দু্ই হাজার বছর আগে অন্ধকার যুগের গোলকধাঁধার সামনে দাঁড়িয়ে যিনি ঘোষণা করেছিলেন—‘প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করো’ কিংবা ‘যা ঈশ্বরের তা ঈশ্বরকে দাও, যা রাষ্ট্রের তা রাষ্ট্রকে দাও’ তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং যিশু। তিনি নিজেকে কখনো ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবি করেননি, বলেছেন ‘বেন আদম’ অর্থাৎ মানুষের সন্তান বা ‘মনুষ্যপুত্র’। নিজেকে মানুষের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিয়ে মূলত বিশ্বের সব মানুষকে নিজের কর্মের সহযাত্রী, সহভাগী করে মানুষকেই মহৎ করে তুলতে চেয়েছেন।
আজ থেকে দুই হাজার উনিশ বছর আগে জেরুজালেম থেকে ৭ মাইল দক্ষিণে বেথলেহেম নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন যিশু। মায়ের নাম কুমারী মারিয়া। জন্মের মধ্য দিয়েই তিনি কট্টর ইহুদিনীতি লঙ্ঘন করেন। ইহুদি সমাজের সবচেয়ে বনেদি বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মারিয়ার বাবা যোয়াকিম আর তার স্বামী যোসেফও ছিলেন দাউদ বংশের লোক। তাই যিশুও ছিলেন রাজা দাউদের উত্তরসূরি কিন্তু তিনি কোনো রাজপ্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি জন্মেছেন রাজা দাউদের গ্রামে এক গোয়াল ঘরে। মারিয়া তার নাম রাখলেন—যিশু। এই নামের অর্থ ত্রাণকর্তা। এই দিনটি ঠিক কখন ছিল, তা জানা যায় না। গবেষকরা মনে করেন, এটি ছিল বসন্তের কোনো এক দিন। বর্তমানে সারাবিশ্বে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্ম দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়। এই দিনকে খ্রিষ্টানরা ক্রিস্টমাস বলে থাকে।
ইহুদি বিধান অনুসারে চল্লিশ দিন বয়সে যিশুকে জেরুজালেম মন্দিরে নেওয়া হয়—ঈশ্বরের কাছে নিবেদনের জন্য। যোসেফ ও মারিয়া এতই গরিব ছিলেন যে, এ সময় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে তারা ভেড়া বলি দিতে না পেরে একজোড়া ঘুঘু বলি দিয়ে ছিলেন। এরপর যিশুর বয়স যখন ছয় বছর হলো, তখন তাকে ভর্তি করানো হলো স্কুলে। প্রতিটি গ্রামেই ধর্মসভা ছিল। সেখানেই ছিল স্কুল, যার নাম ছিল গ্রন্থগৃহ। সেখানে পড়ানো হতো বাইবেল। যিশুর মাতৃভাষা ছিল অরামিক। আর বাইবেল লেখা ছিল হিব্রু ভাষায়। তিনি হিব্রু শিখলেন। বাইবেল ছিল আইন-কানুনের বই। এগুলো হলো তোরাহ, নবিম আর কিতুবিম। যিশু দেখলেন ইহুদিদের আইন কতটা ভয়ঙ্কর। দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ। ধর্মের কথা কোথায় সেখানে? যিশু বললেন, ‘এক গালে চড় মারলে অন্য গাল এগিয়ে দাও’, ‘নিজের ভাইকে সত্তর বার ক্ষমা করো।’
তোমাদের স্বর্গস্থ পিতার সন্তান হও, কারণ তিনি ভালো-মন্দ লোকদের জন্য সুর্য ওঠান। ধার্মিক-অধার্মিকদেরও জল বর্ষান। যারা তোমাদের ভালোবাসে, তাদেরই যদি ভালোবাসো, তা হলে ব্যতিক্রম ও বেশি কী করলে?
ত্রিশ বছর বয়সে যিশু এসে দাঁড়ালেন ধর্মগৃহে, ইহুদিদের তীর্থস্থান জেরুজালেম মন্দিরে। পাস ওভারের দিন—নিস্তার পর্ব। ফেরাউনের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ইহুদিরা এই দিনটিকে উদযাপন করে আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়। ছেচল্লিশ বছর ধরে যে পবিত্র মন্দির স্থাপন করা হয়েছে, যিশু দেখলেন সেটা বাজারে পরিণত হয়েছে। মন্দিরের ভেতরে বসেছে দোকান-পাট, টাকা ভাঙানোর লেনদেন। তীর্থযাত্রীরা মন্দিরে এলো কর দিতে হয়। সেই টাকা হতে হবে ইহুদি মুদ্রায়। উনিশ বছরের বেশি বয়স হলেই তাকে এই কর দিতে হবে। করের পরিমাণ ছিল দুই দিনের মজুরির সমান। মন্দিরের কর দেওয়া মানে সাধারণ ঋণ শোধ নয়, ঈশ্বরের ঋণ শোধ। এই ঋণ শোধ করতে হলে পবিত্র মুদ্রা। আর তখন মনে করা হতো—ইহুদি মুদ্রা ছাড়া কোনো মূদ্রাই পবিত্র নয়। ফলে যাদের কাছে রোমান, গ্রিস, প্যালেস্টাইন ও মিশরের মুদ্রা আছে, তা বদলে নিতে হতো ইহুদি মুদ্রা। এর ব্যবস্থাও ছিল মন্দিরের মধ্যে। চড়া মূল্যে সেগুলো বিক্রি করতো ব্যবসায়ীরা মন্দিরের ভেতরেই। সেখানে বলির পশু-পাখিও বিক্রি হতো। কারণ নিস্তার পর্বে পশু বা পাখি বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
যিশু দেখলেন তার পিতার গৃহ একটি বাজারে পরিণত হয়েছে। তিনি রেগে গেলেন। একাই সব তাড়াতে শুরু করলেন। ভেড়াগুলো তাড়ালেন, পাখিগুলো উড়িয়ে দিলেন। শুরু হলো তার ইহুদি ধর্ম সংস্কারের কাজ।
প্রতিশোধপরায়ণ ইহুদিদের যিশু বললেন, ‘ভাইয়ের প্রতি রাগ করো না, তাহলে সে বিচারের দায়ে পড়বে তোমাদের ওপর। তাকে নির্বোধ বলো না, তা হলে তুমি মহাসভার দায়ে পড়বে। কাউকে মূর্খ বলো না, তা হলে অগ্নিময় নরকে যাবে। বেদীর কাছে নৈবেদ্য উৎসর্গ করার সময় যদি মনে পড়ে যে, তোমার বিরুদ্ধে তোমার ভাইয়ের কোনো অভিযোগ আছে, তা হলে নৈবেদ্য ফেলে রেখে ভাইয়ের কাছে যাও। তার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে বন্ধুত্ব করো, তারপর এসে নৈবেদ্য উৎসর্গ করো।’
ইহুদি আইনে বলা হয়েছিল, ‘শত্রুকে দ্বেষ করিবে।’ যিশু বললেন, ‘তোমরা নিজ নিজের শত্রুকেও ভালোবাসবে। তাদের জন্য প্রার্থনা করো। যেন তোমাদের স্বর্গস্থ পিতার সন্তান হও, কারণ তিনি ভালো-মন্দ লোকদের জন্য সুর্য ওঠান। ধার্মিক-অধার্মিকদেরও জল বর্ষান। যারা তোমাদের ভালোবাসে, তাদেরই যদি ভালোবাসো, তা হলে ব্যতিক্রম ও বেশি কী করলে? ’
ইহুদিদের স্যাবাথ আইন অনুযায়ী শনিবার বিশ্রামবার। এই দিন তারা কোনো কাজ করে না। যিশু বললেন, বিশ্রামবারে তোমাদের কারও ছেলে যদি পুকুরে পড়ে যায়, তা হলে কি তাকে টেনে তুলবো না?’ এ সময় যিশু নিজে স্যাবাথ ডে-তে কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করেন এবং ধর্মগুরুদের রোষের শিকার হন।
৭২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে শমরিয়া নামে একটি অঞ্চল ছিল। সেখানে যারা বাস করতো, ইহুদিরা তাদের ঘৃণা করতো। কোনো ইহুদি সেই গাঁয়ের পথ দিয়ে যাতায়াত করতো না। যিশু সেখানে গেলেন। একটি কূপের কাছে বসলেন। তৃষ্ণা জলের জন্য কুয়োতে তাকালেন কিন্তু জল তুলবেন কেমন করে? কিছু সময় পর এক শমরীয় নারী সেখানে এলে যিশু তার কাছে জল চাইলেন। নারী অবাক হয়ে বলল, আপনি তো যিহুদি। যিহুদি হয়ে কেমন করে আমার কাছে জল চাইতে পারেন?’ যিশু বললেন ‘আমার কাছে অনন্ত জলের উনুই আছে।’ যিশু সেই গ্রামে রাত্রি যাপন করলেন। প্রেম আর ক্ষমার বাণী প্রচার করলেন।
তার কাছে তাই পাপী-তাপী-রাজা-ভিক্ষুক হাঁটু পেতে বসলো ঘোষণা করলো—‘জয় হোক মানুষের, জয় হোক চিরজীবিতের’
এই দেখে ইহুদিরা তাকে ধর্মের জালে ফাঁসাতে চেষ্টা করতে লাগলো। তারা একজন ব্যভিচারী মহিলাকে ধরে আনলো তার কাছে। ওইসময়ে ইহুদিদের বিধান অনুসারে ব্যভিচারী নারীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা নিয়ম ছিল। যিশুকে ধর্মযাজকরা বললেন, ‘প্রভু এ ব্যভিচার করে ধরা পড়েছে।’ যিশু বললেন, ‘তোমাদের শাস্ত্র কী বলে?’ তারা উত্তর দিলো, ‘পাথর ছুড়ে হত্যা করার কথা বলা আছে।’ যিশু বললেন, ‘বেশ, তবে তোমাদের মধ্যে যে নির্দোষ সে আগে পাথর ছুড়ুক।’ কিছুক্ষণ পর দেখলেন সেই নারীটি ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। যিশু তাকে বললেন, ‘যাও শান্তিতে বাস করো, আর পাপ করিও না।’ এভাবে ইহুদি ধর্মের সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন মসিহ।
মসিহ হিব্রু শব্দ—যার অর্থ অভিষিক্ত জন। গ্রিক ‘ক্রাইস্টোস’ ইংরেজিতে ‘ক্রাইস্ট’। এর অর্থও একই। তবে এটি ইহুদিরা উপাধি হিসেবে ব্যবহার করতো। শেষপর্যন্ত এটা যিশুর নামের সঙ্গে এটা এত বেশি ব্যবহৃত হয়েছে যে খ্রিষ্ট বলতে প্রাচীনকাল থেকে এখনপর্যন্ত লোকে যিশুকেই বোঝে আর খ্রিষ্টান বলতে বোঝে তার অনুসারীদের। পৃথিবীতে আজও খ্রিষ্টের অনুসারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। খ্রিষ্টানরা এই বেন আদমকে ঈশ্বরের পুত্র বলে মনে করে। কারণ যিশু একদিন বলেছিলেন, ‘ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা ঈশ্বরের পুত্র বলে গণ্য হবে।’ যিশু মর্ত্যলোকে মানুষের সঙ্গে স্বর্গের ঈশ্বরের মিলন ঘটাতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি সব খ্রিষ্টভক্তের কাছে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ রূপে আরাধ্য হন। কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায়ের সবাই তাকে খ্রিষ্ট বা মসিহ হিসেবে মেনে নেয়নি। যারা মেনে নেয়নি, তারা তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আনে।
সেই সময় ইহুদি বিধান অনুযায়ী ধর্মদ্রোহীর একমাত্র শাস্তি ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা। যিশুর ১২ জন শিষ্যের মধ্যে একজন ইহুদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। মাত্র ত্রিশটি রৌপ্যমুদ্রার জন্য সে যিশুকে ধরিয়ে দিলো শত্রুর হাতে। তার নাম তার ইস্কারিয়ত জুদাস। সে গেৎশিমানী বাগানে এসে যাকে চুমু দিলো তাকেই ধরলো সৈন্যরা। এই চুমুকে বলা হয় ‘কিস অব ডেথ’ বা জুদাস কিস। চুমু দিয়ে জুদাস চিনিয়ে দেয়, যে তিনিই যিশু। সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে গেলো। বিচার শেষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। ক্রশের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে যিশু বললেন ,‘পিতা, এদের ক্ষমা করো। কারণ এরা কী করছে, তা এরা জানে না।’ মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন যিশু। কিন্তু আজ তার অসংখ্যগুণমুগ্ধ ভক্ত। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন,‘যে পর্যন্ত একটা গমের বীজ মাটিতে পড়ে না মরে, সে পর্যন্ত তা একটিই থাকে। যখন মরে, তখন তা অধিক ফল উৎপন্ন করে।’ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি তার কর্মের সুফল সবার জন্য বণ্টন করে দিয়েছেন। আর এজন্যই তিনি অমর হয়ে আছেন। খ্রিষ্টানরা তার মৃত্যু দিনকে বলে ‘গুড ফ্রাইডে’ বা ‘পুণ্য শুক্রবার’। তারা বিশ্বাস করে যে, তিনি মৃত্যুর ৩য় দিনে মৃত্যুকে জয় করে হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী। তাই ‘গুড ফ্রাইডের’ পরের রবিবারকে তারা বলে ‘ইস্টার সানডে’ বা ‘পুণ্য রবিবার’। এভাবে যিশু নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে ঘোষণা করলেন মানুষের জয়। তার কাছে তাই পাপী-তাপী-রাজা-ভিক্ষুক হাঁটু পেতে বসলো ঘোষণা করলো—‘জয় হোক মানুষের, জয় হোক চিরজীবিতের’।