অরুণ দা নেই। ২৬ মার্চ বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা অফিস খোলা। যথাসময়ে অফিস এসে ফেসবুক খুলতেই মনিরুল মনিরের দেয়ালের বার্তায় ভেসে উঠল অরুণ সেনের ছবি। সেখান থেকেই প্রথম জানলাম, অরুণ দা নেই। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কারও ফোনে কল করব, অথবা অরুণ দার ফোনেই কল করব, সে সাহসও পাচ্ছিলাম না। যদি, খবরটি সত্যি হয়। এই আশঙ্কা মনের মধ্যে ভিড় করছিল। কাজের ফাঁকে-ফাঁকে ফেসবুকের দিকে চোখ ছিল, যদি খবরটি মিথ্যে হয়। কিছু পরেই কবি ওবায়েদ আকাশসহ অনেকের দেয়ালেই অরুণ দা নেই, তাকে ঘিরে—স্মৃতি এবং কষ্টের কথা ক্রমাগত ভেসে উঠতে থাকে। অরুণ সেন নেই, পৃথিবীতে দেহ রেখে—তার প্রাণবায়ু চলে গেছে অনন্তের পথে। বুকের ভেতরটা রেল ইঞ্জিনের একটানা শব্দের মতো শব্দ করতে থাকে। অস্থির লাগতে থাকে। কিছুই ভালো লাগছে না, এই অনুভূতি কাজেও মন বসাতে দিচ্ছিল না। চলে যাবার চিরন্তন রীতিকে মেনে নিয়েই—স্বাভাবিক জীবনের দিকে পা বাড়াই।
প্রিয় মুখ, কবি অরুণ সেনের সঙ্গে পরিচয় এক যুগেরও বেশি সময় আগে। দুই হাজার এক সালে আমার সম্পাদিত ‘দ্বিবাচ্য’ প্রথম প্রকাশের মুখ দেখে। তখন বগুড়াতে বইয়ের অনেকগুলো দোকান। এর মাঝে ‘পড়ুয়া’তে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রকাশের আলোয় আসা ছোটকাগজ, সাহিত্যের কাগজগুলো আসতো। চোখে পড়া ছোটকাগজ ‘ঋতপত্র’ সম্পাদককে চিঠি লিখে ‘দ্বিবাচ্য’র জন্য লেখা চাই। ফিরতি ডাকেই তিনি পাঠিয়ে দেন, লেখা এবং নিজের কবিতার বই— ‘বাইরে রেখে পা’। এই বইটি সম্ভবত সেবারই বেরিয়েছিল। দশকের বিচারে বিশ শতকের আশির দশকের কবি অরুণ সেনের কবিতার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে— ‘শঙ্কায় নিনাদে শঙ্খ’, ‘বাইরে রেখে পা’, ‘শেষ বিকেলের কড়ানাড়া’, ‘রুদ্র গেছে রোদের বাড়ি’, ‘বুকে তার মুকুন্দরামের হাট’, ‘কে মানুষ পলাতক বুকে কাঁদে’, ‘ভালো আছ সোনালু ফুল’, ‘অনেক ভুলের প্রতিবেশী’, ‘অথচ নীরবতা’। ছোটদের জন্যও লিখেছেন তিনি। ছোটদের জন্য লেখা তার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘ছড়ায় ছড়ায় কথার নাচন’, ‘ছড়া কবিতার বিয়ে বাড়ি’, ‘বর্ণমালায় ছন্দ ছড়ায়’।
কাঁধে হাত রেখে ভেতরে নিয়ে গেলেন
প্রথম যোগাযোগের পর থেকে চিঠিতে নিয়মিতই যোগাযোগ হয়েছে। একসময় জীবনের প্রয়োজনে বগুড়া ছেড়ে চলে আসি ঢাকায়। চিঠির যুগ পেরিয়ে হাতে আসে সেলফোন। অরুণ সেনের সঙ্গে সেলফোনের সুবিধা নিয়ে কথা হয়েছে অসংখ্যবার। তিনি ঢাকায় এলে দেখাও হয়েছে কয়েকবার। কয়েক বছর আগে, হঠাৎ করেই এক বিকেলে ফোনে কল দিয়ে বললেন, মামুন, ভাই তুমি কোথায়? তখনো অফিস থেকে বের হইনি, শুনেই বললেন, তুমি কি মালিবাগ আসতে পারবে? আমার উত্তর হ্যাঁ, শুনে বললেন, কারিতাসের সামনে এসে আমাকে কল দিও।
কাজ শেষে নির্ধারিত জায়গায় এসে দাদাকে জানালাম। তিনি চলে এলেন গেটের কাছে, কাঁধে হাত রেখে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভারতীয় কয়েকজন লেখক এসেছিলেন কোন একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে। তাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই তিনি ডেকেছিলেন। সেই লেখকদের ভেতরে কেউ-কেউ ছোটকাগজও সম্পাদনা করেন, তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় শেষে যারা আমার লেখা চাইলেন, তাদের অরুণ দা বললেন, তিনিই পাঠিয়ে দেবেন। ‘ঋতপত্র’-এ প্রকাশিত আমার কোনো কোনো লেখা—অরুণ দা’ ভারতের কয়েকটি ছোটকাগজে পাঠিয়েছিলেন, নিজের দায়িত্বে। লেখাগুলো যেসব কাগজে ছিল সেগুলো আবার তিনি নিজের দায়িত্বে আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। পরিচয়ের পর থেকে প্রতিবারই ‘ঋতপত্র’ বের করার আগে লেখা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতেন। অলসতার কারণে বেশিরভাগ সময়ই দিতে পারতাম না, ফোনে এ নিয়ে বকাঝকাও করতেন। ২০১৬ সাল অরুণ সেন সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘ঋতপত্র’-এর শেষ সংখ্যা হবে, কল্পনাতেও আসে না। মাস দুইয়েক আগে এই সংখ্যাটি বের করার আগেও যথারীতি দাদার আহ্বান, এক সন্ধ্যায় দাদার ফোন কল—”মামুন ‘ঋতপত্র’র ট্রেসিং ছাড়ছি- তোমার লেখা তো নেই। এখুনি পাঠাও।’’ মাত্র কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ আগে অরুণ সেন সম্পাদিত ‘ঋতপত্র’ হাতে আসে।
তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার আত্মার আত্মীয়
শেষের দিকে ঢাকা এলে থাকতেন—ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অতিথি-নিবাসে। ওখান থেকে সন্তানের সঙ্গে দেখা করা সহজ। পাশেই ক্যাম্পাসে হেঁটেই চলে যাওয়া যায়, যাতাযাতের জন্য বাড়তি ধকল সইতে হয় না। পান খেয়ে রাতুল করে রাখা ঠোঁটের কবি অরুণ সেন—মনে ছিলেন শিশুর মতো সরল এবং হাসিখুশি। সিএ পড়ার পাঠটা শেষ করেনি নিজের বোহেমিয়ান মনের কারণে। বলতেন, বাবার অন্ন ধ্বংস করে—কবিতা লিখি, বুঝলে ভাই। যতবার দেখেছি—দাদার মাথায় ক্যাপ।
আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। একসময় পঞ্চাশ বছর মানেই অনেক সময় বলে মনে করা হতো। এখন পঞ্চাশ বছর বয়স কিছুই না। হাসতে-খেলতে, দেখতে-দেখতে চলে যায়। অথচ পঞ্চাশ পেরুনোর মাত্র আট বছর পর ৫৮ বছর বয়সে অরুণ দা চলে গেছেন। ১৯৫৮ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার ধলঘাট গ্রামে জন্ম। এরপর জীবনে থিতু হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম ছেড়ে সত্যিকার অর্থে কোথাও যাননি। ভীষণ অভিমানী এই মানুষটির অপরিমেয় স্নেহে পেয়েছি আমি। বছর দুইয়েক আগে ঢাকায় এসে গুলশানে কোন একটা কাজে এসেছিলেন। আমাকে ফোনে কল করে—অফিসে এলেন। নানা বিষয়ে কথাবার্তা হলো। যখন চলে যাবেন—এগিয়ে দিতে গেলাম, বাস নেই, সিএনজিও মিলছে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি—হঠাৎ দেখি পাশ থেকে দাদা নেই। এদিক-ওদিক খুঁজছি, চোখে পড়ছে না কোথাও। একটু পরেই হাতে ঠাণ্ডা কোমল পানীয়ের বোতল হাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই—বললেন, এত গরম পড়েছে ভাই, তোমার কষ্ট হচ্ছে। খাও। চোখের কোনে অজান্তেই হয়তো সেদিন জমে এসেছিল জল। গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসার পর এমন স্নেহাশীষ খুব বেশি পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। কত স্মৃতি। অনুজের প্রতি ভালোবাসা। আগলে রাখা, মানুষকে ভালোবাসতে শেখা—অরুণ সেন, আপনি আমাকে শিখিয়েছেন অনেক।
অনেক দূরের মানুষ, একটানা দীর্ঘ সময় পাশাপাশি থাকাও হয়নি, তবু তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার আত্মার আত্মীয়। দাদা, ভালো থাকবেন। আপনাকে আমার কারণে-অকারণে মনে পড়বে।