অক্টোবর কবি শামসুর রাহমানের জন্মমাস, কবি তপন বাগচীরও। ২৩ অক্টোবর প্রথমজনের জন্মদিন, দ্বিতীয়জনেরও। শামসুর রাহমান আমার অগ্রজ, তপন বাগচী অনুজ। প্রথমজনের সঙ্গে আমার অসমবয়সি বন্ধুত্ব ছিল, দ্বিতীয়জনের সঙ্গেও। রাহমান ভাই আজ নেই। তপন আছেন এবং ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তিনি পঞ্চাশ পাড়ি দিচ্ছেন। নিজের পঞ্চাশপূর্তিতে কেমন একটা ভয়ের অনুভূতি কাজ করেছিল আট বছর আগের একদিন। অনুজের পঞ্চাশে ভয়টা আবার উঁকি দিয়ে গেল মনে—পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করার ভয়।
‘আট বছর আগের একদিন’ কথাটি লেখামাত্র ‘মহাপৃথিবী’র কবি জীবনানন্দ দাশও উঁকি দিয়ে গেলেন এক ঝলক। মহাকালে রচিত মহাপৃথিবীতে কত পঞ্চাশ আসে যায়। বহু বছর আগে জীবনানন্দ দাশের পঞ্চাশ গেছে। তখন জন্মই হয়নি আমার। শামসুর রাহমানের পঞ্চাশে পৃথিবীতে ছিলাম। পূর্বাপর আরও কত পঞ্চাশ। সব পঞ্চাশই একদিন স্লেটে লেখা নাম হতে আসে, যা কবিতায় বলেছি—’স্লেটে লেখা নাম আমি মুছে যেতে আসি।’ আট বছর আগে আমার পঞ্চাশ আর আট বছর পর তপন বাগচীর পঞ্চাশও তা-ই। মুছে যেতে যেতেই আমরা এ-ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করি, এ-ওকে হিংসা করি। এর-ওর মধ্যে হানাহানি-খুনোখুনিও বাদ যায় না। আমার সঙ্গে তপন বাগচীর হয়েছে বন্ধুত্ব। আর, এই বন্ধুত্বের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছে কবিতা।
তপন বাগচীর সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বই দশকে, যখন আমি নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘আজকের কাগজ’ দৈনিকটির সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করি। ওই সাহিত্যপত্রে তপন বাগচীর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। যখন আমি কে জি মুস্তফা সম্পাদিত ‘মুক্তকণ্ঠ’ নামের দৈনিকের ব্যানারে ‘খোলা জানালা’ সম্পাদনা করি, তখনো একাধিক লেখা ছাপিয়েছি তপনের। দৈনিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় যখন ভিন্ন ডেস্কে বৃহত্তর দায়িত্ব পালন করি, তখনো পত্রিকাটির সাহিত্যপাতায় তপনের গদ্য-পদ্য ছাপা হতে দেখেছি। তারপর নিজেই যখন একটি দৈনিকের (আমাদের সময়) সম্পাদক, তখনো পত্রিকাটির সাহিত্যপাতায় তপনের মেধাদীপ্ত উপস্থিতি আমাকে প্রফুল্ল করেছে। এর বাইরেও তপন বাগচীর সৃষ্টিশীল কর্মচাঞ্চল্য আমার নজর এড়ায়নি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দূরস্থায়ী ভিত্তি কাজ। তপন বাগচী কথায় নন, কাজে বড়। তার সাম্প্রতিক সৃষ্টিশীল কাজ আমার নজরবহির্ভূত নয়। সম্প্রতি তার একটি গাথাকাব্যধর্মী দীর্ঘ কবিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ‘যাত্রাকাহিনী’ শিরোনামের কবিতাটির প্রথম সর্গের প্রথম চার চরণেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম:
একজন যাত্রা করে দিনে-রাতে সকল প্রহর
একজন নেচে যায় ঝাপতালে লোভের মুদ্রায়
একজন সঙ সেজে কেড়ে নেয় নটীর খেতাব
একজন পারদর্শী পৌরাণিক চৌষট্টি কলায়।
কিছুদূর যেতেই আরও চার চরণ সারস্বত প্রশান্তি এনে দিয়েছিল মনে:
দু’চরণ পদ্য লিখে পেতে চায় কবির শিরোপা
সিনেমা পাড়ায় তার ইদানীং বেশ যাতায়াত
চারজন সেবাদাসী সঙ্গে নিয়ে পতিত-পুরুষ
শিকারের খোঁজে-খোঁজে ইতিউতি ঘোরে দিনরাত
তারপর একনাগারেই পড়ে শেষ করেছিলাম পুরো কবিতাটি। ‘যাত্রাকাহিনী’র বিষয় ও ছন্দময়তাই শুধু নয়, কবিতাটির ভেতরে মণি-মুক্তোর মতো ছড়িয়ে থাকা চিত্রকল্পগুলোতেও চোখ আটকে গিয়েছিল থেকে থেকে;—’জীবননদীর তীরে কেঁদে মরে ঘুমন্ত সমাজ’ বা ‘যেদিকে বাতাস পায় সে দিকে খাটায় জানি শাড়ির বাদাম’ কিংবা ‘বুকের ক্রন্দন ঢেকে দুই চোখে মেখে নিই জলরঙধারা’। পয়ারগন্ধী অক্ষরবৃত্তে চলতে চলতে দৃশ্যান্তরের প্রয়োজনে কবি যেখানে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে নতুন আবহ তৈরি করেছেন, সেখানেও রূপকে-ছন্দে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি:
কার্তিকী মেঘ ভিজিয়ে দিয়েছে রিহার্সেলের বাড়ি
আমরা দুজন প্রতিদিন বসি মুখোমুখি আড়াআড়ি
তপন বাগচীর বইয়ের সংখ্যাও তার বয়স ছুঁই-ছুঁই। সব বই পড়ার সুযোগ না হলেও তার সাম্প্রতিক কৃত্যের নিরিখে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যায়, পঞ্চাশ বছরের জীবনে নিজেকে ফাঁকি দেননি এই কবি। সৃষ্টিশীল এই অনুজের শতায়ু কামনা করি।