সকালকে সকালের মতো করে আমি চিনতে পারি। সকালের রোদ যখন সকালের মতো হয়ে আসে, তখন চৌমাথায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। কত কিছুই না তার গায়ে লেখা থাকে। আমি সেগুলো স্পষ্ট পড়তে পারি। অনুভব করি, সকাল তার সমগ্রতা নিয়ে নিজেকে গভীর মগ্নতায় ডুবিয়ে রাখতে চায়।
আমি জানালা খুলে সকালের মুখোমুখি দাঁড়াই। রোদের সকাল, কখনো আবার তা মেঘে ঢাকা থাকে। নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়ে মেলে ধরতে ইচ্ছা হয়। মনে হয়, একজনের কাছে অন্তত মনের আগল খুলে দাঁড়াই। কিন্তু কোথায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়া! ভালো করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারি না। কোথায় যেন একটা অস্পষ্টতার জাল আমাকে ঘিরে থাকে। অনেক কিছুই বলি সকালকে। কিন্তু তা যেন আমার সম্পূর্ণটা নয়। নিজেকে উজাড় করে দেওয়া নয়।
মনে হয় যেন আমি কিছু লুকোচ্ছি। অথচ আমার লুকোনোর কিছু নেই। তাহলে কি কোনো কিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়? নিজেকে অনেক খুঁজে দেখি। কিন্তু তাও তো নয়। আসলে সকালের ওই স্বচ্ছতার কাছে আমি কিছুতেই দাঁড়াতে পারছি না। সেই কবে থেকে ভেবেছি সকালের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর যেন যোগ্যতা অর্জন করতে পারি। কিন্তু শেষপর্যন্ত তো হলো না। তাই সকালের সব কথা শুনেও তার কাজ করতে গিয়ে আমার হাত-পা কেঁপে ওঠে।
দুপুরকে তো কোনোদিন আমার বাইরের কেউ বলে মনেই হয়নি। চেতনার কোন শৈশব থেকে তার সঙ্গে আমার আত্মার যোগ। একমাত্র তার কথাই আমি সব বুঝতে পারতাম। তার অলিগলি সব আমার চেনা। একটা সময় পর্যন্ত তার সঙ্গে আমি শুধু ছুটে বেড়িয়েছি। কিন্তু আমার চারপাশে যখন ডালপালা ছড়ালো, শিকড় চলে গেলো মাটির অনেক দূর প্রদেশ পর্যন্ত; তখন গতি কমে এলো। ক্রমহ্রাসমান গতিকে আমার কখনো দোষের বলে মনে হয়নি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু মনের সেই গতি কোথায়! দুপুরের সামনে এসে দাঁড়ালে মনে হতো আমি যেন অনেক কিছুতে নিজেকে নিয়োগ করে ফেলেছি। সবটুকু নিয়ে আমি যেন দুপুরের কাছে আসতেই পারিনি। অনেক অনেক জায়গায় যেন আমার একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়ে গেছে। আমি দুপুরের কাছে বারবার ধরা পড়ে যেতাম।
সন্ধ্যায় যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসতো, তখন মনের মধ্যে কিছুতেই একটা প্রশান্তির বাতাবরণকে অনুভব করতে পারতাম না। মন যেন অশান্তিতে ডুবে থাকতো। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বুঝতে পারি, যেভাবে নিজেকে সাজাতে চেয়েছি সেভাবে আমি আমার গতিপথ ঠিক করতে পারিনি। তাই তো অনেক কথার মাঝে আমি আমার হিসাবটাকেও মিলিয়ে নেই। হিসাব মানেই তো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি। জীবন কি অঙ্কে চলে? অঙ্ক মানেই তো মগ্নতা থেকে বিচ্ছেদ। তাই ফিলিপ লার্কিনের সুরে সুর মিলিয়ে পড়ি:
রোজ সকালে একবার করে মরি
দুপুরে আরেকবার, সন্ধ্যায়ও
শুতে গিয়ে আবার মরি
সারারাত ধরে জেগে বসে থাকি। জৈবিক চাহিদা মানুষকে যে কোথাও নিয়ে পৌঁছায় না, সেটা এখন জীবন দিয়ে অনুভব করি। সারাদিন হিসাবের খাতায় নিজের কদর্য মুখকে যেভাবে এঁকেছি, তাতে রাতে চোখের সামনে নিজের সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে নিজেই আঁৎকে উঠেছি। আর যাই হোক কিছুতেই তাকে মানুষ বলে চিনতে পারছি না।
আত্মজিজ্ঞাসার এই যে পর্ব, এটা সব মানুষের কাছেই কাঙ্ক্ষিত। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে শুধরে নেওয়ার যে চেষ্টা তার মধ্যে দিয়ে নিজের অন্তর্জগতের যে তোলপাড় তা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এটা এমন একটা রূপান্তরপর্ব, যে প্রক্রিয়া আমৃত্যু চলতে পারে। এর সফলতার সঙ্গে প্রাপ্তি জড়িয়ে থাকলেও এই প্রাপ্তিতে গ্রহণ করার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে মৃত্যু। অপ্রাপ্তির ভীষণ নেশা এখানেও তোমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াবে। আমৃত্যু চলবে এই আত্মসংশোধন।
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যের প্রতিটি মৃত্যু আমাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলে। প্রতি মুহূর্তের এই বাঁচা একটু একটু করে নিজেকে খাদহীন করে তোলার প্রচেষ্টা মাত্র। খুব বেশি নয় একটু একটু করে বাঁচতে ইচ্ছা করে। কোনো ভবিষ্যৎ নয়, প্রতিদিনের বাঁচাটাই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। আর প্রতিদিনের বাঁচার মধ্যেই নিহিত থাকে আমার আত্মসংশোধনের এক সূক্ষ্ম পর্যায়, যা আমাকে অহর্নিশ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আবারও সেই ফিলিপ লার্কিনের শরণাপন্ন হই:
তারপর সারারাত জেগে
পচতে পচতে
ভোরবেলায় আবার জেগে উঠি
সারাদিন ধরে মরব বলে
তাও একবার, শুধু একবার
বাঁচার তীব্র লোভ
সামলাতে পারি না ।