ইংরেজিতে বলা হয় অ্যাডামস পিক। আদম চূড়া। পৃথিবীর প্রথম মানব আদমের পায়ের ছাপ রয়েছে এখানে। আর এ কারণেই এই পাহাড়টি বিখ্যাত। এর সুখ্যাতি দুনিয়াজোড়া। নামের মধ্যেই অন্যরকম একটা আকর্ষণ! যারাই এর নাম শুনেছেন, পাহাড়টি সম্পর্কে জানেন, তারাই জায়গাটি ভ্রমণের তীব্র বাসনা অনুভব করেন। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা সেখানে বেড়াতে যান। যাদের আর্থিক বা শারীরিক সামর্থ্য নেই, তারা অ্যাডামস পিক সম্পর্কে লেখা পড়ে অথবা ইউটিউবে ভিডিও দেখে নিতে পারেন।
কার পায়ের ছাপ?
মুসলমানদের কাছে আদমের পায়ের ছাপ। মুসলমানরা আদমকেই সৃষ্টির প্রথম মানুষ হিসেবে জানেন। আদম (আ.) তাদের নবী। খ্রিষ্ট ধর্মমতেও সৃষ্টির আদি মানব অ্যাডাম। কেউ কেউ তাঁকে আদি পিতা বলেও সম্বোধন করেন।
ওই পায়ের ছাপকে হিন্দুরা বলেন শ্রী পদ। তাদের কাছে ওটা হনুমান বা শীবের পায়ের ছাপ!
বৌদ্ধদের কাছে গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন।
খ্রিষ্টানদের কাছে অ্যাডাম অথবা সেন্ট থমাসের ফুট প্রিন্ট।
একে সিক্রেট ফুট প্রিন্ট বা গোপন পদচিহ্নও বলা হয়। শক্ত পাথরের ওপর ওই পায়ের চিহ্নটি ১ দশমিক ৮ মিটার বা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা! চওড়া আড়াই ফুট।
অ্যাডাম বা আদমের নামানুসারে পাহাড় চূড়ার নাম হয়েছে অ্যাডামস পিক, আদম চূড়া।
পৃথিবীতে তিনি প্রথম পা ফেলেন এই পাহাড়ের মাথায়। এ জন্য জায়গাটির এরকম নামকরণ।
পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের কাছে এটি পবিত্রতম স্থান। এমনকি যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না, তাদের কাছেও জায়গাটি আকর্ষণীয়। তাদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না; পরিসংখ্যান বলছে তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে! ধর্ম সৃষ্টির আগে প্রথম মানব পৃথিবীতে এসেছিলেন অ্যাডামস পিকে; এমন মিথ ধামির্ক অধার্মিক সবাইকে আকর্ষণ করে।
কথিত আছে, স্বর্গের বাগান বা ইডেন গার্ডেন থেকে আদম ও হাওয়া বিতাড়িত হন। সেখান থেকে আদমকে এই পাহাড়ের চূড়ায় নিক্ষেপ করা হয়। পৃথিবীতে তিনি প্রথম পা ফেলেন এই পাহাড়ের মাথায়। এ জন্য জায়গাটির এরকম নামকরণ।
অনেকে মনে করেন এটি আসলে ধর্মীয় মিথ। ইডেন গার্ডেন আবার পৃথিবীর মাটিতে একটি স্থানকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে এর অবস্থান দেখানো হয়েছে মেসোপটেমিয়া বা ইরাকের কোনো স্থানকে। বাইবেলে এর উল্লেখ আছে। ইডেন গার্ডেনকে একেক সময় একেকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোথাও উদ্যান, কোথাও উদ্যানের গাছ, কোথাও বৃক্ষ শাখা, কোথাও এর ফুল বা ফল, আবার কোথাও উদ্যানের জলকে বোঝানো হয়েছে। এমনকি ইডেন বলতে ঈশ্বরের রোপন করা গাছকেও মনে করা হয়।
হিন্দু পুরাণে একটি শব্দ আছে পারিজাত। এর অর্থ স্বর্গের সমুদ্র মন্থনের ফলে উদ্ভূত উদ্ভিদ, বৃক্ষ, ফল বা ফুল বিশেষ। তবে ইডেন নামটি উচ্চারণ করলে ভারতের ইডেন গার্ডেন ক্রিকেট স্টেডিয়াম এবং ঢাকার ইডেন কলেজ নাম দুটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
প্রথমবার শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। আকাশ পথে কলম্বো যাওয়ার পথে ঢাকা থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগে সুন্দবনের শেষ মাথায় পৌঁছতে। সেখান থেকে আরও ঘণ্টাখানেক লাগে বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতে। সবমিলিয়ে কলম্বো পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টা। শ্রীলঙ্কার ভূ-ভাগে প্রবেশের পর তখন পাইলট কথা বলছিলেন ককপিটে বসে। তিনি যাত্রীদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘আমাদের বা পাশে অ্যাডামস পিক, ডান পাশে সাফারি পার্ক, ন্যাশনাল ফরেস্ট’ ইত্যাদি। অ্যাডামস পিক কথাটা তখনই প্রথম শুনেছিলাম। কিন্তু মনের ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল শব্দটি। ইচ্ছে ছিল একদিন ওখানে যেতেই হবে। ওই বছর অ্যাডামস পিকের কাছ দিয়ে ঘুরেছি। বার দুয়েক ওই রাস্তা দিয়ে ক্যান্ডি গিয়েছি। কিন্তু অ্যাডামস পিক এলাকায় যাওয়া হয়নি। সেবার অবশ্য কলম্বো থেকে মালদ্বীপও গিয়েছিলাম।
২০১৭ সালেও শ্রীলঙ্কা গিয়েছি। কলম্বো ঘুরেই চলে এসেছিলাম। আর তাই ২০১৯ সালের সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চাইনি। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট সিরিজে স্পন্সর ছিল ওয়ালটন। দুই সহকর্মী ফিরোজ আলম ও মিল্টন আহমেদ আমার সঙ্গী। ঢাকা থেকেই বলে রেখেছিলাম, এবার অ্যাডামস পিকে যাব। মিল্টন সঙ্গে যেতে রাজি হচ্ছিল। কিন্তু ফিরোজ আলমের কথা হলো, ওটা ভীষণ কষ্টসাধ্য। সম্ভব নয়। আমি বলেছি, এখন যদি না পারি তাহলে আর কবে পারবো। দিন দি তো বুড় হয়ে যাচ্ছি।
ভিয়েতনামে হাল লং বে-তে অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠেছি। ভুটানে টাইগার নেস্টে অনেকেই ওঠার সাহস পান না। উঠেছি সেখানেও। এছাড়া দেশ-বিদেশেরঅনেক উঁচু পাহাড়ে উঠেছি। তাহলে পারবো না কেন? ফিরোজ আলম বিভিন্ন ভিডিও, তথ্য, রিভিউ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে বললেন, ‘সম্ভব নয়। আপানারা যান, আমি যাবো না।’ আমি তখন বলেছিলাম, নো প্রবলেম, আমি একা যাবো। আমাকে একটা বাসের টিকিট করে দিয়েন। না হলে একটা কার ভাড়া করে দিয়েন।
অতি ছোট্ট একটি অসমতল পাহাড়ি এলাকা। কিন্তু ভারি সুন্দর!
মিল্টন অবশ্য বরাবরই যেতে চাইছিল। মনে মনে হয়তো সে-ও ভাবছিল, এত কষ্টের চেয়ে কলম্বোয় বিশ্রাম নেওয়াই ভালো। আমি অবশ্য স্থির ছিলাম, জীবনের শেষ চিকিৎসা, আমাকে যেতে হবেই।
কলম্বোতে আমরা এআরবিএনবি থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। যে কারণে মাঝখানে এক রাত না থাকলেও সমস্যা নেই, ফ্ল্যাট ছাড়তে হচ্ছিল না। ফ্ল্যাটের মালিককে শুধু জানিয়ে রেখেছিলাম। এক রাত থাকবো না কলম্বোতে।
এর আগে ক্রিকেট খেলার গ্যাপ ছিল একদিন। সেদিন গিয়েছিলাম গল। পরের ম্যাচের আগে দুদিন গ্যাপ পেয়ে প্ল্যান করেছিলাম অ্যাডামস পিক যাওয়ার। নেট থেকে নম্বর নিয়ে ফিরোজ আলম একটা প্রাইভেট কার ভাড়া নিলেন। কলম্বো থেকে সরাসরি অ্যাডাম পিক।
আগের রাতেই ফিরোজ আলম জানালেন, তিনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে। তবে পাহাড়ে উঠবেন না। হোটেলে বিশ্রাম নেবেন। আমরা তাতে খুশিই হয়েছিলাম। কারণ বহু জায়গায় আমরা একসঙ্গে গিয়েছি। আমাদের ক্যামিস্ট্রি বা পারস্পরিক বোঝাপড়া দারুণ। আমরা কেউই স্মোকার নই। পান বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস নেই। এমনকি আমি চা-কফিও পান করি না। আমার দেখাদেখি তারা দুজনেও তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর কোনো বাজে নেশা নেই আমাদের। নেশা একটাই, নতুন জায়গা আর প্রকৃতি উপভোগ। ফিরোজ আলমের একটা নেশা আছে, ঠাণ্ডা কোক তার খুব প্রিয়। তবে কোনো টিমে ফিরোজ থাকা মানেই ভরপুর এন্টারটেইনমেন্ট। গল্প-কৌতুক উপস্থিত বৃদ্ধি, অসাধারণ এক প্যাকেজ ‘ফিরোজ প্যাকেজ’।
অ্যাডামস পিক দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার মাঝখানে অবস্থিত। নির্দিষ্ট করে বললে, দেশটির মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকার দক্ষিনাংশে। এটি রত্নপুরা জেলায় পড়েছে। তবে কিছু অংশ পড়েছে সাবারাগামুয়া প্রদেশের নুয়ারা এলিয়া জেলায়।
নুয়ারা এলিয়া জায়গাটি বিখ্যাত অন্য কারণে। এর আবহাওয়া ঠিক লন্ডনের মতো। যে কারণে পর্যটকরা সেখানে যান লন্ডনের আমেজ পেতে। ওই যে ২০১৩ তে ক্যান্ডি গিয়েছিলাম, তখন থেকেই নুয়ারা এলিয়ার নাম শুনে আসছিলাম। অনেকেই এটিকে বলেন, নুরালিয়া।
যাহোক রত্নপুরা জেলা থেকে জায়গাটি ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে। পাশের জেলার নাম হাটন। হাটন থেকে এটি ৩২ কিলোমিটার দূরে। তবে, রেলে চড়ে গেলে ওই হাটন শহরে নামতে হয়। এরপর বাস বা অন্য কোনো যানবাহনে করে পাহাড়ের নিচ পর্যন্ত যাওয়া যায়।
ফিরোজ যাবে শুনে খুবই খুশি হলাম। সকাল ৮ টায় গাড়ি চলে আসলো ফ্ল্যাটের নিচে। উঠে বসলাম। কোথায় যাচ্ছিলাম? যে জায়গা থেকে পাহাড়ে উঠতে হয় তার নাম নাল্লাথান্নিয়া (Nallathannia); সেখানেই আমাদের হাটেল বুকিং ছিল। অতি ছোট্ট একটি অসমতল পাহাড়ি এলাকা। কিন্তু ভারি সুন্দর!
গাড়ি চলতে শুরু করলো।
রহস্যময় আদম পাহাড়
উদয় হাকিম
প্রকাশক: অনিন্দ্য প্রকাশ
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
স্টল নম্বর ৩১ (প্যাভেলিয়ন)