আক্তারুজ্জামান লেবু শুধু একটি নাম নয়, একজন কবির পরিচয় ও বেড়ে ওঠার স্মারক এটি। ক্ষণজন্মা এই কবি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু কবিতাকে দিয়ে গেছেন বেঁচে থাকার অনন্য শক্তি। মফস্বল শহর গাইবান্ধা থেকে দূরে গোবিন্দগঞ্জের এক সবুজ শ্যামল মায়াময় গ্রামে লেবুর জন্ম। গ্রামের কাদা মাটি হাওয়া জল মেখেই তার পরিণয় ও পরিণতি। ১৯৯২ সালে জন্ম নিয়ে মাত্র ২৮ বছর না পেরোতেই ২১ মার্চ ২০২১ তার মৃত্যু হবে কে জানতো? দুরারোগ্য ক্যানসার হয়তো তাকে আরও দুই বছর আগে ওপারে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তার কবিতার অবদানে তা হয়ে ওঠেনি। এ দুই বছরে কয়েকটি বইয়ের প্রকাশ দেখবেন বলেই বেঁচে ছিলেন তিনি। যদিও এই বেঁচে থাকাটা বেঁচে থাকা ছিল না, তবু আপনজনদের সান্ত্বনা ছিল আক্তারুজ্জামান লেবু তাদের মাঝে আছেন। মৃত্যুর পরও তিনি তার কবিতায় বেঁচে থাকবেন, আমরা তাকে স্মরণ করব, এই কথাটা খুব জোর দিয়েই বলতে পারি। কবি আক্তারুজ্জামান লেবু লিখেছেন
মরে গেলে
লোকে কিছুদিন সদ্যপ্রয়াত বলে
তারপর আর কিছু বলে না, ভুলে যায়
হয়তো মৃত ব্যক্তি যাপন করতে থাকে অনন্ত অন্ধকার
একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পর কিছুদিন তাকে মনে রাখা হয়। প্রকৃতির নিয়মেই তাকে ভুলে যেতে হয় আবার। কিন্তু একজন কবির মৃত্যুর পর? কবির মৃত্যুর পর কবি প্রকৃতভাবে বেঁচে ওঠেন। দ্বিগুণভাবে মানুষ তাকে স্মরণ করতে থাকে। কবি আক্তারুজ্জামান হয়তো কবর থেকে সেই স্মরণ দেখতে পাবেন না, কবরে অনন্তকালের অন্ধকার যাপন করবেন। আর আমরা যাপন করবো তার কবিতাময় জীবন।
আমার খুব মনে পড়ছে কবি আক্তারুজ্জামান লেবুর হাসিমাখা মুখটা। মনে পড়ছে তার কবিতা উদযাপনের দিনগুলোর কথা। বিশেষত আজ ভিষণভাবে নাড়া দিচ্ছে তার ‘কবিতা খেয়ে বেঁচে থাকার গল্পটা’। ছড়াকার আবু জাফর সাবু ও নাট্যজন চিনু কবির লেবু ভাইয়ের এই কথাটা নিয়ে বেশ ঠাট্টা করতেন, বিদ্রূপও অনেকটা। সেই কথা যেন তাকে আজ চরম সত্য করে তুললো। সত্যিকার অর্থেই কবি কবিতা খেয়েই বেঁচে ছিলেন। বেঁচে ছিলেন কাব্যময় শব্দের গাঁথুনিতে প্রতিনিয়ত নিজেকে ক্রন্দনরত রাখতে। জীবন তাকে সুখ দেয়নি। দুঃখবোধ তাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিয়েছে। আমরা যারা তার সঙ্গে মিশতাম, আড্ডা দিতাম, তারা অনুভব করতাম তার বিষণ্নতাকে। গল্পকার কিংশুক ভট্টাচার্যের বাসা কিংবা আক্তারুজ্জামান লেবুর ছাত্রাবাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলানো সেসব দিন আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। কবির মৃত্যু সংবাদের পর থেকে সুক্ষ্ম অপরাধ বোধে ভুগছি। করোনার সময় একটিবারের জন্যও শেষ সাক্ষাতের সুযোগ এনে দেয়নি। সামাজিক দূরত্বের মতো তা মহাকালের দূরত্বে পৌঁছে দিয়েছে আমাদের।
আমাদের চিন্তার অনুরণনে আক্তারুজ্জামান এখানেই সফল, আমরা তার কবিতা পড়তে পড়তে নিজেদের ভেতর তাকেই কেন্দ্রীভূত করি। তার কাব্যময়তায় বুঝতে তুলে আনি ক্লান্ত দুপুরের রোদ কিংবা বিষণ্ণ দুপুরের দীর্ঘ ছায়া।
পিছু ফেলে আসা বালাসির ঘাট, ঘাঘোট, যমুনার চর আর মৃত প্রায় করতোয়ার পাড় আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলছে। ঢাকা থেকে রংপুর ফিরলেই গাইবান্ধা যাওয়াটা আমার জন্য অবধারিত ছিল। গাইবান্ধা মানেই আমার কাছে কিংশুক দাদা ও লেবু ভাইয়ের সঙ্গ। প্রচুর ঘোরা হতো আমাদের। চোখ বন্ধ করলেই সেসব দিন ছবির মতো ভাসছে। আড্ডা, তর্ক ও তুমুল কবিতাকেন্দ্রিক আলোচনায় মেতে উঠতাম আমরা। আড্ডা আলোচনায় ছিল আন্তরিকতা ও মনলগোর যোগ। যা কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। পুরনো স্মৃতিগুলো নিয়ে হয়তো আস্তো একটা বই লেখা যেতে পারে, তবু শেষ হবে না আমাদের পাগলামির গল্প। সেসব স্মৃতির সেলুলয়েড ফিতে থেকে বের করতে কষ্ট হচ্ছে, কান্না হচ্ছে। লেখার ভাষা হারিয়ে বারবার ভাবছি আমাদের লেবু ভাই নেই! কী বিস্ময়কর কথা! এই তো সেদিনও আমরা ফেসবুকে কথা বলেছি, এখন আর সেই মানুষটি নেই!
আক্তারুজ্জামান লেবু চলে গিয়েছেন সত্য। কিন্তু তার কবিতা দিয়ে গেছেন অগণিত মানুষের জন্য। প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বপ্ন ও বিষণ্নমগ্ন তার কবিতা পাঠ হবে বলে বিশ্বাস করি। কেননা বরাবরই মানুষ যেমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে তেমনি বিষণ্নতা বোধকে উপভোগ করে নিজের মতো করে। মৃত্যু চিন্তা মানুষকে তাড়িত করে প্রতিনিয়ত। তাই কবি আক্তারুজ্জামান স্বপ্ন, বিষণ্নতা ও মৃত্যু তাড়নায় কাতর কবিতার ভেতর দিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
মানুষের কী এমন হয়
মেঘেদের চলে যাওয়া দেখে
পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখে
সন্ধ্যা নামার অনুযোগে
মন খারাপ করে ঘরে ফিরে আসে
কবিতার পঙ্ক্তিটি আক্তারুজ্জামান লেবুর। মন খারাপের চিত্রায়ণ। একজন পাঠককে খুব সহজেই আত্মমগ্ন ও বিষণ্ণ করার শক্তি তার কবিতার দোষ বা গুণ। এর থেকে বড় বিষয় পাঠতৃপ্তি ও পাঠক মনকে দাগান্বিত করার আশ্চর্য ক্ষমতা। এখানেই কবি কবিতার জাদুকর। শব্দ মায়ায় বেঁধে বশ করেন এবং নিজেকে পাঠকের ভেতর প্রতিষ্ঠা করেন ঘরে ফেরার মতো।
চিরদিন দুঃখ ভারাক্রান্ত কবি আক্তারুজ্জামান লেবু দুঃখকেই যাপন করতে শিখেছিলেন অল্প বয়সেই। দুঃখকে কবিতায় যাপন করেছেন প্রতিদিন। দুঃখকে সঙ্গী করে চলে গেলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন,
মন অতিরিক্ত দুঃখ নিয়ে চলে যাবে
পিছু ডাকবে না ভেবে ফিরেও তাকাবো না
তার এই বক্তব্য সত্য হয়ে গেলো। মহাকাশে নিজেকে মেলিয়ে দিতে দিতে মিথ্যা করলেন আমাদের। আমরা তাকে পিছু ডাকার সুযোগটাও পেলাম না। পেলাম না যথার্থ চিকিৎসায় তাকে নতুন করে বাঁচতে দিতে। আমাদের ব্যর্থতা আমরা একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবির পাশে ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারিনি।এই দায় আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা উভয়ের।
আক্তারুজ্জামান লেবু বেঁচে থাকতেই অনুধাবন করেছেন মৃত্যুকে। মৃত্যুর সাদ কেমন হতে পারে তা তিনি জেনে গিয়েছেন বৃষ্টিস্নাত কোনো এক ভোরে। যে জন্য তার কবিতায় মেঘময় দিনগুলো মৃত্যুর হাহাকারে জর্জরিত হয়েছে। জর্জরিত হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের নিস্তব্ধতার কোমল ব্যথার অনুভূতি। কবি মায়ের পূর্বেই নিজের মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন বারবার। লিখেছেন–‘আমার মৃত্যুর পরও খুব বৃষ্টি হবে/গোরস্তান ধুয়ে জল গড়িয়ে যাবে ডোবায়…/দরজা খুললেই গোরস্তান দেখা যাবে/ভেসে ভেসে মায়ের চোখ যাবে গোরস্তানে।’
কবির দৈহিক মৃত্যু ঘটেছে ঠিক তবে তা কবি ও কবিতার মৃত্যু ঘটায়নি। তার দুঃখী মা ছেলের কবরের দিকে দৃষ্টি ফেলে কাঁদবেন আর আমরা সেই কান্নার ধ্বনি খুঁজে ফিরবো তার কবিতায়। আক্তারুজ্জামান লেবু বাংলা কবিতার অসমাপ্ত একটি অধ্যায়। কিন্তু তা নানাভাবেই পরিপূর্ণ। তার প্রতিটি কবিতা আমাদের ভাবতে শেখায়। আমাদের চিন্তার অনুরণনে আক্তারুজ্জামান এখানেই সফল, আমরা তার কবিতা পড়তে পড়তে নিজেদের ভেতর তাকেই কেন্দ্রীভূত করি। তার কাব্যময়তায় বুঝতে তুলে আনি ক্লান্ত দুপুরের রোদ কিংবা বিষণ্ণ দুপুরের দীর্ঘ ছায়া। যে ছায়ায় আচ্ছাদিত মানুষের জীবন বর্ণিল ধূসর। দিন শেষে চলে যাওয়ার বিষাদ ও অন্ধকারের কান্না।
নাগরিক নিঃসঙ্গ জীবনে আমি বারবার ফিরে যাব আক্তারুজ্জামান লেবুর কবিতার কাছে। তিনি আমাকে শোনাবেন,
আমার মৃত্যুর পরও কাঠ ফাটা দুপুর আসবে
কাঁঠাল গাছে ছায়ায় দাঁড়াবে ঘর্মাক্ত দেহ
অসহ্য গরমেও কেউ দেবে ভাতঘুম…
আর এই ভাতঘুমে ঘেমে উঠে জানবো যে জন চলে যায়, তাকে আর ফেরানো যায় না।