলমান, মুসলমানকে হত্যা করছে সবচেয়ে বেশি। গোত্রগত সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে শুধুমাত্র মূর্খতা,বর্বরতার কারণে। মানুষের অজ্ঞতাই আজ এই নতুন নতুন মৌলবাদের অন্যতম কারণ।’ অমর একুশের গানের এই স্রষ্টা বলেন, ‘সৌদি বাদশাহ আজ ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ইরানকে ধ্বংস করার জন্য। বিষয়টি ভাবা যায়! এই হলো মুসলিম সত্তার নমুনা। ভাষা ও রাষ্ট্রের ভিত্তিতে প্রথম জাতি হচ্ছে বাঙালি। আর প্রথম রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা কম বড় অর্জন নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আজ আমাদের চারপাশে বাণিজ্যের হালালিকরণ করা হয়েছে। আমরা খ্রিস্টান ব্যাংক না দেখতে পেলেও কয়েকগণ্ডা ইসলামি ব্যাংক দেখি। এর কারণ কী? সবই স্বার্থের খেলা। এই মৌলবাদীরাই তাদের স্বার্থে আঘাত পড়লে মনগড়া ফতোয়া দেয়। মানুষের কল্লা চায়! কী বীভৎস এদের আচরণ! সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আমি মৃত্যুকেও ভয় করি না। আমার কথা আমি সত্যের পক্ষে বলেই যাব। আমার বিবেচনাবোধ কেউ রুখতে পারবে না।’
আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এখানে অনুষ্ঠান আয়োজন করে প্রমাণ করেছেন ১৯৭১ এখনো আমাদের মননে উজ্জ্বল। আপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধা এখানে আছেন, আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন। এই প্রজন্মের সবাইকে বলতে চাই, মানবতার জয় হবেই। কারণ মানুষই জগতের সবচেয়ে বড় শক্তি। আঁধার চিরে মানুষ দাঁড়াবেই। বিশ্বে সেক্যুলার পলিটিকস জয়ী হতেই হবে। তা না হলে মানবতাবোধ থাকবে না। মানুষ আর মানুষ থাকবে না। আমি কোনো অপশক্তিকে ভয় করি না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ”আমাদের চারপাশে প্রগতিবাদের লেবাস পরে যারা আছে, এরাই আমাদের প্রধান শত্রু। এরা পড়ে না। জানে না। জানতে চায়ও না। কথায় ও জীবনাচারে এদের বড় অমিল। এদের চিহ্নিত করতে হবে। ‘বন্ধু’ ও ‘শত্রু’ চিনতে হবে আমাদের।” মৌলবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা বিষয়ে তিনি বলেন, এদের একটি নিষিদ্ধ করলে তারা অন্য নামে আরও তিনটি করবে। যেভাবে বিশ্বে আমরা নতুন নতুন জঙ্গি গ্রুপের নাম শুনছি।’
প্রায় একঘণ্টার বক্তব্যে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার আওয়ামী লীগই করতে পারছে। এটা শেষ হবেই। সেই সঙ্গে যারা মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী চেতনার বীজ বুনছে গ্রামে-গ্রামান্তরে, এদের তৎপরতায় নজর রাখতে হবে। তা না হলে আমাদের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে।’
এই যে কথাগুলো, তা বলার মানুষ আমাদের এখন খুবই কম। আবদুল গাফফার চৌধুরী এই ৮২ বছর বয়সেও আমাদের চেতনার বাতিঘর। তিনি যে মশাল হাতে এগিয়ে চলেছেন- তা আমাদের কাছে অনুসরণীয়। বিবেক দিয়ে কথা বলার মানুষ আমাদের জাতিসত্তায় এখন নেই বললেই চলে। তিনি প্রজন্মের মাঝে সেই আলোর বীজতলা নির্মাণ করেই যাচ্ছেন। তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, তা আমাদের ভাবতে হবে গভীরভাবে। কারণ আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন টিকিয়ে রাখতে হলে প্রজন্মে গড়ে তুলতে হবে সেই আলোকেই।
অনেকগুলো গ্রন্থের জনক তিনি। এর মাঝে; গল্পগ্রন্থ-কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯),চন্দ্রদ্বীপের উপখ্যান(১৬০),সুন্দর হে সুন্দর(১৯৬০),নাম না জানা ভোর(১৯৬২),নীল যমুনা(১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ(১৯৬৭), শিশুতোষগ্রন্থ-ডানপিঠে শওকত(১৯৫৩),আঁধার কুঠির ছেলেটি(১৯৫৪) অন্যতম। বেরিয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক প্রবন্ধের বইও। তিনি আমাদের কন্ঠস্বর। আমাদের বিবেক। তিনি জন্মেছেন ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। আজ তারা জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা।