নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বাঙালি মুচমুচে গসিপ চর্চা করতে উস্তাদ। মেধা ও মননবর্জিত শিক্ষার যখন এত রমরমা অবস্থা, তখন বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবা দরকার। নাহলে দুর্গাপুজোয় শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে মাস্ক পরবো, না মাস্ক ছাড়াই লং টুরে যাবো, সেই নিয়েই বাঙালির কেটে যাবে। অথচ কে না জানে, কোনো একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিক্ষা সম্পর্কে সে কেমন ভাবনা-চিন্তা করছে, তার ওপর। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো আমরা একটু ভেবে দেখতে পারি।
অভিজিতের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে, স্ত্রী বিদেশি না হলে নোবেল পাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে, অভিজিৎ কলকাতায় এসে বিউলির ডাল খেলেন, না নূসরতের পাঠানো ইলিশ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারলেন, তা নিয়ে অনেক তো হলো আলোচনা। এবার একটু ভেতরের কথায় আসুন! লোকটা কী বলেছেন কলকাতা তথা ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে, খেয়াল করেছেন? অভিজিতের পরিবার যেভাবে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো, তার কথা কি বাংলার তামাম অভিভাবক একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেছেন, না গসিপ নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যাচ্ছে?
দয়া করে একটু খেয়াল করুন বাংলার ক্যারিয়ারিস্টিক অভিভাবকগণ, অভিজিতের কিন্তু স্কুলে নিয়মিত ফার্স্ট হতেন না বা তার মা-বাবাও কিন্তু কোনোদিনই ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার জন্য তাকে চাপ দেননি। তার মা নির্মলা দেবী স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি ক্লাসে ‘ব্যাকবেঞ্চার’ ছিলেন, এমনকী স্কুল থেকে খারাপ হাতের লেখার জন্য গার্জেন কল পর্যন্ত করা হয়েছিল। যে সব অভিভাবক স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকে আমার ছেলেটা একটুর জন্য ফার্স্ট হতে পারলো না বলে আফসোস করে বেড়ান বা পরেরবার তোকে ফার্স্ট হতেই হবে বলে শিশুকে বাড়িতে পরিপাটি করে ‘ব্রেনওয়াশ’ করেন, তাতেও কাজ না হলে অসম্ভব মানসিক চাপ সৃষ্টি করেন, তারা দয়া করে অভিজিতের জীবনী একবার পড়ে ফেলুন। দেখুন কিভাবে ‘ব্যাকবেঞ্চার’ হয়েও সাফল্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ স্পর্শ করা যায়, তার খানিকটা হদিশ হয়তো পেতে পারেন।
বস্তুতপক্ষে এই কথাটাই আমাদের দেশের শিক্ষাবিদরা বারবার বিভিন্নভাবে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে বলে গেছেন। আমরা তাদের প্রদর্শিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে হাজার হাজার বই পড়ছি, স্কুল-কলেজে হাজার হাজার সেমিনার-লেকচার শুনছি। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করছি না। অন্তত অভিজিৎবাবু যে কথাটা বলেছেন (আনন্দবাজার পত্রিকায় অভীক সরকারের সঙ্গে কথোপকথন, তারিখ ২২/১০/২০১৯), তাতে যদি কিছুটা সংবিৎ ফেরে বাঙালি গার্জিয়ানদের, ‘আমি যে সময় বড় হয়েছি তখনও এই পাগলামো টা দেখিনি, এই যে একটা অস্বাভাবিক তাড়না যে, আইআইটি’তে পড়তেই হবে বা অমুক কোম্পানিতে চাকরি পেতেই হবে, এ রকমটা দেখিনি। আমার মতে এটা বুদ্ধি এবং চিন্তার উৎকর্ষ নষ্ট করে দেয় ।আসলে আমাদের মন আর মগজেরএকটু হাত পা ছড়ানোর জায়গা লাগে। আর ওই চিন্তাটা খুব মূল্যবান যে আর পাঁচ জন যা করছে আমি তার থেকে আলাদা কিছু করব। কিন্তু এখন সবাই ভাবছে যদি আইআইটি না হয়, যদি প্রথম সারিতে থাকতে না পারি তাহলে এই মাঝারিয়ানার ফাঁদে আটকে যাব।’
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে বাংলার অভিভাবকরা যদি একটু ভরসা পান, তাহলে অন্তত বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ‘ক্লাসে তোকে ফার্স্ট হতেই হবে’, এই নিত্যনৈমিত্তিক গঞ্জনা থেকে একটু মুক্তি পায়।
রবীন্দ্রনাথ সেই কবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে বিষয়টির অভাব খুঁজে পেয়েছিলেন, তা হলো শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে গতানুগতিকতায় আনন্দের অভাব। তার বক্তব্য ছিল, ‘বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যিক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমনি করিয়া কোনো মতে কাজ চলে মাত্র কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করলে পেট ভরে কিন্তু আহারটি রীতিমতো হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়ার দরকার।’
আবার বিবেকানন্দ শিক্ষা সম্বন্ধে প্রায় একই রকমের কথা একটু অন্যভাবে বলেছেন, ‘মাথায় কতকগুলি ভাব ঢুকাইয়া সারা জীবন হজম হইল না, অসম্বন্ধভাবে মাথায় ঘুরিতে লাগিল ইহাকে শিক্ষা বলেনা। […] বিভিন্ন ভাবগুলিকে এমনভাবে হজম করিয়া লইতে হইবে, যাহাতে আমাদের জীবন গঠিত হয়, যাহাতে মানুষ তৈয়ারী হয় ,চরিত্র গঠিত হয়।’
অর্থাৎ মন আর মগজের মধ্যে একটু হাত-পা ছড়ানোর অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপারটি বারবার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আলোচিত হয়েছে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি অভিভাবক বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দেননি। তারা জেনেছেন ও সন্তানদের ভালো করে বুঝিয়েছেন ভালো শিক্ষা মানে ভালো চাকরি। তুমি যদি ভালো আইআইটি বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স না পাও বা মেডিক্যালে ভালো র্যাংক যদি করতে না পারো, তাহলে গোটা জীবনটাই বৃথা। কেননা এই সব জায়গায় একবার ঢুকতে পারলেই লাইফ সেট। মনে পড়ে যাবে থ্রি ইডিয়ট সিনেমার ফারহানের সেই বিখ্যাত ডায়ালগ, ‘ডিগ্রি নেহি হোগি তো, নকরি নেহি হোগি। নকরি নেহি হোগি তো, কোঈ বাপ আপনি বেটি নেহি দেগা । ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড নেহি দেগি, দুনিয়া রেসপেক্ট নেহি দেগি।’
অর্থাৎ দুনিয়ার রেসপেক্ট তখনই মিলবে যখন তুমি মোটা মাইনের ভালো চাকরি করবে, দামি বাড়ি-গাড়ি হবে ইত্যাদি ছোটবেলা তথা কৈশোর বয়স থেকে এই কথাটা আমাদের শিক্ষার্থীদের মগজে ঠুসে ঠুসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেলজয়ের পেছনের কাহিনি পুরোপুরি ভিন্ন কথা বলছে। বলছে, ক্লাসে ফার্স্ট না হয়েও শুধু পছন্দের বিষয়ে মননশীল চর্চা আর কঠিন পরিশ্রম তোমাকে কোন জায়গায় পৌঁছাবে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে হলে চাই মৌলিক ভাবনা আর অপরিমেয় ইচ্ছাশক্তি। আমরা সিনেমা -সাহিত্যে এই বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার জয়জয়কার দেখেছি কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে হাতের কাছে তেমন উদাহরণ ছিল না। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে বাংলার অভিভাবকরা যদি একটু ভরসা পান, তাহলে অন্তত বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো ‘ক্লাসে তোকে ফার্স্ট হতেই হবে’, এই নিত্যনৈমিত্তিক গঞ্জনা থেকে একটু মুক্তি পায়।