চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে যে দীঘল মানুষটির জন্ম, তিনি নিজ শক্তি ও সামর্থ্যরে পরিচয় রাখতে পারা দীলতাজ রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আলো-জল দিয়ে পরম মমতায় লালন করেছে যে জেলা, সেই গোপালগঞ্জেরই উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী কবি ও কথাসাহিত্যিক দীলতাজ রহমান। জন্মস্থান ও জন্ম-মাটির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। পরবর্তীকালে কি-বোর্ড। সেই কলম ও কি-বোর্ডের যৌথ প্রয়াসে সৃজিত হয়েছে তার বেশ কয়েকটি গল্প, কবিতা ও শিশুতোষ গ্রন্থ। সম্পাদনায়ও এগিয়ে। এত যাঁর গুণ-গৌরব, তিনি কেন মাড়ালেন না উপন্যাসের বিস্তৃত প্রান্তর? এমন কৌতূহল জেগেই থাকে।
ঈদসংখ্যায় একশ্রেণীর লেখক নাতিদীর্ঘ গল্পকে উপন্যাস হিসেবে চালিয়ে দেন; দীলতাজ রহমানের একেকটি গল্পের আয়তন কয়েকটি উপন্যাসের চেয়ে ঢের বড়। আফসোসকে পাশ কাটিয়ে আমরা বরং তার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম স্মরণে আনি, ‘এ মাটি শেখ মুজিবের বুক’। জাতির পিতাকে কী নিবিড়ভাবে হৃদয়ে ধারণ করলে এমন দুর্দান্ত পঙ্ক্তির জন্ম হতে পারে!
পাঠক হিসেবে কাব্যভাষাকে আবিষ্কার করি সহজ-সরল অথচ বাঙ্ময় কথামালায়। পরিচিত শব্দে, আটপৌরে কথকতায় যেভাবে বসিয়ে দেন কবিতার ছুরি, সেই নিপুণ কলাবিশারদের ছুরির নিচে নিজেকে পেতে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে কি পাঠকের! অল্প ক’টি পঙ্ক্তিতে তিনি পুঁতে দেন অসীম ভার ও নিঃসীম গভীরতা। পাঠান্তে মনে হয়, এ তো আমারই কথা, হৃদয় উৎসারিত জীবন-নির্যাস। একটি কবিতা পাঠ করা যাক, ‘গভীর শেকড়প্রবণ নয় যে চারা, কী হবে/ তার জন্য বিস্তৃত মাটি চেলে!/ সম্পর্কে মাধুর্য বোঝে না যে, কী হবে/ তার জন্য অধিক আবেগ ঢেলে…।’
এভাবেই সম্পর্ক কিংবা আত্মীয়তা-অনাত্মীয়তার নিগূঢ় বৈশিষ্ট্য চিত্রণ করেন কবি। সচরাচর ব্যবহৃত হয় না, এমন কঠিন বা অপরিচিত শব্দ চয়ন না করেও বক্তব্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। উল্টোভাবেও বলা যায়, যে ভাষা লুকায়িত মানুষের মনে, মুখে আসি আসি করেও অস্ফুট, ধরা পড়ে না নিজস্ব স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণে; সেই অকথিত বক্তব্যই সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে দীলতাজ রহমানের হাতে। আরেকটি অনতিদীর্ঘ কবিতায় বলেন, ‘অন্যবাড়ির ফুল পোড়ায় মর্মমূল/ তার সুবাসও নাসারন্ধ্রে সত্য নয়/ তবু ফিরে ফিরে খোঁড়ে এসে কোন সে ভুল…।’ এই কবিতায় উচ্চকিত হয়ে উঠেছে মানবজীবনের অতি পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত অধ্যায়। যা কিছু নিজের, তাতে সন্তুষ্ট থাকা বোধকরি মানুষের সহজাত স্বভাব নয়। তাকে হাতছানি দেয় দূরের সৌন্দর্য, কল্পনার কাশবন, আপাত সহজ কিন্তু দুর্লভ বস্তু।
প্রকৃতপক্ষে যা শেষপর্যন্ত অচেনাই থেকে যায়। তবু থামে না ভুলের পুনরাবৃত্তি, আকাঙ্ক্ষার চাষ। এ কবিতার বাণীর বিপরীত দিকটাও কবি দেখান চালাক জহুরির মতো। দর্শনঋদ্ধ ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করেন, ‘মালা থেকে খসে পড়ে যে ফুল/ হয়তো সে কারো ভুল/ ঝিনুকের মতো বুকে তারও আছে দামি ফুল!’
প্রশ্ন জাগে, এই অধরা মাধুরী, ব্যতিক্রমী শিল্প-রসদ কোথায় লুকিয়ে রাখেন, যেখানে গচ্ছিত গল্প-কবিতার প্রাণভোমরা!
প্রেমের কবিতায়ও কম যান না দীলতাজ রহমান। দুই কাব্য পঙ্ক্তিতে লহমায় মূর্ত করে তোলেন প্রেমিকমনের স্বতোৎসারিত আর্তি, ‘তোমাকে নিয়ে কবিতা হবে তবু কোথাও থাকবে না নাম/ ধাম জেনে ভালোবাসা হলে চলো চাঁদের বাড়িটি খুঁজি…।’ পৃথক আরেকটি কবিতায় এমন মোচড় দেন, বাধ্য করেন নতুন পরিসরে ভাবতে। রোমান্টিক মানসিকতার বিপরীত দিক তুলে ধরেন এভাবে, ‘ভালোবাসা বহুবার ভুল হয়ে গেছে/ শুধু একবার তোমাকে অবহেলা ঠিক আছে…।’ এমন ভুল-শুদ্ধ ব্যাকরণে প্রেম-বিরহের অতল-তল সন্ধান করে ফেরেন। উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে চান বৃহৎ মনোজে। আবেগ কিংবা গভীর প্রেমকে উদ্ভাসিত করেন, ‘‘আমার ভেতর নদী ডেকে ভেসে আছো মেঘ/ পিপাসা পোড়ে সময়ের কাজল চোখে/ তবু বলো, ‘এ তোমার অন্ধ আবেগ!’/ তোমার আবেগ এই জীবনে পাবে তো জাগরদৃষ্টি?/ আমি আরেকটা জীবন চাই তোমাকে ফিরে না দেখার…।’’
আপাদমস্তক প্রেমময় কবি দীলতাজ রহমান এভাবেই কালের পাথরে খোদাই করে চলেন জীবন-জিজ্ঞাসার চারুলিপি। ঠাস বুনোটের আরেকটি কবিতায় এভাবে ঢালেন মৃণ্ময় মাধুরী, ‘তোমার কাছে যেতে পাশ দিয়ে যে পথ বয়ে গেলো,/ সেই পথে ছুটে গেলো কিছুটা মন/ সম্পূর্ণ আমার আমিকে আনি তোমার কাছে/ তবু তোমার সম্পূর্ণ আমি চাই-ই চাই…।’ প্রেম যে একধরনের স্বার্থপরতাও, প্রেমাস্পদকে সঠিক প্রাপ্যটুকু না দিয়ে নিজের হিস্যাটুকুই বুঝে নিতে চায় ষোল আনা, এমন প্রাচীন বিষয়কেই নতুন ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। এক পঙ্ক্তির কবিতাও কতটা সংবেদী হতে পারে, সেই ‘ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস’ যেখানে বিন্দুতে লুকিয়ে থাকে সিন্ধুর রসদ সেটাই ধরা পড়েছে কাব্যকলিতে, ‘বৃক্ষ জানলে না কী ক্ষতি করেছো খামখেয়ালী ডাকে…।’ আরেকটি বিপরীতধর্মী কবিতা, ‘বইটি ছাপা হওয়ার পরই কবি বোঝেন/ উৎসর্গপত্রে ছাপা হয়েছে ভুল মানুষের নাম…।’ এভাবে, আটপৌরে শব্দ-বাক্যে, আড়াল কিংবা আবছায়া, আলো-অন্ধকারের লুকোচুরি, অলৌকিক বাতায়ন না রেখে অনেকটা নগ্নভাবে দীলতাজ রহমান মনোভাষ্য দিয়ে যান। তাতে ঘোর আপত্তি থাকতে পারে একশ্রেণীর সাহিত্য সমালোচকের।
কবিতায় যে রহস্যময়তা এবং দুর্বোধ্যতা থাকে তাকেই প্রধান্য দেন কেউ কেউ। অন্যথায় নিন্দুকের একহাত দেখে নিতে পারার আনন্দ! এমন ‘কল্পিত বাস্তবতা’র বিপরীতে দীলতাজ রহমান কবিতাকে কাঠবাদাম বানাতে চান না বলেই বক্তব্য প্রকাশে অকপট, নির্মেদ। এটাই তার সৃজন-সৌন্দর্য। শক্তি ও বৈশিষ্ট্য তো বটেই। সমালোচকের ভ্রূকুটি, পণ্ডিতের আলগা মাতব্বরি, খবরদারি কিংবা মনোবাঞ্ছার থোড়াই কেয়ার করেন একরোখা এ সাধক। ইতি-নেতির সীমারেখা ডিঙিয়ে পাঠক স্বস্তি ও দর্শন খুঁজে নেয় কবিতার স্বচ্ছ অলিন্দে। পাঁড়-পাঠক এবং আম-পাঠকের সঙ্গে অনায়াসে কমিউনিকেট করেন দীলতাজ রহমান। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘জনকের প্রতিচ্ছবি’, ‘এ মাটি শেখ মুজিবের বুক’, ‘আশ্চর্য সর্বনাশ’, ‘সবুজের সাথে সখ্য’, ‘পারিজাত অপরাজিতা’, ‘ওই দুটি চোখ আমার সীমা লঙ্ঘনের ঠিকানা’, ‘বৃষ্টি এসে’, ‘রাতান্ধ বিড়াল’, ‘আমি কদমফুলের ঘ্রাণ চাই’, ‘এ গোলাপ তোমার জন্য’। শিশুতোষ গ্রন্থ, ‘পটলের হারিয়ে যাওয়া’, ‘ভালো ভূত’, ‘সোনার মেয়ে করিমন’, ‘একটি পাখির ডাকে’, ‘মা আমার চোখের আলো’। গ্রল্পগ্রন্থ, ‘বহুকৌণিক আলোর সংঘাতে’, ‘ধূসর আঁচলে চাবি’, ‘মেঘের মেয়েরা’, ‘গহীন দূরত্ব’, ‘বৃত্তভাঙা আয়তন’, ‘ফেরার ঘর নেই’ (এ ছয় গল্পগ্রন্থের সমম্বয়ে প্রকাশিত গল্পসমগ্র ১), ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’ ও ‘জল যে পিপাসা পায় না নাগাল’।
কবিতার পাশাপাশি গল্পেও নিবিষ্ট দীলতাজ রহমান। গল্প যেন যাপিত জীবনের মুখচ্ছবি। স্বচ্ছ জলে আয়না দেখার আনন্দ। নারীবাদ কিংবা পুরুষবাদের তীব্র-তীক্ষ্ম অঙ্গনে পা রাখেননি; তার কথাসাহিত্যে ‘মানুষবাদ’ই মুখ্য। গল্পে অনায়াসেই ব্যবহার করেন অন্ত্যজ শ্রেণীর ব্যবহৃত এমন সব বাক্য, তাতে চোখ বিস্ফোরিত হওয়ার পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয় ক্ষেত্রবিশেষে। যৌনতা ও যৌনবিষয়ক মনোভাবের প্রকাশ তার হাতে ‘শিল্পিত’ না হয়ে ‘দিগম্বর’ হয়ে ওঠে।
গল্পে নারী-পুরুষ, সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখ যেভাবে এঁকে চলেন, বিধৃত করেন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রসায়ন তাতে বহুদর্শী দৃষ্টিই যেন পেখম মেলে পাঠকের মন-মানসে। প্রাত্যহিক টানাপড়েন, দিনযাপনের গ্লানি, খেয়োখেয়ির সংসার, লোভ ও জিঘাংসার যে নৈর্ব্যক্তিক বয়ন উপস্থাপন করেন, তাতে ধারণা জন্মায়; দীলতাজ রহমানের জানা-শোনার পরিধি বস্তি থেকে গুণ্ডাপাণ্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত। গল্পের চরিত্ররা যেন লেখকসত্তার সঙ্গেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তেল-জলের মিশেলে সৃষ্টি হয় তৃতীয় রসায়ন। প্রশ্ন জাগে, এই অধরা মাধুরী, ব্যতিক্রমী শিল্প-রসদ কোথায় লুকিয়ে রাখেন, যেখানে গচ্ছিত গল্প-কবিতার প্রাণভোমরা!